• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২১, ০৭:৩৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২০, ২০২১, ০৭:৩৩ পিএম

ক্ষুধা

ক্ষুধা

‘আব্বা...? মায় ডাকে। তারাতারি যাও।’

‘তোর মায়রে এট্টু আইতে ক এইহানে, যা।’

ছোট্ট রুবেল ছুটে যায় মায়ের কাছে। রাত নয়টা বাজে। এখনো খাওয়া হয়নি তাদের। চুলায় ছোট্ট একটা হাড়িতে সামান্য কিছু চাল বসিয়ে জ্বাল দিচ্ছে রুবেলের মা জমিলা খাতুন। রুবেলের ছোট বোন ভাতের জন্য কান্নাকাটি করে চুপসে যাওয়া দু’মুঠো মুড়ি খেয়ে অগোছালোভাবে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছে সে। বাধ্য হয়ে মুড়ি খাওয়ার কষ্ট তার চোখের কোণে লেগে আছে এখনো শুকিয়ে যাওয়া জলের রেখা হয়ে!

বাইরে চাঁদের আলোয় ভরে আছে চারপাশ। আকাশে বিশাল চাঁদ। খলবলে আলো ছড়াচ্ছে। রুবেলের বাবা আক্কাস শিকদার বাড়ির বাইরে বাঁশের চাটাই দিয়ে বানানো একটা বেঞ্চে বসে আছে। চেয়ে আছে আকাশের দিকে। চোখে শূন্য দৃষ্টি।

পেশায় ভ্যানচালক আক্কাস শিকদারের নিজের কোনো ভ্যান নেই। অন্যের ভ্যান দিনচুক্তিতে ভাড়া নিয়ে চালায় সে। সারাদিনে দুইশ টাকা জমা দিতে হয় মালিককে। বিদ্যুতের চার্জের খরচ বাদে বাকি টাকা তার। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যা আয়-রোজগার হয় তাতে করে চারজনের সংসার চলে যায়। হয়তো অনেক কিছুই হয়ে উঠে না সংসারে। কিন্তু পেট ভরে ভাত খেতে পায় তারা। তিন বেলা পেটভরে ভাত খেতে পারার সন্তুষ্ট নিয়েই সুখ আছে সংসারে।

কিন্তু হঠাৎ করেই সব পাল্টে গেছে। মৃত্যু ভয় তাড়া করে ফিরছে মানুষকে। করোনাভাইরাসের কারণে হিসেব-নিকেষ পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবীর! লকডাউনে সব বন্ধ হয়ে আছে। ঘরের বাইরে কেউ বের হচ্ছে না। যাচ্ছে না কোথাও। ভ্যানচালক আক্কাসও ঘরবন্দি। বাধ্য হয়েই। কারণ ভ্যানে কোথাও যাওয়ার মতো কেউ নেই। বাজার-ঘাট সব খালি। ঘরে বসে থাকা ছাড়া কোনো কাজ আর নেই। ওদিকে হাঁড়ি শূন্য। পেটের যন্ত্রণা তো আর থেমে থাকে না! জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিয়েছে গত সাত দিন ধরে। কেউ আর জিজ্ঞেস করেনি।

‘কি হইছে.... ডাকছো ক্যান।’ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ায় জমিলা খাতুন। হালকা বাতাস তার ঘামে ভেজা শরীরে শীতল ছোঁয়া দিয়ে যায়।
‘তারাতারি কও। কি জইন্যে ডাকছো।’ কিছুটা কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠে জমিলা।

‘বহো এহানে। চাইয়া দেহো কি সুন্দর চাঁন উঠছে। চান্দের আলো যে এত সুন্দর হয় আগে বুঝি নাই!’
 
‘চাঁন দ্যাখলে প্যাট ভরবো? প্যাট তো চাঁন বুঝে না!’ দুঃখী গলায় বলে জমিলা।

আক্কাস শিকদার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। চাঁদের সৌন্দর্য মিছে বোঝার চেষ্টা করে ভুলে থাকতে চায় পেটের ক্ষুধা। জমিলা তাকায় স্বামীর মুখের দিকে। স্বামীর চোখ অনুসরণ করে চাঁদের দিকে। চাঁদ ঘিরে আকাশে ছিটছিট মেঘ। সামনের খোলা মাঠ ভরে আছে জোৎস্নায়।

‘আব্বা...?’ ছেলে রুবেল কখন যেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ছেলের দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয়,‘হুম...’।

‘কত্ত বড় চাঁদ! কও দেহি আব্বা, চাঁদটা কিসের মতোন দেখা যায়?’

‘জানি না। তুইই ক?’

‘আজকের চাঁদটা দেখতে ঠিক পরোটার মতোন..। ত্যাল দিয়া ভাজা পরোটা... ঠিক না আব্বা!’ বলেই হেসে উঠে রুবেল। 

আক্কাস শিকদার তাকিয়ে থাকে ছেলের মুখের দিকে। তারপর ঝটকা মেরে ছেলেকে টেনে নিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে রাখেন বুকের সাথে। চেয়ে থাকেন চাঁদের দিকে। চাঁদের আলোয় চিক চিক করে উঠে চোখ। মুহূর্তেই পরোটার গন্ধে ভরে উঠে চারপাশ। বুক ভরে শ্বাস নেয় রুবেল। দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। ঝিঁ ঝিঁ পোকারা তাদের সংগীত থামিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়!