• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৫, ২০১৯, ০২:৫৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০১৯, ০৮:৫৬ পিএম

মনোপলি ব্যবসা দুর্নীতির জন্ম দিয়ে থাকে: গোলাম রহমান

মনোপলি ব্যবসা দুর্নীতির জন্ম দিয়ে থাকে: গোলাম রহমান
গোলাম রহমান। ছবি: সংগৃহীত

 

গোলাম রহমান বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রাক্তন সচিব। তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বর্তমানে কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতির দায়িত্বে আছেন। গোলাম রহমান একজন সজ্জন, দৃঢ়চরিত্রের মানুষ হিসেবে সুপরিচিত। তিনি দেশের দুর্নীতির পরিস্থিতি, ভোক্তা অধিকার, বিনিয়োগ ও সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দৈনিক জাগরণের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার প্রাণবন্ত সাক্ষাৎকারটি জাগরণের পক্ষে গ্রহণ করেছেন এম এ খালেক

জাগরণ : বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম নির্বাচনি অঙ্গীকার হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা। অর্থাৎ কোনো পর্যায়েই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেয়া। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য কী করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?

গোলাম রহমান : দুর্নীতি সম্পর্কে অনেকের মনেই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তারা মনে করে, দুর্নীতি হচ্ছে তাৎক্ষণিক বা সমসাময়িক সময়ের সমস্যা। আসলে এটা মোটেও ঠিক নয়। কারণ দুর্নীতি কোনো সমসাময়িক সমস্যা নয়। দুর্নীতি অতীতেও ছিল; বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। দুই হাজার বছর আগে প্রণীত চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাজকর্মচারীরা রাজাকে প্রতারণা করে অথবা প্রজাদের অত্যাচার করে অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করে থাকে। সেখানে ৪০ ধরনের দুর্নীতির উল্লেখ আছে। মনু স্মৃতিতে বলা হয়েছে, রাজার প্রধান কার্য বা কাজ হচ্ছে রাজকর্মচারীদের দুর্নীতি থেকে প্রজাদের রক্ষা করা। এখন তো আর রাজা নেই। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে দুর্নীতির থাবা থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা বা দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। জননেত্রী শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তিনবার সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার প্রথম বক্তৃতাতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের অঙ্গীকার করেছেন। নির্বাচনি ইশতেহারেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল। আমি মনে করি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ একটি ইতিবাচক দিক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এটা একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার। আমরা সাধারণ মানুষ দুর্নীতি বলতে যা বুঝি, দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনে সেই ব্যাপক অর্থে দুর্নীতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনে দুর্নীতির কোনো সংজ্ঞা নেই। সেখানে বিভিন্ন আইনের ধারার কথা বলা হয়েছে। তফসিলভুক্ত অপরাধ যেগুলো আছে- দুর্নীতি দমন কমিশন শুধু সেগুলোর ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে পারে; তদন্ত করতে পারে, এমনকি আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তফসিলভুক্ত অপরাধ বলতে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনে যে সব অপরাধ এবং শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তাকেই বুঝানো হয়।

জাগরণ : শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা কতটা সম্ভব বলে মনে করেন?

