• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯, ০৫:৪৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯, ০৫:৫৪ পিএম

যেভাবে নখদন্তহীন হয়েছিল সড়ক পরিবহন আইন

যেভাবে নখদন্তহীন হয়েছিল সড়ক পরিবহন আইন
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও তার লেখা ‘বিচারক জীবনের কিছু স্মৃতিকথা’ বইয়ের প্রচ্ছদ - ছবি : জাগরণ

সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের বিষয়টি যেন, শেষ হইয়াও হইল না শেষ। সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে একটি সময়োপযোগী আইনের দাবিতে কেটে গেল যুগের পর যুগ। সর্বশেষ তেমন একটি আইন পাস হয়ে তা কার্যকরও হয়েছে। কিন্তু এরইমধ্যে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে এই আইন কার্যকরে শিথিলতা দেখাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। প্রায় তিন যুগ আগে একইভাবে আন্দোলনের নামে কোণঠাসা করে আইনে শিথিলতা আনতে সরকারকে বাধ্য করেছিল শ্রমিকরা।

এবার শিথিলতার ঘোষণা আসার কয়েকদিন পর সম্প্রতি পরিবহন শ্রমিকনেতা ও সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শাজাহান খান বছরের পর বছর ধরে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) আন্দোলন করে আসা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে ‘জ্ঞানপাপী’ বলে মন্তব্য করেছেন। শাজাহান খানের এ সংক্রান্ত বক্তব্যকে নিসচা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন ‘নির্লজ্জ মিথ্যাচার’ বলে গত বুধবার (১১ ডিসেম্বর) মন্তব্য করেছেন।

পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত এক মামলার শুনানিতে ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ইলিয়াস কাঞ্চন তো নিজের জন্য আন্দোলন করছেন না। তিনি দেশের সকল মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করছেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারাজীবন আন্দোলন করছেন, অথচ তাকে হেয় করল শ্রমিকরা। বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন।

তবে সড়কে শান্তি ফেরাতে চাওয়া আইনকে দুর্বল করার নজির এটিই প্রথম নয়। এর আগেও সড়ক আইনকে নখদন্তহীন করেছিল শ্রমিকরা। তেমনি একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন আরেক বিচারপতি এবং বর্তমানে আইন কমিশনের সদস্য এ টি এম ফজলে কবীর। নিজের লেখা ‘বিচারক জীবনের কিছু স্মৃতিকথা’ বইয়ে এই তথ্য তুলে ধরেন তিনি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি বইটির ৫১-৫৩ পৃষ্ঠায় ‘পরিবহন শ্রমিক নেতাদের এক হুমকিতে আইন হলো দন্তহীন’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘১৯৮৪ সালের ঘটনা। একদিন চেম্বারে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর এজলাসে উঠার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু পেশকার তখনও কোর্টের কজলিস্ট ও ডাইরিতে সই নেবার জন্য চেম্বারে আসেনি। বিলম্ব দেখে এজলাস পিয়নকে জিজ্ঞেস করতেই, সে বলল- আজ তো খুলনায় হরতাল ডেকেছে তাই বাস চলাচল বন্ধ। পেশকারতো বাসে চড়ে অফিসে আসে তাই আসতে দেরি হচ্ছে।’

আপনি যে স্যার গতকাল এক ড্রাইভারকে সাত বছর জেল দিয়েছেন সে জন্যই পরিবহন শ্রমিকেরা আজ হরতাল ডেকেছে। বিষয়টি শুনে আমি থ বনে গেলাম।

‘আমি জানতে চাইলাম কী কারণে আজ হরতাল ডেকেছে? উত্তরে সে বলল- আপনি যে স্যার গতকাল এক ড্রাইভারকে সাত বছর জেল দিয়েছেন সে জন্যই পরিবহন শ্রমিকেরা আজ হরতাল ডেকেছে। বিষয়টি শুনে আমি থ বনে গেলাম। বিচার শেষে রায় দিয়েছি আর সেই রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল! আমি যেন বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলাম না।’

“মামলার ঘটনার কথা মনে পড়ল। ঘটনার দিন দু’জন লোক রাস্তার পাশে বসে গল্প করছিল। ওই সময় ঘাতক বাসটি অপর একটি বাসকে ওভারটেক করার সময় ওই দু’জন লোকের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয়। ফলে ঘটনাস্থলে একজন লোক মারা যায়। এ মামলাটি সাক্ষ্য-প্রমাণে সুপ্রমাণিত হলে আমি একমাত্র আসামি ড্রাইভারকে দণ্ডবিধির ৩০৪ বি ধারামতে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড দেই।”

