• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০১৯, ০২:৪২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৬, ২০১৯, ০৮:৪৭ পিএম

নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা ৫ মিনিটে বাস্তবায়ন 

নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা ৫ মিনিটে বাস্তবায়ন 
নুসরাত হত্যার সঙ্গে জড়িত আসামিরা -ছবি : জাগরণ

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল সিনিয়র মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা হয় ৪ এপ্রিল। কেরোসিন কেনা হয় ৫ এপ্রিল। ৬ এপ্রিল নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সময় লাগে মাত্র ৫ মিনিট। 

৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে এলে কৌশলে মাদ্রাসার ভবনের ছাদে ডেকে নেয়া হয় নুসরাতকে। এরপর নুসরাতের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। পরে শামীম ও জাবেদ তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা সংখ্যায় ৫ জন ছিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও সময় লেগেছে মাত্র ৫ মিনিট। সবই করা হয়েছে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার নির্দেশে। নুসরাতকে আগুন দিয়ে হত্যার কথা সিরাজের দুই ছেলেও জানতো। এমন লোমহর্ষক বর্ণনা উঠে এসেছে নুসরাত হত্যার অন্যতম প্রধান আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেনের জবানবন্দিতে। গত ২৭ মার্চ নুসরাতের যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে ৬ এপ্রিল তার শরীরে অগ্নিদগ্ধ করার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তারা।

এই হত্যাকাণ্ডের পর খুনিরা বিষয়টি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি রুহুল আমিন এবং পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর মকসুদ আলমকে জানিয়েছিলেন। এই খুনের ঘটনায় মকসুদ এখন কারাগারে। হত্যাকাণ্ডের আগে অধ্যক্ষ ‘সিরাজ উদদৌলা মুক্তি পরিষদ’ নামের ২০ সদস্যের কমিটির জন্য টাকা দিয়েছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা জনৈক কেফায়েত উল্লাহ। পুলিশ, আইনজীবী ও আদালত সূত্রে পাওয়া জবানবন্দিতে দেখা যায়, পুরো ঘটনায় ২৫–২৬ জন জড়িত। গত রোববার (১৪ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ৩ টার দিকে দুই আসামিকে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে দুই আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম ২৫ পৃষ্ঠা এবং নুর উদ্দিন ৩০ পৃষ্ঠার জবানবন্দি দেন।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নিশ্চিত করেছে, নুসরাত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম, জোবায়ের আহমেদ, জাবেদ হোসেন, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন এবং কামরুন নাহার ওরফে মণি। তাদের মধ্যে শাহাদাত হোসেন ফেনীর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। শাহাদাত হোসেন মাদ্রাসা কমিটি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি বলে দাবি করেছেন। 

তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেছেন, মাদ্রাসায় ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। অধ্যক্ষ সিরাজ জামায়াতের রুকন। শাহাদাতের জবানবন্দি নুসরাতকে হত্যার বিষয়ে গোপন বৈঠক হয় ৪ এপ্রিল রাতে। শাহাদাত ছাড়াও বৈঠকে ছিলেন নুর উদ্দিন, হাফেজ আবদুল কাদের, জাবেদ, জোবায়ের, মহিউদ্দিন শাকিল, শামীম (২), ইমরান, ইফতেখার হোসেন রানা ও শরীফ। হত্যা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন শাহাদাত, নুর উদ্দিন ও কাদের। নুসরাত মাস দেড়েক আগে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তার ওপর ক্ষুব্ধ হন শাহাদাত। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়, ৫ এপ্রিল আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষার দিন নুসরাতকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হবে। পুলিশের বিষয়টি মকসুদ ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং রুহুল আমিন (উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) দেখবেন। সিদ্ধান্ত হয় শাহাদাত, জোবায়ের, জাবেদ, ও মণি সাইক্লোন সেন্টারের (তৃতীয় তলা ভবন) ছাদে থাকবেন। মণি তার বাড়ি থেকে তিনটি বোরকা নিয়ে আসবেন। কেরোসিন আনবেন শাহাদাত। আর নুসরাতকে কৌশলে ডেকে আনবেন উম্মে সুলতানা পপি। গেইটে অবস্থান নেবেন আফসার ‘স্যার’, গেইটের বাইরে নুর উদ্দিন, হাফেজ কাদের, ইমরান হোসেন মামুন ওরফে ইমরান, ইফতেখার হোসেন ওরফে রানা, মো. হোসেন ওরফে শরীফ। সাইক্লোন সেন্টারের নিচে পাহারায় থাকবেন মহিউদ্দিন শাকিল ও শামীম (২)। 

জবানবন্দিতে শামীম বলেন, ‘বিষয়টি মকসুদ কাউন্সিলর, আফসার স্যার, সেলিম স্যার, হুজুরের (অধ্যক্ষ) দুই ছেলে নিসু ও আদনান, মণি এবং পপিকে জানানোর দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর এবং সেই দায়িত্ব পালন করি। আমরা তখন তৃতীয় তলার একটি কক্ষে ছিলাম। নুসরাতকে নিয়ে পপি ছাদে উঠলে আমরা ৪জন দ্রুত তার কাছে চলে যাই। এরপর মণি ও পপি নুসরাতকে ধরে ফেলে। তখন আমি নুসরাতের মুখ চেপে ধরি। জোবায়ের নুসরাতের ওড়না ছিড়ে হাত–পা বেঁধে ফেলে। আমরা নুসরাতকে ছাদে শুইয়ে ফেলি। আমি নুসরাতের মুখ চেপে মাথা ধরে রাখি। মণি তার বুক ধরে রাখে। পপি পা ধরে রাখে। এ সময় পপি পরিকল্পনামতো শম্পা বলে ডাক দেন। আসলে পপির ছদ্মনাম শম্পা। আর জাবেদ পলিব্যাগে থাকা কেরোসিন নুসরাতের পা থেকে বুক পর্যন্ত ঢেলে দেয়। জোবায়ের ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়। এতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ মিনিট। ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন দিলে তা দ্রুত গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আমি, জাবেদ ও জোবায়ের বোরকা খুলে ফেলি। আমি শৌচাগারের পাশ দিয়ে বের হয়ে যাই। জাবেদ মাদ্রাসার হোস্টেলে ঢুকে যায়। মণি ও পপি ওরফে শম্পা পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। কারণ তারা দুজনই নুসরাতের মতো আলিম পরীক্ষার্থী।

জবানবন্দিতে শামীম বলেন, ঘটনার পর তিনি রুহুল আমিনকে (উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) জানান এবং ময়মনসিংহে পালিয়ে যান। পরে মুক্তাগাছায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এদিকে মাদ্রাসার সহসভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাকে পুলিশের হাতে সৌপার্দ করি। 

পিবিআইয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, যৌন হয়রানির ঘটনায় মামলা হলে একজন ব্যাংকার অধ্যক্ষের পক্ষে আন্দোলন করতে টাকার জোগান দেন। তিনি আরও জানান, এ হত্যাকাণ্ডের  পরিকল্পনার কথা অধ্যক্ষ সিরাজের দুই ছেলেও জানতো।
 
উল্লেখ্য, সোনাগাজী ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় ৬ এপ্রিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে তিনি মারা যান ১০ এপ্রিল। এ ঘটনায় ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পুড়িয়ে মারার ঘটনায় সরাসরি জড়িত ৫ জনই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।

একেএস