• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯, ১১:২৬ এএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯, ১১:২৮ এএম

 অস্ত্র ও ক্যামেরা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হাবীব

 অস্ত্র ও ক্যামেরা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হাবীব
মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক হারুন হাবীব -ছবি : জাগরণ

কাঁধে অস্ত্র আর হাতে ক্যামেরা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হারুন হাবীব। একদিকে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন অন্যদিকে রণাঙ্গনের দুর্লভ ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছেন তিনি। স্বশস্ত্র যুদ্ধে তিনি ছিলেন রনাঙ্গনের সাংবাদিক। 

১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে হারুন হাবীব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল ঢাকার রাজপথে মিছিল মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। ৭ মার্চের জনসভায় যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উজ্জীবিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সেদিনকার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের র্শীষ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যার যার এলাকায় তরুণ ও যুবকদের সংগঠিত করতে পঠিয়ে দেন। সেদিনের তরুণ হারুন হাবীবের উপর দায়িত্ব পড়ে ময়মনসিংহ ও তার নিজ জেলা ভারতের সীমান্তবর্তী জামালপুরের তরুণ যুবকদের সংগঠিত করার।

সম্ভবত ১৬ মার্চ তিনি চলে আসেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে। হারুন হাবীব ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বুয়েটের আনোয়ারুল আজিম ছানার নেতৃত্বে এলাকার তরুণ যুবকদের সংগঠিত করার কার্যক্রম শুরু হয়। এতে গোটা এলাকার গণমানুষের মধ্যে জাগরণ তৈরী হয়। কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা দলে দলে স্থানীয় জিলাপাক সুগার মিলের অস্ত্র প্রশিক্ষণে যোগ দিতে থাকেন। লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে মিল মাঠের নবীন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির। ছুটিতে এলাকায় আসা ইপিআর ও পুলিশ সদস্যরা এইসব যুবকদের ট্রেনিং করানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রয়োজন পড়ে বেশকিছু অস্ত্রের। পরে স্থানীয় থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে ট্রেনিংয়ের জন্য কিছু অস্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিদিন থানা থেকে অস্ত্র আসে, ট্রেনিং শেষে ফের তা জমা দেয়া হয়। 

২০ মার্চে হারুন হাবীব ও আনোয়ারুল আজিমের নেতৃত্বে মুক্তিকামী জনতা দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন বেলতলি বাজারে প্রথমবারের মতো তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। স্টেশন এলাকায় বসবাসরত অবাঙ্গালিরা সেই ছবি তুলে সকল তথ্য সেনাবাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দেয়। এসব কার্যক্রমের খবর পেয়ে ময়মনসিংহ-জামালপুর হয়ে দেওয়ানগঞ্জে প্রবেশের পথে গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে পাক হানাদাররা বাহিনী সুগার মিলের দিকে এগিয়ে যায়। খবর পেয়ে হারুন হাবীবের নেতৃত্বে ৫০/৬০ জনের একটি দল যমুনা নদী পথে গুঠাইল হয়ে মলমগঞ্জের কাছে পৌঁছায়। সেখানে পাক হানাদার বাহিনীদের ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দেখতে পেয়ে তাদের প্রতিহত করতে ফায়ার শুরু করে। পাক বাহিনীরাও পাল্টা ফায়ার শুরু করে। এ সময় আধুনিক অত্রের মুখে সামান্য অস্ত্রে সজ্জিত নবীন মুক্তি বাহিনী টিকতে না পেরে পিছু হটে।  তাদের মনেকেই ধরা পড়েন, শহীদ হন। এ ঘটনার পর দেওয়ানগঞ্জ থানা ও সুগারমিল দখল করে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

 

এরপর পাকসেনারা নদীপথ দখলে রাখতে বাহাদুরাবাদ ঘাটে একটি বড় ক্যাম্প স্থাপন করে। পরদিন হারুন হাবীবের বাড়ি গিয়ে ভাঙচুর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে। পতাকা উড়ানোর অভিযোগে আনোয়ারুল আজিমকে ধরে নিয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। হারুন হাবীব সঙ্গীসাথীদের নিয়ে যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে যমুনার চরাঞ্চলে আত্মগোপন করেন। রেডিও আকাশবাণী ও বিবিসিতে তিনি খবর শুনেন ভারতের মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিম বঙ্গের সীমান্ত খুলে দেয়া হয়েছে। দলে দলে লোকজন পার্শ্ববর্তী ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিচ্ছে।

