• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০২০, ০৯:২১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ৭, ২০২০, ০৯:১৮ এএম

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

রেসকোর্স ময়দানে বাংলার মুক্তি সংগ্রামের ডাক

রেসকোর্স ময়দানে বাংলার মুক্তি সংগ্রামের ডাক

আজ শনিবার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। একাত্তরের এইদিনে মুক্তিকামী মানুষের প্রত্যাশাকে ধারণ করে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শিশুপার্ক) লাখো জনতার সামনে দাঁড়িয়ে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেন তার ঐতিহাসিক ঘোষণা— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পাশাপাশি তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ডাকা ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য চারটি দাবি উত্থাপন করেন। রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নয়। কিন্তু এটাকেই বিবেচনা করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ঘোষণা হিসেবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তো বটেই, আজও বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা বাঙালিকে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করে।

একাত্তরের ৭ মার্চ মধ্যাহ্নের পর রেসকোর্স ময়দানে ছিল শুধু মানুষ আর মানুষ। লাঠি হাতে প্রতিবাদী মানুষ, শহরের মানুষ, গ্রামের মানুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব, বৃদ্ধ-যুবা- সর্বস্তরের মানুষ। এর আগের ঘটনাপ্রবাহে সেদিনের জনসভাটি পরিণত হয় বাঙালির মিলন মোহনায়।

এই দিনে বঙ্গবন্ধু মাত্র ২০ মিনিটের ভাষণে পাক বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশসহ সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণের দাবি উত্থাপন করেন। সেদিন প্রতিটি মানুষ ও মিছিলের গন্তব্য ছিল একটাই, রেসকোর্স ময়দান। পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের জন্যই যেন অধীর অপেক্ষায় ছিল পুরো জাতি। বসন্তের বৃক্ষশোভিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শিশুপার্কের যে জায়গায় গাছে গাছে সবুজ কুঁড়ি উঁকি দিচ্ছিল, একাত্তরের এই দিনে সেখানেই অঙ্কুরিত হয়েছিল আজকের বাংলাদেশ। 

এই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ সম্প্রচার না করায় বাঙালি কর্মচারীরা এদিন কাজ বন্ধ করে দেন। ফলে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার করা হলেও এ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। ফলে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে যায়। গভীর রাতে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীদের সঙ্গে সামরিক কর্তৃপক্ষের দীর্ঘ আলোচানায় পরদিন ৮ মার্চ (সোমবার) সকাল ৬টা হতে রেডিও সম্প্রচার শুরু এবং সাড়ে ৮টায় রেসকোর্সের বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণী ঢাকাসহ দেশের সকল কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত হয়। 

অন্যদিকে ‘স্বাধীন বাংলার’ দাবিতে এদিন (৭ মার্চ, রোববার) ব্রিটেন প্রবাসী প্রায় ১০ হাজার বাঙালি লন্ডনস্থ পাকিস্তানি হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভকারীরা শত শত ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডসহ ‘ভুট্টোর বিচার চাই’ বলে স্লোগান দেয়। বিক্ষোভ চলাকালে পাকিস্তানি হাই কমিশনার অফিসের বাইরে এলে তার প্রতি ঢিল নিক্ষেপ করা হয় এবং এতে তিনি আহত হন।   

পরদিন ৮ মার্চ (সোমবার) প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। এ দিন (৮ মার্চ,  সোমবার) দৈনিক ইত্তেফাক ‘পরিষদে যাওয়ার বিবেচনা করিতে পারি, যদি-’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে ৮ কলামে প্রকাশ করে। ইত্তেফাক ‘আজ থেকে আমার নির্দেশ-’, ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র বন্ধ’ শিরোনামে ৭  মার্চের (রোববার) ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে।   

আজাদ এদিন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে ৮ কলামে প্রকাশ করে। আজাদ-এ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত অন্য সংবাদগুলোর শিরোনাম ছিল— ‘ জাতীয় পরিষদে যোগদানে ৭ শর্ত’, ‘ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলিবে’, ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র নীরব’ ইত্যাদি। 

