• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৩, ২০১৮, ০৬:২১ পিএম

শীতে রোগব্যাধি : সতর্কতা ও করণীয়

শীতে রোগব্যাধি : সতর্কতা ও করণীয়

 

শীত জেঁকে বসেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই দেখা যায় প্রকৃতি কুয়াশাচ্ছন্ন। সবুজ ঘাসে জমে আছে বিন্দু বিন্দু শিশির। শীতকাল যেমন আনন্দের, তেমনি এটি নিয়ে আসে নানা রোগবালাই। এ সময় জমে ওঠে বাহারি পিঠাপুলির উৎসব, বনভোজনের আয়োজন, শীতের রঙিন পোশাক তো আছেই। সেই সঙ্গে শীতে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জন্য বেড়ে যায় সর্দি, কাশি, হাঁচির মতো নানা রোগের প্রকোপ। শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জিজনিত রোগের মাত্রাও বাড়ে এ সময়। এ অবস্থা সামাল দিতে শীতের সময় গরম কাপড় পরা এবং শীতল বাতাস এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। এ সময় আগুন পোহাতেও সতকর্তা অবলম্বনের পরামর্শ দেন তারা।

শীতের সময় আমাদের শরীরে রোগব্যাধি বাসা বাঁধার আগেই যদি সতর্ক হওয়া যায়, নেওয়া যায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তা হলে অনেক বড় রোগ তো দূরের কথা, নিয়মিত অসুখ-বিসুখও কাছে ভিড়তে পারে না। একটু সতর্কতাই আপনাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে বড় কোনো ব্যাধি থেকে। মানসিক, দৈহিক ও আত্মিক সুস্বাস্থ্য ধরে রাখাই একজন সচেতন মানুষের পরিচয়।

শীতের প্রধান রোগ শ্বাসতন্ত্রের রোগ। যদিও এ রোগের প্রধান কারণ ভাইরাস, তথাপি বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব এনজাইম আছে, তা স্বাভাবিকের চেয়ে কম তাপমাত্রায় কার্যকরী হয়ে ওঠে। ফলে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। শীতে বাতাসের তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে আর্দ্রতাও কমে যায়। যা আমাদের শ্বাসনালির স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে ভাইরাসের আক্রমণকে সহজ করে। এছাড়া ধূলাবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। ঠাণ্ডা, শুষ্ক বাতাস হাঁপানি রোগীর শ্বাসনালিকে সরু করে দেয়। ফলে হাঁপানির টান বাড়ে।

শীতের শুরুতে তাপমাত্রা যখন কমতে থাকে, তখনই সর্দি-কাশির প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ রোগের শুরুতে গলা ব্যথা, গলায় খুশখুশ ভাব ও শুকনা কাশি দেখা দেয়। নাক বন্ধ হয়ে যায়। নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে এবং ঘন ঘন হাঁচি আসে। হালকা জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়। এটা মূলত শ্বাসতন্ত্রের ওপর অংশের রোগ এবং সৌভাগ্য হলো, এ রোগ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। 

যদি প্রতিরোধের চেষ্টা সত্ত্বেও সর্দি-কাশি দেখা দেয়, তবু প্রতিরোধের উপায়গুলো চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিহিসটামিন-জাতীয় ওষুধ খেলেই যথেষ্ট। এটা শুধু রোগের তীব্রতাকে কমাবে না, রোগের বিস্তারও কমিয়ে দেয়। মধু, আদা, তুলসী পাতা, কালিজিরা ইত্যাদি রোগের উপসর্গকে কমাতে সাহায্য করে।

হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এ রোগ আবার আরেকজনে ছড়ায়। তাই এ রোগ যাতে অন্যদের আক্রান্ত করতে না পারে, সে লক্ষ্যে আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত বাসায় থাকাই ভালো। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রী যারা আক্রান্ত, তাদের অবশ্যই বাসায় রাখতে হবে। নেহায়েত বাইরে যেতে হলে মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে।

শীতে ইনফ্লুয়েঞ্জাও দেখা যায়। এ রোগটি মূলত ভাইরাসজনিত। ঠাণ্ডার অন্যান্য উপসর্গ ছাড়াও এ রোগের ক্ষেত্রে জ্বর ও কাশিটা খুব বেশি হয় এবং শ্বাসকষ্টও হতে পারে। এছাড়া ভাইরাসে আক্রান্ত দেহের দুর্বলতার সুযোগে অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াও আক্রমণ করে থাকে। বিশেষ করে নাকের সর্দি খুব ঘন হয় বা কাশির সঙ্গে হলুদাভ কফ আসে। এ রোগেরও তেমন কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। শুধু ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলেই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়।

