• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০১৯, ১০:০৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১১, ২০১৯, ১০:০৬ পিএম

৮ বছরের ঘূর্ণিপাকে সাগর-রুনি হত্যামামলা

৮ বছরের ঘূর্ণিপাকে সাগর-রুনি হত্যামামলা
সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি - ফাইল ছবি

একে একে ৬ জন তদন্ত কর্মকর্তার হাত হয়ে সপ্তম কর্মকর্তার কাছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন নাহার রুনি হত্যামামলার তদন্তভার। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ তামিল করতে আদালতের কাছ থেকে ৬৮ বার সময় নিয়েছেন এই কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ৮টি বছর কেটে গেলেও প্রতিবেদন দেয়নি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ পর্যায়ে তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা জেনে আজ সোমবার (১১ নভেম্বর) অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।

এদিকে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যামামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়ে সর্বশেষ আগামী ১৪ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) ধার্য আছে বিচারিক আদালতে। তবে প্রায় নিয়ম করেই মাসে-দেড় মাসে একবার আদালতে ওঠে এই মামলা। প্রতিবারই তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদন দাখিল না করে সময় চেয়ে আবেদন করেন। তারপর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আরেকটি দিন ধার্য করে দেন আদালত। পরের তারিখে একই আনুষ্ঠানিকতার পুনরাবৃত্তি এবং আবারও নতুন তারিখ। এভাবে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পেরুলেও দেয়া হচ্ছে না তদন্ত প্রতিবেদন।

যদিও ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিজেদের বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার এবং মেহেরুন রুনি খুন হওয়ার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।’

হত্যাকাণ্ডের পর রুনির ভাই নওশের আলম রোমানের করা মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার এসআই জহুরুল ইসলাম। পরবর্তীতে তার কাছ থেকে তদন্তের দায়িত্ব যায় ডিবির পরিদর্শক রবিউল আলমের কাছে। ৬২ দিন পর তিনি আদালতের কাছে ব্যর্থতা স্বীকার করেন। ২০১২ সালের এপ্রিলে তদন্তের দায়িত্বভার নেয় র‌্যাব। দায়িত্ব নিয়েই সাগর ও রুনির মরদেহ কবর থেকে তুলে এনে আবারও ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা পরীক্ষা করে র‍্যাব। বেশ কয়েকজনকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল সেসময়। তবে তদন্ত আর এগোয়নি।

রুনির ভাই নওশের আলম রোমান দৈনিক জাগরণকে বলেন, কয়েকদিন আগে র‌্যাব সদর দফতর থেকে এএসপি পদমর্যাদার একজন ফোন দিয়ে বলেন, নতুন করে তিনি এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন।

এর আগে সর্বশেষ কবে তদন্ত কর্মকর্তা যোগাযোগ করেছিলেন? এই প্রশ্নের জবাবে নওশের বলেন, অনেক আগে, সাধারণত তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হলে তারা ফোন করে জানান, এই-ই।

আরেক প্রশ্নের জবাবে নওশের আলম বলেন, ন্যায়বিচারের তো কোনো অপশনই নেই। এসময় তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে যখন যারা সম্পৃক্ত হয়েছেন, তারাই চান না তদন্ত প্রতিবেদন দিতে। তাদের কার্যক্রমেও মনে হয় না, তারা তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে চান। তদন্ত প্রতিবেদনই যদি না হয়, তাহলে বিচার হবে কীভাবে?

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা প্রশ্ন রেখে বলছেন, ওই ঘটনার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন তারা ক্লু খুঁজে পেয়েছেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছিলেন তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তাহলে তারা সেসময় বলেছিলেন আমরা পেয়ে গেছি, এরপর বছরের পর বছর কেটে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন দিচ্ছে না কেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী?

সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির সঙ্গে তাদের শিশুসন্তান মেঘ   - ফাইল ছবি

গত ২০ অক্টোবর (রোববার) সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এর ধারাবাহিকতায় আজ সোমবার তদন্ত কর্মকর্তা হাজির হন আদালতে। আদালতের নির্দেশে এদিন মামলাটির যাবতীয় নথিপত্র (সিডি) নিয়ে হাজির ছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম।

তার পক্ষে আদালতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পি। হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে নিজের মামলা প্রত্যাহারের আবেদনকারী তানভীর রহমানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।

জুলাইয়ে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন জানিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এফবিআই থেকে চারটি ডিএনএ টেস্টের মধ্যে দুটির রিপোর্ট পাওয়া গেছে। এ দুটি টেস্টের সাথে আসামিদের মিল পাওয়া যায়নি। বাকি দুটি টেস্টের রিপোর্ট পেলে ডিএনএর বৈশিষ্ট অনুযায়ী হত্যাকারীদের কল্পিত চেহারা আঁকার চেষ্টা করা হবে।’

তখন আদালত বলেন, ‘তাহলে কি ডিএনএ টেস্ট রিপোর্টের উপর এ মামলার ভবিষ্যত নির্ভর করছে? কবে আসবে ডিএনএ রিপোর্ট?’

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, শিগগিরই চলে আসবে।

বিচারক তখন মামলা বাতিলের আবেদনকারী তানভীরের বিষয়ে বলেন, ‘একটা লোক সাত বছর ধরে আদালতে যাচ্ছে-আসছে, তারিখে তারিখে হাজিরা দিতে হচ্ছে। আপনারা এখনও তদন্তই শেষ করতে পারছেন না।’

আইনজীবী ফাওজিয়া করিম তখন বলেন, তদন্ত শেষ না হওয়ার কারণে তিনি বিয়ে করতে পারছেন না। সামাজিকভাবে তিনি নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন।

এ পর্যায়ে আদালত তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে চান, তদন্তে নতুন কোনো ক্লু আছে কি না।

তদন্ত কর্মকর্তার নেতিবাচক জবাবে বিচারক বলেন, ‘ক্লু না থাকলে এ তদন্ত দিয়ে কী হবে? চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবেই এটি তালিকায়ই থেকে যাবে।’

তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মামলাটির তদন্ত শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দেয়ার আরজি জানালে বিচারক বলেন, ‘কী হবে? গত ৮ বছরে কিছু হয়নি এক মাসে আর কী হবে? ডিএনএ রিপোর্ট দিয়ে কল্পিত চেহারা আঁকা ছাড়া আর কিছু হবে না।’

‘আগে আইন ছিল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে বা তদন্তে কিছু না পেলে তদন্ত স্টপ হয়ে যেত। পরে কিছু পেলে আবার শুরু করা যেত এখন তো সে আইনও নাই।’

এরপর বিচারক তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে চান, যে ল্যাপটপ খোয়া গিয়েছিল সেটি কি উদ্ধার করা গেছে? জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, উদ্ধার করা যায়নি।

বিচারক তখন জানতে চান, কী কী আলামত জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ছুরি, বটি, কাপড় টাঙানোর দড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। মোট ২৩টি আলামত জব্দ করা হয়েছে। সবগুলো আলামতই বাসায় ব্যবহার্য।

জব্দকৃত ছুরি-বটি হত্যায় ব্যবহার করা হয়েছে কি না- বিচারক জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ডিএনএ টেস্টেই এসেছে এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।

বিচারক তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেন, ‘ল্যাপটপ মিসিং নিয়ে তো পত্রপত্রিকায় সেসময় রিপোর্ট হয়েছে, সেসব রিপোর্ট নিয়ে কি কাজ করেছেন আপনারা?’

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘এ মামলায় আমি সবে দায়িত্ব নিয়েছি। গত ৪ জুলাই থেকে। এর আগে আরও ৬ জন তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন।’

তখন বিচারক বলেন, এটা একটা সমস্যা, মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো।

এরপর আগামী বৃহস্পতিবার পরবর্তী আদেশের জন্য রাখে আদালত।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। দুজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ওই রাতে তারা ছাড়া ঘরে ছিল তাদের একমাত্র শিশুসন্তান মেঘ।

মামলাটিতে গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন ওই বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও আবু সাঈদ।

রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান ২০১২ সালের ১ অক্টোবর গ্রেফতার এবং দুই বছর কারাগারে থাকার পর ২০১৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর জামিন পান।

এমএ/ এফসি

আরও পড়ুন