 দৈনিক সংবাদ এদিন ‘সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিলেই পরিষদ অধিবেশনে যোগ দিব কি না ঠিক করিব, এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম : মুজিব’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে ৮ কলামে প্রকাশ করে। এ ছাড়াও সংবাদ এদিন ‘মুজিবের নির্দেশ’, ‘কর্মচারীদের কাজ বর্জন, ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্র বন্ধ’ শিরোনামে কয়েকটি  খবর  গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে।    

‘৭১-এর ৮ মার্চ ( সোমবার)  দৈনিক ইত্তেফাক-এ  প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো—  
পরিষদে যাওয়ার বিবেচনা করিতে পারি, যদি-
(ক) অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়, (খ) সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া নেওয়া হয়, (গ) নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করা হয় এবং (ঘ) নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল (রোববার ৭ মার্চ) বিকালে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে সমবেত লাখ লাখ মুক্তিসেনানীর বজ্রনিঘোষ সংগ্রামী ধ্বনিতে জলদগম্ভীর স্বরে উপরোক্ত ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে শেখ সাহেব বলেন, ‘আপনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকিয়াছেন। আগে আমার এইসব দাবি মানিতে হইবে। তারপর বিবেচনা করিব, অধিবেশনে যোগ দিব কি না।’ এই দাবি পূরণ ছাড়া পরিষদে যাওয়ার অধিকার বাংলার জনগণ আমাকে দেয় নাই। 

বাংলার সার্বিক আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণাকল্পে ইতিপূর্বেই শেখ সাহেব ৭ই মার্চ রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন বলিয়া জানাইয়াছিলেন। সেই অনুযায়ী স্বাধিকারকামী লাখ লাখ লোক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ লাভের জন্য গতকল্যকার এই সমাবেশে যোগদান করেন। আর শ্লোগানমুখর লাঠিধারী সেই স্বাধিকারকামী জনসমুদ্রকে লক্ষ্য করিয়া শেখ মুজিব শপথদৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ভাইরা আমার, প্রস্তুত হও। এবারের সংগ্রাম বাঙালীর মুক্তির সংগ্রাম। রক্ত দিতে আমি প্রস্তুত। যদি আমি ও আমার সহকর্মীরাও ডাক দিতে না পারি মুক্তির সংগ্রামে পতাকা হাতে তোমরাই আগাইয়া যাইও।’

তিনি বলেন, ‘ঘরে ঘরে সংগ্রামের দুর্গ সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়িয়া তোল। মুক্তি আসিবেই।’

জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ সম্পর্কিত প্রেসিডেন্টের ঘোষণার উল্লেখ প্রসঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে সৃষ্ট সংকটের জন্য প্রেসিডেন্ট এবং জনাব ভুট্টোকে দায়ী করেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, গোলমালের সৃষ্টি করিলেন ভুট্টো, আর গুলি চলিল বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র জনতার উপর। তিনি বলেন, ‘যখনই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অর্থাৎ বাংলার মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হইয়াছে, যখনই তাদের হাতে নিজেদের বা সমগ্র পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার অর্পিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হইয়াছে তখনই তাদের উপর শক্তি লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়া হইয়াছে। কিন্তু কেন? কতকাল এই নির্যাতন চলিবে?’ তিনি বাংলার মানুষের উপর সামরিক শক্তি প্রয়োগ হইতে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান। সমাবেশে বক্তৃতা করিতে দাঁড়াইয়া ব্যথিত স্বরে বঙ্গবন্ধু  জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আজ আমি আপনাদের সামনে হাজির হইয়াছি। আপনারা সবই জানেন, সবই বোঝেন। বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। মানুষের মতো বাঁচিতে চায়- আত্মপ্রতিষ্ঠার অধিকার চায়’।
তিনি দুঃখ করিয়া বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে বাংলার মাটি সয়লাব করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু কেন? কি অন্যায় আমরা করেছিলাম? 
বাংলার মানুষ আশা করিয়াছিল আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘যত আশা লইয়া এদেশের মানুষ আমাকে, আমার দলকে ভোট দিয়াছে। তারা আশা করিয়াছিল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন চলিবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করিব, দেশকে সুষ্ঠুভাবে গড়িয়া তুলিব, মানুষ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার পাইবে। সে আশা পূরণের জন্য চেষ্টায় আমার ত্রুটি ছিল না- ত্রুটি নাই। কিন্তু আবার ষড়যন্ত্র।

