• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুলাই ২১, ২০১৯, ০৮:৩৫ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২১, ২০১৯, ০৮:৩৭ এএম

ওয়াসার ১১ খাতে দুর্নীতি, দুদকের সুপারিশ আমলে নিয়েছে সরকার

ওয়াসার ১১ খাতে দুর্নীতি, দুদকের সুপারিশ আমলে নিয়েছে সরকার


ওয়াসার ১১ খাতের দুর্নীতি বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের সুপারিশ আমলে নিয়েছে সরকার। দেশের সেবা খাতের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বন্ধে সোমবার (২২ জুলাই) সভা আহ্বান করেছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। 

দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে ওয়াসার ১১টি খাতে ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের (এলজিআরডি) কাছে ১২টি সুপারিশ করা হয়। 

নিয়োগে দুর্নীতি, যথা সময়ে প্রকল্প শেষ না হওয়া, প্রকল্পে ধীরগতির কারণে ব্যয় বৃদ্ধি, একই ঠিকাদার নিয়োগ, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে অর্থ লুটপাটসহ ১১টি খাতে ভয়াবহ দুর্নীতি সংঘটিত হয় বলে দুদকের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান গত ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের হাতে এই অনুসন্ধানী রিপোর্ট তুলে দেন।

তাজুল ইসলাম দুদকের অনুসন্ধানী রিপোর্টের বিষয়ে শনিবার (২০ জুলাই) দৈনিক জাগরণকে বলেন, ওয়াসার ১১ খাতের দুর্নীতি বন্ধে দুদকের সুপারিশ সরকার আমলে নিয়েছে। দুদককে আমার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। যেটা আমাদের করার কথা ছিলো সেটা দুদক করে দিয়েছে। সোমবার এ বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয়ের সভা আহবান করা হয়েছে।  দুদকের অনুসন্ধানী রিপোর্ট ওয়াসার দুর্নীতি বন্ধে গুরুত্ব পাবে বলেও জানান মন্ত্রী।

দুর্নীতির অভিযোগ জমা দিয়ে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় সরকারে অধীনে ওয়াসার ১১টি খাতে আমরা দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছি। সেটার বিষয়ে আমরা বলেছি মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ নিতে। কারণ, ওয়াসা সরকারি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে লোপাট হচ্ছে। এটা হতে দেয়া যায় না। 

১১টি খাতে দুর্নীতির উৎস :

দুদকের জমা দেয়া অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ওয়াসায় দুর্নীতির ১১টি উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্পকাজে দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে ৮টি খাতে। এগুলোর মধ্যে প্রধান হলো- ওয়াসার প্রকল্পগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ না করে বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যুক্ত থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের নকশা ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ করা হয় না। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ঢাকাসহ বৃহত্তর মিরপুর এলাকার পানির চাহিদা পূরণে মিরপুরের ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে প্রকল্পের কথা তুলে ধরা হয়। প্রকল্পটি ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর অনুমোদন হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুযায়ী সরকারের ১৪২ কোটি, ওয়াসার ১০ কোটি, প্রকল্প সাহায্য ৩৬৯ কোটি টাকাসহ মোট ৫২১ কোটি টাকার প্রকল্প ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের ২৯ মার্চে সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় ৫৭৩ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়, এর মধ্যে সরকারের ২০০ কোটি ৫ লাখ, ওয়াসার ১০ কোটি, প্রকল্প সাহায্য ৩৬২ কোটি ৯৫ লাখ।

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে- নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে অযৌক্তিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ৫২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তব কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৬ দশমিক ৭২ ভাগ হলেও ঠিকাদার পরিশোধ করা হয়েছে ৩১৩ কোটি ৭১ লাখ, যা সংশোধিত ডিপিপি মূল্যের ৫৪ দশমিক ৭৫ ভাগ। এ ক্ষেত্রে কাজের অগ্রগতির সঙ্গে ঠিকাদারের পরিশোধিত বিলের অনেক পার্থক্য রয়েছে।


প্রকল্পে ধীর গতি :

ভূ-উপরিস্থ পানি শোধন করে ঢাকা মহানগরীর পানি সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি ব্যয়ে ‘সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার (ফেজ-৩) প্রকল্প’ ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুলাইয়ের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকল্পের কাজের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে দুদকের রিপোর্টে উল।লখ করা হয়েছে।

সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগার নির্মাণ (ফেজ-১) প্রকল্প ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও তা হয়নি।

ভূ-উপরিস্থ পানি শোধন করে ঢাকা মহানগরীর পানি সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য ৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া হয় ‘ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্প।’ ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা। প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৮ শতাংশ হলেও ঠিকাদারের হাতে চলে গেছে ২৩৮ কোটি টাকা।