গোলাম রহমান : উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর্নীতি কিছুটা দূর করা সম্ভব হলেও পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে কিছু দুর্বলতা আছে। আমাদের আইনি ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলার রায় পেতে অনেক ক্ষেত্রেই বিলম্ব হয়। বিচারিক আদালতে একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক ক্ষেত্রে ৮/১০ বছর সময় লেগে যায়। এরপর উচ্চ আদালতে আপীল করা হলে আরও সময় প্রয়োজন হয়। দেখা যায়, যেভাবে দ্রুত দুর্নীতির মামলাগুলো নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে না। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনি প্রক্রিয়ার প্রভাব সমাজে খুব একটা দেখা যায় না। দুর্নীতির কারণে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে, দুর্নীতির কারণে জেলে আছে অথবা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে- এমন উদাহরণ খুব একটা দেখা যায় না। দুর্নীতির বিচারের জন্য যে আইনি প্রক্রিয়া আছে তাকে সংক্ষিপ্ত করতে হবে। নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পর্যন্ত মামলা যদি সর্বোচ্চ দুই বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি হতো, তা হলে মানুষ জানতে পারবে এই ব্যক্তি দুর্নীতিপরায়ণ ছিল, তার এই শাস্তি হয়েছে। বছরে যদি এ রকম ২০০ মানুষের শাস্তি হয়, তা হলে দুর্নীতিবাজদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হতো। তারা দুর্নীতি করতে সাহসী হতো না। এটা বললাম আইনি প্রক্রিয়ার কথা। শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর্নীতি সম্পূর্ণরূপে দূর করা যাবে না। সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যা মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ উন্নয়নে সহায়ক হয়। এছাড়া পদ্ধতিগত পরিবর্তন সাধন করতে হবে। পানি সৃষ্টি হয় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের মিলনে। তেমনি দুর্নীতির সৃষ্টি হয় সেবাগ্রহীতা এবং সেবাদাতা মিলিত হলে। সেবাগ্রহীতা এবং সেবাদাতা যদি পরস্পর সংস্পর্শে আসতে না পারে বা আসার প্রয়োজন না হয়, তা হলে দুর্নীতি অনেকটাই কমে যাবে। এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সেবাদাতা এবং সেবাগ্রহীতার মধ্যে সাক্ষাতের কোনো প্রয়োজন হবে না। আমি যে সেবাটা চাই তা যদি অনলাইনে পাওয়া যায়, তা হলে উভয়ের সাক্ষাতের প্রয়োজন হবে না। আবার কোনো কোনো দুর্নীতি হয় সরবরাহস্বল্পতার কারণে। যেমন- গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। যেখানে সরবরাহস্বল্পতার কারণে দুর্নীতি হয়, সেখানে সম্ভব হলে সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যদি সরবরাহ বাড়ানো না যায়, তা হলে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে বিতরণ ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। মনোপলি ব্যবসায় অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির জন্ম দিয়ে থাকে। এক সময় ল্যান্ডফোনের সংযোগ পেতে নানা ধরনের দুর্নীতির আশ্রয়গ্রহণ করতে হতো বলে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু মোবাইল ফোন সহজলভ্য হওয়ার কারণে ল্যান্ডফোন সংযোগ গ্রহণকালে এখন দুর্নীতি হচ্ছে না বললেই চলে।

জাগরণ : আপনি দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে আপনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

গোলাম রহমান : আমি চার বছর দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করি। দায়িত্ব গ্রহণের পর কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, দুর্নীতির অভিযোগে নামি-দামি কেউ কি কখনো সাজা ভোগ করেছেন? তারা উত্তরে কেবল একজন রাষ্ট্রপতির নাম উল্লেখ করেন। কমিশনের আইনজীবীদের সভায় আমি একই প্রশ্ন উত্থাপন করি। তারা বলেন, একজন রাষ্ট্রপতি ছাড়া দু’/চারজন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান-মেম্বার সাজা ভোগ করে থাকতে পারেন। আমি যে চার বছর দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলাম, সে সময় অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমানের অনুপস্থিতিতে সাজা হয়। তার পাচারকৃত টাকা বিদেশ থেকে ফেরত আনা হয়েছিল। আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি ইত্যাদির তদন্ত হয়েছিল। মামলা হয়েছিল। অনেকেই জেলে গিয়েছিলেন। তবে অধিকাংশ মামলার এখনো বিচারকার্য শেষ হয়নি। বিচারিক প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি মামলার নিষ্পত্তি থেকে কেউ শিক্ষাগ্রহণ করছে না। বরং অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার ধীরগতি, বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, আইনের ফাঁকফোকর বা রাজনৈতিক প্রভাবে অনেকেই পার পেয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে দুর্নীতির ব্যাপকতা দিন দিন বাড়ছেই। এমতাবস্থায় দুর্নীতি দমনে দুর্নীতি দমন কমিশন অনেকটাই অকার্যকর। দায়িত্বগ্রহণের তিন মাসের মাথায় আমি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলাম, দুর্নীতি দমন কমিশন হচ্ছে ‘দন্তহীন বাঘ।’ আমার সেই মন্তব্য তখন বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এরপরও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো রাজনৈতিক নেতার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে এমন নজির আমাদের দেশে নেই।

জাগরণ : বর্তমান পরিস্থিতিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও কার্যকর করার জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন?