শীতের প্রকোপে শুধু ফুসফুস নয়- সাইনাস, কান ও টনসিলের প্রদাহও বাড়ে। যেমন- ঘন ঘন সাইনাসাইটিস, টনসিলাইটিস, অটাইটিস ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে চিকিৎসা নেয়াই ভালো। যাদের হাঁপানি বা অনেক দিনের কাশির সমস্যা, যেমন ব্রঙ্কাইটিস- ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় তাদের কষ্টও বাড়ে। নিউমোনিয়াও এ সময় প্রচুর দেখা দেয়। বলা চলে, শীতে অসুখের মূল ধাক্কাটা যায় শ্বাসতন্ত্রের ওপরই। এসব রোগে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি বাড়ে নবজাতক, শিশু, বৃদ্ধ হাঁপানি রোগী ও ধূমপায়ীদের।

ঠাণ্ডা ও হাঁপানি প্রতিরোধে করণীয়
১. ঠাণ্ডা খাবার ও পানীয় পরিহার করা; ২. কুসুম কুসুম গরম পানি পান করা ভালো, হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা উচিত; ৩. প্রয়োজনমতো গরম কাপড় পরা, তীব্র শীতের সময় কানঢাকা টুপি পরা এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করা; ৪. ধুলাবালি এড়িয়ে চলা; ৫. ধূমপান পরিহার করা; ৬. ঘরের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ না রেখে মুক্ত ও নির্মল বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা; ৭. হাঁপানির রোগীরা শীত শুরুর আগেই চিকিৎসকের পরামর্শমতো প্রতিরোধমূলক ইনহেলার বা অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন। ৮. যাদের অনেক দিনের শ্বাসজনিত কষ্ট আছে, তাদের ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোক্কাস নিউমোনিয়ার টিকা নেওয়া উচিত। ৯. তাজা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা, যা দেহকে সতেজ রাখবে এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। ১০. হাত ধোয়ার অভ্যাস করা, বিশেষ করে চোখ বা নাক মোছার পরপর হাত ধোয়া।

শীতে অন্যান্য রোগ
কাশির মতো প্রকট না হলেও শীতে আরও অনেক রোগেরই প্রকোপ বেড়ে যায়। যেমন-

 আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা। মূলত বয়স্কদেরই এ সমস্যা বেশি হয়। যারা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিও আর্থ্রসিস রোগে ভোগেন- তাদের বেলায় এ সমস্যাটা আরও প্রকট হয়। 

 শীতের শুষ্কতায় অনেকের ত্বক আরও শুষ্ক হয়, ত্বক ফেটে যায় এবং চর্মরোগ দেখা দেয়। যেমন- একজিমা, চুলকানি, স্ক্যাবিস ইত্যাদি। তাই শীতকালে ত্বকের বাড়তি যত্নের প্রয়োজন। 

 কিছু কিছু রোগে তীব্র শীতে অনেকের হাতের আঙুল নীল হয়ে যায়। তাদের অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করবেন যেন কোনোভাবেই ঠাণ্ডা না লাগে।

 ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় রক্তচাপ বাড়তে পারে। ঠাণ্ডার ওষুধে সিউডোএফেড্রিন বা ফিনাইলেফ্রিন-জাতীয় ওষুধ রক্তচাপ বাড়ায়। শীত তীব্র হলে হৃদযন্ত্রের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্টঅ্যাটাকও হতে পারে।

 শীতের আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হাইপোথার্মিয়া, অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়া, যা মৃত্যুও ঘটাতে পারে। মূলত যারা পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র ব্যবহার করে না এবং শিশু বয়োবৃদ্ধ যারা নিজেদের যত্ন নিতে অপারগ, তারাই এর শিকার হয় বেশি।

 ছোট বাচ্চাদের সর্দি-কাশির সাথে সাথে ডায়রিয়াজনিত রোগও বাড়তে পারে। কারণ এ সময় রোটা ভাইরাসের আক্রমণ বেড়ে যায়।

সতর্কতা
রোগের প্রতিষেধক অপেক্ষা প্রতিরোধ করাই বেশি দরকার। ঠাণ্ডাজনিত রোগগুলো যেন না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। শীতে স্বভাবত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সেজন্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ জরুরি। সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হলে অন্যদের সঙ্গে মেলামেশায় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। হাঁচি দেয়ার সময় বা নাকের পানি মুছতে রুমাল বা টিস্যুপেপার ব্যবহার জরুরি এবং সেটি নির্দিষ্ট একটি জায়গায় রাখতে হবে। এরপর অ্যান্টিসেফটিক বা জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। যেখানে-সেখানে কফ, থুথু বা নাকের শ্লেষ্মা ফেলা যাবে না। বাইরে বের হওয়ার সময় স্কার্ফ বা মাফলার দিয়ে মাথা, কান ও নাক ঢেকে রাখা, হাতে ও পায়ে মোজা ব্যবহার করা প্রয়োজন। কোনো খাবারে যদি এ্যালার্জি থাকে, তবে সেটি এড়িয়ে চলতে হবে।শীতের কাপড় গরম পানিতে সিদ্ধ করে জীবণুমুক্ত করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, সব শীতে যে রোগব্যাধি বাড়বে, তাও সত্য নয়। সাধারণত শীতকালে মানুষের রোগ কম হয়। তাই বাড়তি সতর্কতার পাশাপাশি অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

এমজি