ভারতের পাহাড়গুলোতে ট্রেনিংয়ের খবর প্রচার হলেও মেঘালয়ের এই অঞ্চলে তখনও ট্রেনিং শুরু হয়নি। হারুন হাবীব একটি দল নিয়ে অনেক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কামালপুর বর্ডার হয়ে মেঘালয়ের তুরা জেলার মহেন্দ্রগঞ্জে পৌঁছান। সেখানে দেখা হয় বৃহত্তর ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ময়মনসিংহের রফিক ভূঁইয়া, জামালপুরের রাশেদ মোশারফ, আব্দুস ছামাদ, করিমুজ্জামান তালুকদার ও হাতেম তালুকদারসহ অনেক জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে। এ সময় তারা নিজের আরও দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন অনুভব করেন। এরপর সেখানে ক্যাম্প স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। মহেন্দ্রগঞ্জের পাহাড় কেটে তাবু বসানো শুরু হয়। ভারতীয় বিএসএফ এ ব্যাপারে স্বক্রিয়
সহায়তা করে।

 

কিন্ত হারুন হাবীব খবর পান ভারতীয় সীমান্তের অনেক জায়গায় তখন মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। কেবল এই এলাকা বাকি। এই পরিস্থিতিতে হারুন হাবীব বিক্ষুব্দ হয়ে ওঠেন। ভারতীয় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে ট্রাকে কাঁচা কলার ঝুপরিতে পালিয়ে তিনি আসামের ধুবড়ী যান। পরে ট্রেনে চেপে কোলকাতায় জয়বাংলা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র অফিসে পৌঁছান।  তারপর আবার ফিরে আসেন রণাঙ্গনে। আবারও ট্রেনিং গ্রহণ করেন তিনি।  যুদ্ধে অংশ নেন কামালপুর রণাঙ্গন ও জামালপুর, শেরপুর ও কুড়িগ্রামের বিভিন্ন রনাঙ্গনে। ঐতিহাসিক কামালপুর রণাঙ্গন ছিল ঐতিহাসিক ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। এই রণাঙ্গনের আওতাভুক্ত ছিল জামালপুর, শেরপুর, বকসীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জসহ আশপাশের নদীবাহিত অঞ্চল।  

কামালপুরের বিওপি ঘিরে পাকিস্তান বাহিনীর একটি বড়  ক্যাম্প গড়ে তুলেছিল। কামালপুর, শেরপুর, জামালপুর হয়ে টাঙ্গাইলের পথ ধরে ঢাকা আক্রমনের মূল প্রবেশ দ্বার ছিল এটি। এ পথকে সুরক্ষিত রাখতে অনেক সৈন্য মোতায়েন করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই ক্যাম্পটি দখলে নিতে চারপাশে বাংকার স্থাপন করেছিল তারা। অধিনায়ক মেজর তাহেরের (পরবর্তীতে কর্নেল) নেতৃত্বে কামালপুর রনাঙ্গনে একাধিক সন্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই বীর যোদ্ধা। ঐতিহাসিক চিলমারী যুদ্ধেও অংশগ্রহণ ছিল তার। ১৪ নভেম্বর কামালপুর দখলে নিতে গিয়ে কর্নেল তাহের গুলিবিদ্ধ হয়ে একটি পা হারান। সেই যুদ্ধেও কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে তিনি যুদ্ধ করেছেন।   