গোলাম রহমান : দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আমি ‘দন্তহীন বাঘ’ বলেছিলাম এ কারণে যে, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ফলে দুদকের কার্যক্রম সমাজ বা জনগণের ওপর যে প্রভাব ফেলার কথা ছিল, তা হয়নি। কথায় বলে, ‘জাস্টিজ ডিলেইড, জাস্টিজ ডিনাইড।’ বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে সমাজে দুদকের কার্যক্রমের তেমন কোনো প্রতিফলন ঘটে না। মূলত এ কারণেই আমি বলেছিলাম, দুদক হচ্ছে দন্তহীন বাঘ। এমনিতে দুদকের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। তারা কাজ করতে পারে। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমানো গেলে দুদককে যেসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তা করার ক্ষেত্রে দুদক ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে।

জাগরণ : কিছুুদিন আগে এ মর্মে নিয়ম করা হয়েছে যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। এটা কি দুদকের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে না?

গোলাম রহমান : বিভিন্ন সময়ে এ চেষ্টা হয়েছে, যাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহজে গ্রেপ্তার করা না যায়। এটা আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর আগেও একবার দুদকের আইনে এটা ঢোকানো হয়েছিল। তখন রিট করার পর হাইকোর্ট এটা বাতিল করে দেয়। আমার ধারণা, এবারও যদি কেউ আইনের এ ধারাটি চ্যালেঞ্জ করে তাহলে তা বাতিল হয়ে যাবে।

জাগরণ : আপনি তো কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ বেড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে কি?

গোলাম রহমান : যদি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়, জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়, যদি পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়- তা হলে বাজারে তার প্রভাব পড়বে। যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্যমূল্য স্থিতিশীল আছে; স্থানীয় বাজারে বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময় হার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। মুদ্রার বিনিময় হার যদি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকে, মুদ্রাস্ফীতি খুব একটা বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে বলে আমি মনে করি না।

জাগরণ : বর্তমান সরকার অব্যাহতভাবে ১০ বছর ক্ষমতায় আছে। আরও ৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্জিত অর্থনৈতিক সাফল্য আপনি কীভাবে দেখছেন?

গোলাম রহমান : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য বা অর্জন নিয়ে আমার নতুন করে কিছু বলার নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। এটা আমাদের জন্য একটা বিরাট অর্জন। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কিছুটা মন্থর হয়ে পড়লেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি মোটামুটি গতিশীল থাকবে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। বিশে^র ৯টি উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। দারিদ্র্যের হার কমেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ সফল সাসটেইন গ্রোথের স্টেজে চলে যাবে, যদি উন্নয়নের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে। মূলত এসব কারণেই বলা হয়, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নে মহাসড়কে ধাবমান।

জাগরণ : ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রে কিছুটা স্তিমিত ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা কীভাবে উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন?

গোলাম রহমান : বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি বিনিয়োগ পর্যাপ্ত পরিমাণে বেড়েছে, এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগও বেড়েছে। তবে সেটা হয়তো প্রত্যাশামতো বাড়েনি। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে এবং অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশে কয়েক বছর ধরেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আরও বাড়ানোর জন্য। এ ছাড়া বিনিয়োগ বৃদ্ধি অর্থাৎ শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য উপযুক্ত জমির প্রয়োজন হয়। সরকার শিল্প স্থাপনের জন্য জমির অভাব দূর করার জন্য ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে আগামীতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও পুঁজির পসরা নিয়ে আসবে। কারণ বাংলাদেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ এবং বিশাল বাজার রয়েছে। এ সুবিধা ব্যবহার করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন।

জাগরণ : সরকার নির্বাচনি ইশতেহার মোতাবেক আগামী ৫ বছরে ১ কোটি ২৮ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে প্রতি উপজেলা থেকে ১ হাজার জনকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। এ কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রয়োজন কতটা বলে মনে করেন?