২৩ বছরের ইতিহাস

বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে শেখ সাহেব বলেন, ‘গত ২৩ বছরের ইতিহাস ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, বাংলার মানুষের বঞ্চনা, আর্তনাদ, রক্তদান, আর মুমূর্ষের আর্তনাদের ইতিহাস। এই প্রসঙ্গে তিনি ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয় নস্যাতের ষড়যন্ত্র, ’৫৮ সালের সামরিক শাসন জারী, ’৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন এবং এবারের স্বাধিকার আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেন। 

দোষ কি আমাদের?

শেখ সাহেব বলেন, আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসিয়া শাসনতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রবর্তনের ওয়াদা করিয়াছিলেন, কিন্তু তারপর কি হইয়াছে? তিনি জিজ্ঞাসা করেন, দোষ কি আমাদের? তিনি বলেন, ‘মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে আমি ১৫ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার সুপারিশ করি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর কথামতো ৩রা মার্চ পরিষদ অধিবেশন ডাকিলেন, বলিলাম ঠিক আছে, জাতীয় পরিষদে আলাপ-আলোচনা হইবে। এখনও আমি বলিয়াছি যে, পশ্চিম পাকিস্তান হইতে একজন সদস্যও যদি যুক্তিসম্মত প্রস্তাব লইয়া আগাইয়া আসেন, এটা গ্রহণ করা হইবে। তবু তাহাদের মন ভরে নাই। ভুট্টো ঢাকায় আলোচনা শেষে বলিয়া গিয়াছিলেন, দরোজা বন্ধ হয় নাই; আরো আলোচনা হইবে। তারপর আমি মওলানা নূরানী, মাওলানা মুফতী মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে আলোচনা করিয়াছি। তাহাদের আমি বলিয়া দিয়াছি, বাংলার জনগণ ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে ভোট দিয়াছে। উহা পরিবর্তনের ক্ষমতা আমার নাই। এদিকে ভুট্টো বাংলার মানুষকে চরমভাবে অপমান করিয়া জাতীয় পরিষদকে ‘কসাইখানা’ বলিয়া আখ্যায়িত করিলেন, বাংলায় আসিলে ‘ডবল জিম্মি’ হওয়ার মতো মন্তব্য করিলেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন করিলে পেশোয়ার হইতে করাচী পর্যন্ত হরতালের ভয় দেখাইলেন। শুধু তাই নয়- তিনি হুমকি দিলেন কোনো পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্য ঢাকা গেলে তার মুণ্ডুপাত করা হইবে। আমি রাজী ছিলাম, ৩৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দিতে আসিলেন। কিন্তু তবুও ভুট্টোর জেদের দাম দিতে গিয়া অধিবেশন মুলতবি করা হইল। দোষী ভুট্টো, অথচ দোষারোপ করা হইল আমার উপর। বাংলার মানুষের উপর। আমি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ডাক দিলাম। সংগ্রাম শুরু হইল, শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম। 

আর একটিও গুলি চালাইবেন না

আওয়ামী লীগ প্রধান প্রশ্ন তোলেন, ‘কিন্তু কি পাইলাম? পাইলাম গুলী, নির্যাতন-মৃত্যুর পরোয়ানা। তিনি বলেন, বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষ অনাহারে থাকিয়া দেশরক্ষার অস্ত্র কেনার জন্য যে পয়সা দিয়াছে, সেই পয়সায় কেনা অস্ত্র প্রয়োগ করা হইতেছে সেই বাংলার মানুষেরই বিরুদ্ধে- তাদের নির্বিচারে পাখি শিকারের মতো হত্যা করার জন্য।’ সামরিক বাহিনীর উদ্দেশে শেখ সাহেব বলেন, ‘আপনাদের দায়িত্ব দেশ রক্ষা- শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করা, বাংলার মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাইবার কোনো অধিকার আপনাদের নাই। ব্যারাকে থাকুন, প্রয়োজনবোধে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবেন। বাংলার মানুষের বুকে আর একটাও গুলি চালাইবেন না।

