• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯, ০৩:২০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯, ০৩:৩২ পিএম

যেভাবে ওরা ঘৃণিত নাম

যেভাবে ওরা ঘৃণিত নাম

ইতিহাসের আলোকে

..................................

একাত্তরে রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর বেতনভোগী ১০ হাজার ৭৮৯ জন জনের তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সরকারের কাছে থাকা নথির ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনও বাহিনী ছিল না। বরং মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেকাতে ভিন্ন লক্ষ্য এবং উদ্দেশে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে এই এসব বাহিনী গঠন করেছিলো। এদের দেয়া হয়েছিলো সামরিক ট্রেনিং এবং সরবরাহ করা হয়েছিলো অস্ত্র। রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী কী কারণে গঠিত হয়েছিল দৈনিক জাগরণ এর পাঠকদের জন্য গ্রন্থিত করেছেন জাকির হোসেন  

 

রাজাকার

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিরা রাজাকার শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়। যুদ্ধরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। ‘রাজাকার’ ফারসি শব্দ। এর অর্থ ‘স্বেচ্ছাসেবী’। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগকালে তদানীন্তন হায়দ্রাবাদের শাসক নিজাম ভারতভুক্ত হতে অনিচ্ছুক থাকায় ভারতের সামরিক বাহিনীকে প্রাথমিক প্রতিরোধের জন্য রাজাকার নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। হায়দ্রাবাদের সেই সশস্ত্র বাহিনীর অনুকরণেই ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার। মে মাসে খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন কর্মী নিয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়। ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান মো. ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়। শুরুতে ১০টি জেলায় ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাদের রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে দেশের অন্যান্য অংশেও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়।

প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন। ১৯৭১ সালের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন। তবে এর নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তানপন্থী স্থানীয় নেতাদের হাতে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত এক অধ্যাদেশ বলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়।

রাজাকার বাহিনীর প্রাথমিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন। ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় রাজাকার বাহিনীর প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং সমাপ্ত হয়। পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক অধিনায়ক জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর সাভারে রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী একটি স্বতন্ত্র অধিদফতরের মর্যাদায় উন্নীত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে রাজাকার বাহিনীর স্বাভাবিক বিলুপ্তি ঘটে।

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস এর গবেষণা অনুযায়ী রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের মতো। জেনারেল নিয়াজী তার বইতে এই সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। স্বাধীনতার পর রাজাকারদের বিচারে ৩৭ হাজার জনের একটি তালিকা করা হয় বলে জানা যায়। পাকিস্তানপন্থী পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করা হত ভারতীয় চর, দুষ্কৃতকারী হিসেবে৷ ‘রাজাকররা ৭০ জন দুষ্কৃতকারী হত্যা করেছে’, ‘ভারতীয় চরকে নির্মূল করেছে’— এমন শিরোনাম একাত্তরে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ে বলা হয়েছে, ‘তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় গ্রামে-গঞ্জে অত্যাচার, নির্যাতন এবং সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী পথপ্রদর্শক।’

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ রচিত ধারাবাহিক ‘বহুব্রীহি’ নাটকে একটি টিয়া পাখিকে ‘তুই রাজাকার’ বলতে শোনা যায়। এই সংলাপ পরবর্তীতে রূপ নেয় রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের স্লোগানে। রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতেও ব্যবহার হয়েছে এই শব্দগুচ্ছ৷

আল বদর

আল বদর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা দান এবং তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্র অক্ষুণ্ণ রাখার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত আধা-সামরিক বাহিনী। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজীর পৃষ্ঠপোষকতায় সেপ্টেম্বর মাসে আল বদর বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে। ইসলামের ইতিহাসের বদর যুদ্ধকে আদর্শ করে এ বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকার বাহিনী গঠনের অব্যবহিত পরেই প্রতিষ্ঠিত হয় আল বদর বাহিনী। আল বদর বাহিনীকে মাঠ পর্যায়ে নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর। রাজাকারদের কার্যকলাপের সঙ্গে খানিকটা পার্থক্য ছিল আল বদর বাহিনীর। রাজাকাররা সামগ্রিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু আল বদর বাহিনীর লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক হত্যার মাধ্যমে নিরীহ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। পাকিস্তান বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করা ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য। আল বদররা ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে আল বদর বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটে।

শান্তি কমিটি

শান্তি কমিটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তান প্রশাসনকে সহযোগিতা করা এবং ঢাকা শহরের জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ১০ এপ্রিল ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এর আগে ৪ এপ্রিল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নূরুল আমীনের নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থী ১২ জন রাজনৈতিক নেতার একটি প্রতিনিধিদল ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকায় একটি নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন গোলাম আযম, ফরিদ আহমদ, খাজা খয়েরউদ্দীন, নুরুজ্জামান প্রমুখ। ১০ এপ্রিল ১৪০ সদস্য বিশিষ্ট ‘ঢাকা নাগরিক কমিটি’ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান হন মুসলিম লীগ নেতা খাজা খয়েরউদ্দীন। নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলের কারণে ফরিদ আহমদের নেতৃত্বে একটি অংশ মূল কমিটি থেকে বেরিয়ে এসে ‘স্টিয়ারিং কমিটি’ গঠন করে। এই স্টিয়ারিং কমিটি পরে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটির রূপ নেয় এবং এর নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও কল্যাণ কাউন্সিল। এ কাউন্সিলের প্রধান হন ফরিদ আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন পিডিপি নেতা নূরুজ্জামান। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মওলানা আবদুল মান্নান, জুলমত আলী খান, গোলাম আযম, মাহমুদ আলী, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া), পীর মোহসেন উদ্দিন (দুদু মিয়া), রাজা ত্রিদিব রায়, এ এস এম সোলায়মান।

শান্তি কমিটি গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করা এবং দেশকে বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করে পাকিস্তানি হুকুমত বজায় রাখা।

ক্রমান্বয়ে সারাদেশে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা এসব কমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্নভাবে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে শান্তি কমিটির বিলুপ্তি ঘটে।

আল শামস

আল শামস ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা দানের লক্ষ্যে গঠিত আধা-সামরিক বাহিনী। আল শামস আরবি শব্দ, এর আভিধানিক অর্থ সূর্য। সূর্যসৈনিক অর্থে এ নামকরণকে তাৎপর্যময় করা হয়েছে। আল শামসের সদস্যরা ছিল অতি দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আল শামস বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটে। 

জেডএইচ/এসএমএম