‘রায়ের পরের দিনই ড্রাইভারকে জেল দেবার প্রতিবাদে হরতাল ডাকা হয়। বিষয়টি এখানেই শেষ নয়, আরও বিস্ময়ের পর্বতমালা অপেক্ষা করছিল। পরিবহন শ্রমিক নেতাদের দাবি ছিল দুর্ঘটনাজনিত কারণে কারও মৃত্যু হলেও ড্রাইভারকে জেল দেওয়া যাবে না। যেহেতু আমার প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলন সেহেতু আমি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাদের কর্মসূচির প্রতি দৃষ্টি রাখতাম। এরপর তারা ড্রাইভারকে প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে একদিন খুলনা বিভাগের সকল জেলায় ধর্মঘট পালন করে।’

‘সরকারের কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে কিছুদিন পর পরিবহন শ্রমিকেরা দেশব্যাপী হরতাল পালন করে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। শ্রমিক নেতারা হুমকি দেয়, যদি তাদের দাবি মানা না হয় তবে তারা পুনরায় হরতাল ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশকে অচল করে দেবে। এবার হুমকিতে কাজ হলো। পত্রিকায় দেখলাম মন্ত্রী পর্যায়ের নেতাদের সাথে পরিবহন শ্রমিক নেতারা যৌথসভা করে শ্রমিক নেতাদের আংশিক দাবি সরকার মেনে নিল।’

যানবাহন চালকদের অবহেলা বেপরোয়া গাড়ি চালানোর ফলে কারও মৃত্যু ঘটলে চালকের ওইরূপ কাজকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে দণ্ডবিধির ৩০৪ বি ধারাটি প্রণীত হয়। ১৯৮২ সনের ১০নং অধ্যাদেশ দ্বারা এই ধারাটি সন্নিবেশিত হয়। তখন এরূপ নরহত্যার অপরাধের সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান ছিল।’

গাড়ি চালকের অবহেলা বা বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য কারও মৃত্যু ঘটলে গাড়ি চালক মনে করেন তিনি কোন অপরাধ করেননি, যা হয়েছে তা একটা অ্যাকসিডেন্ট মাত্র।

‘পরিবহন চালকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সনের ২১নং অধ্যাদেশ দ্বারা শাস্তির পরিমাণ ১৪ বছর এর স্থলে ৭ বছর কারাদণ্ড করা হয়। আলোচ্য মামলাটি যখন রায় প্রদান করা হয় তখন ৩০৪ বি ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৭ বছর কারাদণ্ড এবং অপরাধটি ছিল অজামিনযোগ্য।’

‘কিন্তু ১৯৮৫ সনে পরিবহন শ্রমিকদের হুমকির মুখে তৎকালীন সরকার বাধ্য হয়ে ৪৮নং অধ্যাদেশ দ্বারা ৩০৪ বি ধারাটি সংশোধন করে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ডের স্থলে ৩ বছর কারাদণ্ড করা হয় এবং অপরাধটিকে জামিনযোগ্য করা হয়। সেদিন থেকেই বেপরোয়া গাড়ি চালানোর শাস্তি সংক্রান্ত ৩০৪ বি ধারটি হল দন্তহীন আইন।’

‘আইনের বিধান হলো জামিনযোগ্য অপরাধে কোন ব্যক্তি অভিযুক্ত হলে জামিনে মুক্তি পাওয়া তার অধিকার, এটা আদালতের করুণা নয়। কাজেই গাড়ি চালকের অবহেলা বা বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য কারও মৃত্যু ঘটলে গাড়ি চালক মনে করেন তিনি কোন অপরাধ করেননি, যা হয়েছে তা একটা অ্যাকসিডেন্ট মাত্র। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট ঢুকামাত্র জামিনে মুক্তি পান, আর ভিক্টিমের স্বজনেরা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন।’

প্রসঙ্গত, নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সরকার শিথিলতা দেখাবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ ছাড়া আইনের কয়েকটি ধারা পুনর্বিবেচনার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত সময় পর্যন্ত আন্দোলনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সংসদ সদস্য শাজাহান খান।

নতুন এই আইন বাস্তবায়নে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অসন্তোষের কারণে এ খাতের নেতাদের সঙ্গে গত ২৩ নভেম্বর রাত ৯টার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার ধানমণ্ডির বাসভবনে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শাজাহান খান এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান।

এমএ/ এফসি

আরও পড়ুন