কিসের গোলটেবিল

আওয়ামী লীগ প্রধান গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানে সম্মত হইয়াছিলেন বলিয়া প্রেসিডেন্ট বেতার ভাষণে যে ইঙ্গিত করিয়াছেন উহার জবাবে শেখ সাহেব বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে আমি তাহাকে ঢাকা আসিতে বলি। আমি বলিয়াছিলাম, আপনি প্রেসিডেন্ট, আপনি আসুন, দেখুন, কিভাবে মানুষের রক্ত লইয়া হোলিখেলা চলিতেছে। দেখিয়া বিচার করুন।’ তিনি বলেন, কিসের গোলটেবিল, কার সঙ্গে বসিব? যারা বাংলার মানুষের রক্ত নিয়াছে তাহাদের সঙ্গে গোলটেবিলে বসিব? কেন? শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্টকে বলিয়া দিয়াছি, শহীদের রক্তের দাগ রাজপথ থেকে এখনো শুকায় নাই। সেই রক্তের উপর দিয়া হাঁটিয়া আমি গোলটেবিলে যাইতে পারি না। 

গোপন বৈঠকের পর

আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, আমি মেজরিটি পার্টির নেতা, আমার সঙ্গে আলাপ না করিয়া, আমার সম্মতি না নিয়া ভুট্টোর সঙ্গে ৫ ঘণ্টাব্যাপী গোপন বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকিয়াছেন। বেতার ভাষণে তিনি আমাদের দোষারোপ করিয়াছেন। গোলমাল বাঁধাইলেন ভুট্টো আর গুলী চলিল বাংলার মানুষের উপর। পরিষদের অধিবেশন ডাকা হইয়াছে। কিন্তু আমার দাবি মানিতে হইবে। 

রক্তের সঙ্গে বেঈমানী করিতে করিব না

শেখ মুজিব দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলার মুক্তি আন্দোলনে যাহারা জীবন দিয়াছে, যাহারা রক্ত দিয়া আমাকে মুক্ত করিয়াছে, তাহাদের রক্তের সঙ্গে আমি বেঈমানী করিব না। রক্ত দিয়াই আমি রক্তের ঋণ শোধ করিব।

যদি আঘাত আসে

শেখ সাহেব বলেন, যদি আঘাত আসে, যদি আমি নির্দেশ নাও দিতে পারি, যদি আমার সহকর্মীদের পক্ষেও পথনির্দেশ দেওয়া সম্ভব না হয়, বাংলার মানুষ তোমরা নিজেরাই নিজেদের কর্মপন্থা ঠিক করিয়া নিও। হাতের কাছে যা পাও তাই নিয়া শত্রুর মোকাবিলা করিও। রাস্তাঘাট বন্ধ করিয়া দিও। চাকা বন্ধ করিয়া দিও। বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়িয়া মুক্ত সৈনিক হইয়া সর্বশক্তি লইয়া দুশমনের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইও। ইহার আগে, সভা শুরু হওয়ার আগে মঞ্চ হইতে সংগ্রামী শ্লোগান দান করেন ছাত্রলীগ নেতা নূরে আলম সিদ্দিক, শেখ সহিদুল ইসলাম, আ. স. ম. আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন। শেখ সাহেব মঞ্চে আসিয়া পৌঁছিলে তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা জনাব তোফায়েল আহমদ মঞ্চ হইতে শ্লোগান পরিচালনা করেন। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান জনাব আব্দুর রাজ্জাক স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মতৎপরতা পরিচালনা করেন। সভার শুরুতে কোরআন পাঠ করেন মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ। সূত্র- ইত্তেফাক  : ৮ মার্চ সোমবার, ১৯৭১