পাকিস্তান বাহিনীর রসদ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাতে উত্তরাঞ্চলের সাথে বাহাদুরাবাদ ঘাটের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বোমা মেরে জিলপার্ক সুগার মিলের অদুরে রেলব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন এই বীর সেনানী। অস্ত্র কাঁধে শুধু যুদ্ধই করেনি তিনি ক্যামেরার ক্লিকে যুদ্ধের চিত্র পৌঁছে দিতেন জয়বাংলা পত্রিকাসহ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার বেশ কয়েকটি  পত্রিকায়। যুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করে খবর প্রেরণ করতেন তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও। তেলঢালা ক্যাম্পে থাকাকালীন তিনি ক্যামেরা সংগ্রহ করেন যুদ্ধক্ষেত্রের দুর্লভ কিছু ছবি তোলেন। তখন চট্টগ্রামের ডাক্তার হুমায়ুন হাই নামে এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। তিনিও ছিলেন কুড়িগ্রামের তেলঢালা
ক্যাম্পে। তার একটি ক্যামেরা ছিল। সেটি দিয়েই প্রথমে হারুন হাবীবকে ক্যামেরায় ছবি তোলার তালিম দেন। ওই ক্যামেরা দিয়ে কিছুদিন কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজিবপুর ও কোদালকাঠিসহ ধরলা ও তিস্তা পারের ঘটে যাওয়া যুদ্ধের চিত্র তুলে পাঠালেন তিনি। আগস্ট মাসে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে ১১ নং সেক্টর গঠন হলে তিনি চলে আসেন। সেখানে সেক্টর কমান্ডার তাহের হারুন হাবীবকে সাদরে গ্রহণ করলেন। নিজের ক্যামেরাটি দিয়ে বললেন, এটি কাজে লাগাও। এই ক্যামেরা দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ ছবি তুলেছিলেন তিনি। যখন সশস্ত্র যুদ্ধে যেতেন অস্ত্রের সাথে ক্যামেরা ও টেপরেকর্ডার সঙ্গে নিতেন। ক্যামেরার ফিল্ম কিনতে ছুটতেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ৫২ মাইল দুরে তুরা পাহাড়ের
জেলা শহরে। সেখানে কুমারী নামে এক মহিলার স্টুডিও থেকে রিল কিনতেন, ওখানেই ছবি ‘ডেভলাপ’ ও প্রিন্ট করতেন। সেখান থেকে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও জয়বাংলা পত্রিকাসহ অন্যন্য পত্রিকা অফিসে যুদ্ধের ছবি ও খবর পাঠাতেন। খবর পাঠাতেন লোক মারফত ও পোস্ট অফিসের মাধ্যমেও। 

তার তোলা বাহাদুরাবাদ লাইনে উড়ে যাওয়া রেলব্রিজসহ যুদ্ধ চিত্র ফলাও করে ডাক সাইটের ভারতীয় পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয়। এসব যুদ্ধের সফলতার খবর পড়ে ও ছবি দেখে উজ্জীবিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতা। সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিজে লিফলেট লিখে আসামের গৌহাটি থেকে তিনি তা ছাপিয়ে আনেন। সেখানে হারুন হাবীবের দেখা হয় পিটিআই এর স্থানীয় সাংবাদিক মানিক চৌধুরীর সঙ্গে। এসব লিফলেট দেশের মধ্যে বিলি করা হয়।   

নভেম্বরে কামালপুরে যুদ্ধের চূড়ান্ত আক্রমণের রণকৌশল নেন সেক্টর কমান্ডার তাহের। হারুন হাবীব, মেজর তাহেরের ছোট ভাই আবু সাঈদ ও লেফটেন্যান্ট মান্নানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কোম্পানি ধানুয়া কামালপুরের দিকে অবস্থান নেয়। আরো দুটি গ্রুপ মিলে তিনদিক থেকে হানাদার বাহিনীর কামালপুর বিওপি ঘিরে ফেলে। মেজর তাহেরের নেতৃত্বে  মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করে আগ্রসর হতে থাকে। মিজান কোম্পানির একটি দলের অবস্থান নিশ্চিত হতে না পেরে মেজর তাহের নিজেই কামালপুর বিওপির কাছে চলে যান। এ সময় মর্টার সেলের আঘাতে তিনি তার একটি পা হারান। এই এলাকায় অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নেন হারুন হাবীব। ৪ ডিসেম্বর কামালপুর দখলের পর বক্সিগঞ্জ-শেরপুর হয়ে জামালপুরের দিকে অগ্রসর হতে গেলে হানাদার বাহিনীর বাধার মুখে পড়ে মুক্তি বাহিনী। এ সময় মুক্তি ও মিত্র বাহিনী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে ১০ তারিখে জামালপুর দখল করে। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হারুন হাবীবের, যুদ্ধের পর স্বাভাবিক কারণেই তিনি সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন। প্রথম যোগ দেন সেদিনকার বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (বিপিআই) নামের এক সংবাদ সংস্থায়। এরপর বাংলাদেশে সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক  লিখেছেন অসংখ্য গ্রন্থ, প্রায় সবই মুক্তিযুদ্ধের ওপর। মুক্তিযুদ্ধের  সাহিত্য রচনায় তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। সেক্টর কমান্ডারস্  ফোরামের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। 

একেএস