গোলাম রহমান : উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের অবশ্যই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। দেখা যাচ্ছে, তৈরি পোশাক শিল্প থেকে শুরু করে আরও অনেক শিল্পে মধ্যম পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ে প্রচুর বিদেশিরা কাজ করছে। ভারতীয়, পাকিস্তানি বা শ্রীলংকার প্রচুর কর্মী আমাদের এখানে কাজ করে। আমরা যদি উপযুক্ত কর্মী সৃষ্টি করতে পারতাম, তা হলে এসব পদে আমাদের লোকজন কাজ করতে পারত। আবার আমাদের দেশের প্রচুরসংখ্যক মানুষ বিদেশে কাজ করছে। আমরা কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি না। আমাদের দেশের জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য কর্মমুখী শিক্ষা বিস্তার করতে হবে। যে শিল্পের জন্য যে লোকবল প্রয়োজন, তা আমরা সরবরাহ করতে পারছি না। আমাদের কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে।

জাগরণ : বর্তমান সরকার তো শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটা কীভাবে করা হতে পারে বা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটা কীভাবে কাজ করবে বলে মনে করেন?

গোলাম রহমান : সরকারের এ উদ্যোগ অবশ্যই অত্যন্ত ইতিবাচক। বাংলাদেশ তো কার্যত একটি বৃহৎ গ্রাম। আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখনো অনেকটাই গ্রামনির্ভর। কিন্তু গ্রামে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। শহুরে সুবিধা ভোগ করার জন্য মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস করে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ ধারণ করার ক্ষমতা ঢাকা শহরের নেই বললেই চলে। তাই আমরা যদি শহুরে সুবিধা গ্রামে সম্প্রসারিত করতে পারি, তা হলে শহরমুখী জনস্রোত অনেকটাই কমে আসবে। গ্রামের উন্নয়নও দ্রুততর হবে। গ্রাম থেকে মানুষ সব শহরে আসছে। অথচ বিষয়টি উল্টো হওয়াই ছিল বাঞ্ছনীয়। গ্রামগুলো যদি আরও উন্নত হয় এবং শহরের সুবিধা যদি গ্রামে বসেই পাওয়া যায়, তা হলে মানুষ শহরে আসতে চাইবে না। সরকার সেই উদ্যোগই গ্রহণ করেছে। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হবে এবং গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, আমি তার সাফল্য কামনা করি। যদি সরকারের এ উদ্যোগ সফল হয়, তা হলেই বাংলাদেশ সত্যিকার উন্নত দেশে পরিণত হবে।

জাগরণ : বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছে এতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দেশে অতি বিত্তবানের সংখ্যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এতে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

গোলাম রহমান : বাংলাদেশে বিত্তবান-বিত্তহীনের মাঝে বিদ্যমান বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা ঠিক। তবে এটা বাংলাদেশের একক চিত্র নয়। বিশ্বব্যাপীই এ চিত্র প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, বিশ্বের ৩৮০ কোটি মানুষের যে সম্পদ আছে, তা মাত্র ২৬ জন অতি বিত্তবানের সম্পদের সমান। বিত্তবান ও বিত্তহীনের মাঝে যে সম্পদ বৈষম্য তা যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে, আমাদের সে ব্যাপারে চেষ্টা চালাতে হবে। অর্জিত অর্থনৈতিক সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে সবাই যাতে তাদের জীবনমান উন্নত করতে পারে, আমাদের সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। সমাজে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা যাতে একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ে থাকে, তার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের সব মানুষ যাতে মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো সুবিধা ভোগ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।

জাগরণ : দৈনিক জাগরণের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।

গোলাম রহমান : জাগরণকে এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।