আজ থেকে আমার নির্দেশ-
(১) বাংলার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত ট্যাক্স খাজনা বন্ধ রাখুন, (২) সমগ্র বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট-সরকারী-আধাসরকারী অফিস, সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্টে হরতাল করুন। (কোথাও শিথিল করা হইলে জাননো হইবে) (৩) রিক্সা, বেবী, বাস-ট্যাক্সী প্রভৃতি এবং রেলগাড়ী ও বন্দরসমূহ চালু রাখুন; কিন্তু জনগণের উপর জুলুম চালাইবার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের সঙ্গে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারীগণ সহযোগিতা করিবেন না এবং এক্ষেত্রে তাহাদের চলাচলের ব্যাপারে কোনো কিছু ঘটিলে আমি দায়ী হইবো না। (৪) বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র সেবীরা আমাদের বিবৃতি-বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করিবেন এবং গণআন্দোলনের কোনো খবর গায়েব করিবেন না। যদি তাহাতে বাধা দেওয়া হয়, তাহা হইলে এইসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালিরা কাজে যোগ দিবেন না। (৫) শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন। (৬) স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখুন। (৭) সকল গৃহশীর্ষে প্রতিদিন কালো পতাকা উত্তীর্ণ রাখুন। (৮) ব্যাংকসমূহ প্রতিদিন দুই ঘণ্টা খোলা রাখুন; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যেন পাচার না হয়। (৯) আংশিক বা সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা করা হইতে পারে, তজ্জন্য প্রস্তুত থাকুন। (১০) স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে অবিলম্বে বাংলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করুন। গতকাল (রোববার ৭ মার্চ) রমনা রেসকোর্সের উত্তাল জনসমুদ্রকে সাক্ষী রাখিয়া তুমুল করতালির মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবাসীর উদ্দেশ্যে উপরোক্ত ঘোষণা করেন। সূত্র- ইত্তেফাক  : ৮ মার্চ সোমবার, ১৯৭১

ঢাকা বেতার বন্ধ 
স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকা বেতারে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা রিলে না করার প্রতিবাদে এবং বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রচণ্ড দাবির মুখে ঢাকা বেতারে কর্মরত সকল বাঙালি কর্মচারীর সহযোগিতা না করার দরুন গতকাল (রবিবার ৭ মার্চ) সকাল হইতে ঢাকা বেতার বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ঢাকা বেতার বন্ধ হওয়ার তিন ঘণ্টা পর অর্থাৎ সন্ধ্যা ৭টায় বেতার ভবনের একটি আঙ্গিনায় হাতবোমা নিক্ষিপ্ত হয়। একটি চলমান জিপ হইতে উক্ত হাতবোমা নিক্ষিপ্ত হয়। বোমা বিস্ফোরণের ফলে কোনো জানমালের ক্ষতি হয় নাই বলিয়া সংশ্লিষ্ট মহল হইতে জানা গিয়াছে। 
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ রীলে করার জন্য গত কয়েকদিন যাবৎ বিভিন্ন মহল হইতে জোর দাবি উঠে এবং শেষ পর্যন্ত ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষ তাহার এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রিলে করার সিদ্ধান্ত বেতার মারফত ঘোষণা করিলেও শেষ মুহূর্তে উহা করা হয় নাই।
ঢাকা বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের রমনা রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ রীলে করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর এদেশব্যাপী শ্রোতাগণ অধীর আগ্রহে রেডিও সেট লইয়া অপেক্ষা করিতে থাকেন। বেলা ২টা ১০ মিনিট হইতে ৩টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা বেতারে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবের ভাষণ রীলে শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণে বিশেষ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ পরিবেশন ব্যতীতই ঢাকা বেতারের তৃতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। সূত্র- ইত্তেফাক  : ৮ মার্চ সোমবার, ১৯৭১ 

জেডএইচ/এসএমএম