রাজধানী ঢাকার গুলশান, বনানীসহ অন্যান্য এলাকায় পয়োবর্জ্য পরিশোধনের জন্য নেওয়া হয় ‘দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প।’৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকার এ প্রকল্প ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কাজের অগ্রগতি একেবারে নগণ্য। সরকারের খাত থেকে এ পর্যন্ত ১০১ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

‘ঢাকা মহানগরীর আগারগাঁও এলাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প’ ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। বরাদ্দ ২৪ কোটি টাকা। কিন্তু অগ্রগতি তেমন নেই।

‘ঢাকা পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পে’ বরাদ্দ ৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত এর মেয়াদ। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই। কাজের অগ্রগতি না থাকলেও বিল পরিশোধ করা হচ্ছে কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারদের।

প্রকল্পে পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগ :

প্রকল্পে পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলেছে দুদক। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের বিষয়ে এমন কিছু শর্তারোপ করা হয় যাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক ঠিকাদার প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এ ছাড়া ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পদ্ধতি ও রাজনৈতিক পরিচয় এবং কাজ পাওয়ার বিনিময়ে ঘুষ লেনদেন বর্তমানে একটি প্রচলিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে স্পেসিফিকেশন ও ডিজাইন অনুযায়ী প্রকল্পকাজ যথাসময়ে শেষ হয় না এবং প্রকল্পের ব্যয়ভার অস্বাভাবিক বেড়ে যায়।

ব্যক্তি মালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়। ওয়াসা এখনো ম্যানুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করায় প্রকৌশল ও রাজস্ব শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন, যার মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসায় পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় ওয়াসার বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীদের নির্ধারিত কার্য সময়ের বাইরে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের ওভারটাইম বিল দেওয়া হয় যা তাদের মূল বেতনের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ। অনেক ক্ষেত্রে কিছু প্রভাবশালী কর্মচারী ওভারটাইম না করেও ওয়াসার কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বিল তুলে নেন।

দুর্নীতি প্রতিরোধে সুপারিশ :

দুদকের অনুসন্ধানী রিপোর্টে চিহ্নিত করা দুর্নীতি প্রতিরোধে ১২টি সুপারিশ করা হয়েছে। দুদক মনে করছে, চলমান প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ অপচয় বন্ধে বিভিন্ন প্রকৌশল সংস্থার অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর সমন্বয়ে যৌথ পরিমাপ টিম ও মনিটরিং টিম গঠন করা যেতে পারে। এর ফলে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারেরা প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে যথাযথভাবে করার বিষয়ে মনোযোগী হবেন। এতে সময়, অর্থ অপচয়, দুর্নীতি অনেকটাই কমে যাবে।

প্রকল্পের প্রাক্কলন তৈরির সময় কাজের যথার্থতা ও উপযোগিতা আছে কি-না তা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে আগেই নিশ্চিত হতে হবে। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যাতে অহেতুক না বাড়ানো হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটিতে দাতা সংস্থার প্রতিনিধিসহ টেন্ডার ও কেনাকাটা যথাযথ হচ্ছে কি-না তা মনিটরিং করার জন্য মন্ত্রণালয় ভিত্তিক শক্তিশালী কমিটি গঠন করতে হবে।

প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার প্রকল্প পরিদর্শনসহ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে।

ঠিকাদারদের বিল পরিশোধের আগে কাজের সঠিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। ঠিকাদার যতটুকু কাজ করছে তার গুণগত মান যাচাইয়ের ওপরই তার বিল পরিশোধ করা উচিত।

ব্যক্তি মালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ওয়াসা কর্তৃক ম্যানুয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে ডিজিটাল পদ্ধতিতে যেতে হবে। অবৈধ ওভারটাইম বিল রোধে ওয়াসার কর্মচারীদের জনবল কাঠামো সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। বেতনের সঙ্গে ওভারটাইম বিলের সমন্বয় সাধনসহ সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা জরুরি।

প্রকল্পকাজ বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা ওয়াসার কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যেমন: ঢাকা সিটি করপোরেশন, সওজ, বিদ্যুৎ বিভাগ ইত্যাদির সঙ্গে সুষ্ঠু সমন্বয় প্রয়োজন।

ওয়াসার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনার লক্ষ্যে গণমাধ্যম, দুদক, অডিট বিভাগসহ নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। সেবা গ্রহীতাদের নিয়ে মাঝে মাঝে গণশুনানির আয়োজন করা উচিত।

ওয়াসার বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নাধীন অবস্থায় বিভিন্ন প্রকৌশলী সংস্থার বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত সার্ভিল্যান্স টিম কর্তৃক আকস্মিক অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটায় প্রতিযোগিতামূলক প্রকাশ্য/ই-টেন্ডারিং, দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে কার্যাদেশ প্রদান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ সিনিয়র কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব দিতে হবে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বুয়েটসহ অন্যান্য পেশাদার সংস্থাকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

এমএএম/আরআই

আরও পড়ুন