১০ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট ও তাদের অনিয়ম তদন্তের জন্য গঠিত কমিটির ধীরগতির কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার (২১ আগস্ট) এই অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে এই এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেট কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সিন্ডিকেটের অনিয়ম তদন্তে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ কমিটি গঠন করেছিল।
আজ বুধবার কমিটিকে কার্যপরিধি ঠিক করে দিয়ে তিন মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন হাইকোর্ট । আদালত বলেছেন, ১৪ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল না করলে কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী রাশনা ইমাম। দুর্নীতি দমক কমিশনের (দুদক) পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। আর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ছিলেন শেখ জালাল উদ্দিন।
গণমাধ্যমকে রাশনা ইমাম বলেন, ৬ মাসের মধ্যে তাদের একটা তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা ছিল। এখন প্রায় ১০ মাস শেষ হতে চলেছে। এত দিনেও প্রতিবেদন না দেয়ায় কোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তদন্তের গতি নিয়ে। কোর্ট বলেছেন, ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার কথা, এখন ১০ মাস পার হয়ে যাচ্ছে। উনারা বারবার এসে সময় চাচ্ছেন। এ অবস্থায় আমরা (রিটকারী) কমিটিকে কার্যপরিধি ঠিক করে দিতে আদালতে আবেদন করি। আদালত আমাদের আবেদন মঞ্জুর করে পাঁচটি কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
পাঁচটি কার্যপরিধি হলো- ১. সিন্ডিকেট চালু ছিল ২০১৭ সালের ১০ মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই দুই বছরে কোন কোন রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিক পাঠাতে পেরেছে, এ তথ্য দিতে হবে। এতে যদি দেখা যায়, এই ১০ এজেন্সি ছাড়া কেউ শ্রমিক পাঠাতে পারেনি, তাহলে তাতেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে, তাদের একটা সিন্ডেকেট ছিল।
২. দেখতে হবে, প্রতিটি শ্রমিকের কাছ থেকে কত টাকা নেয়া হয়েছে মাইগ্রেশন খরচ বাবদ। সরকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা করে। তারপর এটাকে একটু বাড়িয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা করে নির্ধারণ করে সার্ভিস চার্জ নিতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে, প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা করে নেয়া হয়েছে। এ দুই বছরে বিদেশে গেছে ২ লাখ ৮৫ হাজার শ্রমিক। এটা তদন্ত করে দেখতে হবে কত টাকা নেয়া হয়েছে।
৩. মালয়েশিয়া থেকে যখন সিদ্ধান্ত এলো- ১০ এজেন্সির মাধ্যমেই শ্রমিক পাঠাতে হবে, তখন এখান থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে। এই প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়ে ১১ নম্বর বিবাদী নুর আলী- যিনি এই সিন্ডিকেটের মাস্টারমাইন্ড- সরকারের কাছে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, এক-একটি এজেন্সি আরো ২০টি করে রিক্রুটিং এজেন্সি অন্তর্ভুক্ত করলে তাতে ২০০টি হয়ে যায়। এই ২০০ এজেন্সির মাধ্যমে আমরা পাঠাব। ধীরে ধীরে সবাইকে তাতে যুক্ত করব। তখন সরকার এটাকে অনুমোদন করেছে। কিন্তু আমরা তদন্ত করে দেখতে বলেছি, সবাই মিলে পাঠিয়েছিল নাকি ১০ এজেন্সিই পাঠিয়েছে।
৪. বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে হলে শ্রমিকদের মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে হয়। মালেয়শিয়াগামীদের জন্য ২৬টি মেডিক্যাল সেন্টার খোলা হয়েছিল। এই ২৬টার মধ্যে ৮টা ছিল সিন্ডিকেটের মধ্যে। দেখা গেছে, যেখানে মেডিক্যাল পরীক্ষার ফি ছিল ১৫০০ থেকে ২০০০ হাজার টাকা, তারা নিয়েছে ৫ হাজার ৩০০ টাকা করে। পাঠিয়েছে প্রায় ৩ লাখ শ্রমিক। মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো হয়েছে ৫ লাখ শ্রমিকের। যারা যেতে পারেননি তাদের মেডিকেল পরীক্ষার টাকা ফেরতও দেয়া হয়নি। এই মেডিকেল সেন্টারের মাধ্যমে কত টাকা আদায় হয়েছে, সেটাও খুঁজে দেখতে হবে।
৫. জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ইসরাফিল আলমসহ ৪ জন সংসদ সদস্য মালেয়শিয়া গিয়েছিলেন সিন্ডিকেটের বিষয়ে তদন্ত করতে। বেসরকারি চ্যানেল এটিএন বাংলার একটা টকশোতে তিনি বলেছিলেন, তদন্ত করা উচিত। শ্রমিকদের থেকে যে টাকা নেয়া হয়েছে সেটা পাচার হয়েছে কি না, সেটাও তদন্ত করতে বলা হয়েছে।
এছাড়া সিন্ডিকেটের অন্যান্য অনিয়মও তদন্ত করতে পারবে কমিটি।
গত ২৬ জুন মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারী ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট ও তাদের অনিয়ম তদন্ত ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু কমিটি প্রতিবেদন দাখিল না করে আরো সময় চায়।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সিন্ডিকেটের অনিয়ম তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশে কমিটি গঠন করেছ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কমিটিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করা হয়েছে।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারী ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন আদালত।
মালেশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি উপেক্ষা করে ১০ এজেন্সির মাধ্যমে লোক নেয়ার ঘটনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বঞ্চিত অপর ১০টি এজেন্সি হাইকোর্টে রিট করে।
এমএ / এফসি