• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০১৯, ০৫:৩৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৭, ২০১৯, ০১:০৩ এএম

গল্প

আছিরুন কিংবা দুঃখনামা

আছিরুন কিংবা দুঃখনামা

১.
ওই যে দূরের এক গাঁয়ে, ওই যেখানে পানকৌড়ি টুপ করে ডুব দিয়ে ওঠে। ডাহুক ডেকে যায় কি ব্যথায় গভীর রাতে, রাখাল সাঁঝের বেলায় হাট্ হাট্ শব্দ করে দ্রুত পায়ে গরু নিয়ে গোয়ালের দিকে ছোটে। কুররু রুম ক্রুক বলে সোহাগী সাদা কবুতরগুলো দেমাগী সুখে ডানা ঝাপটায়, যেখানে বেগুনী জারুল ফোটে বসন্ত কালে। যেখানে দুপুর রোদে গা ভেজায় কামরাঙা আর ডালিম ফল, হু সেই গাঁয়ের নাম নবীপুর।

নবীপুর হবিগঞ্জের এক অনামা ছোট্ট গ্রাম। একটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই সেখানে। সে গ্রামে মানুষেরা তখনো আটপৌরে জীবন যাপন করে, এখনকার মতো মোবাইল কিংবা অন্তর্জালে আসক্ত হয়নি। সেখানে তখনো বাস করতো ছমিরন, আইতুন, আকিকুন নামের মেয়েরা। সেখানে শরতের ভোরে শিশির স্নাত কচি নরম ঘাসে নিশব্দে শিউলি ফুল ঝরে পরে টুপটাপ। নদীতে মাঝিরা নাও ভাসিয়ে চলে যায় কতো কতো দূরের গন্তব্যে। সে গাঁয়ে শান্ত শীতল সবুজের সমারোহে বড় হতে থাকে একটা প্রান।

ওই গ্রামে বছর বছর গাভী যেমন বিয়ায় তেমনি বছর না ঘুরতেই পোয়াতী হয় নছিমন বানু। এক, দুই , তিন গুনে গুনে একদম গুনে গুনে গাভীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেও বিয়ায় বাচ্চা। বিয়ের সাত বছরে পঞ্চমত বার গর্ভবতী হলে তেইশ বছরের শরীরটা আর পেরে ওঠে না। ঝিমায় নছিমন সারাদিন, কাহিল কাহিল সন্ধ্যা সকাল গুলো তবু পার করতে হয় কখনো ধান ভেনে কিংবা গরুর গামলায় ভুষি ভিজিয়ে। আবার লাকড়ির চুলায় ঝাঁঝালো আঁচের সঙ্গে থেকে থেকে নছিমনের নিজেকে মনে হতে থাকে আগুন নয়তো পোড়া লাকড়ির কয়লা।


২.

তখন শ্রাবণমাস, আটমাসের ভারী শরীর নছিমনের, বিয়ানবেলা থেকেই আসমান আন্ধার করে ঝর ঝর বৃষ্টি ঝরছে। রোদ ওঠার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বেহায়া বৃষ্টি ঝরছেই অবিশ্রাম। হাম ম্ ম্বা আ, ম্যা হে হে হে হে হে শব্দে নছিমনের দুটো গরু আর তিনটে ছাগল কাঁদছে ক্ষুধায়। ওর বাচ্চা চারজন ছয়, চার, তিন ও দুই বছরের, ঘরেই রাখা পান্তা খেয়ে শান্ত মেজাজে আছে। হউরি ডিম ভাজা দিয়ে পান্তা খাবে, পাকের ঘরটা মূল ঘরে থেকে বেশ একটু দূরে এই বৃষ্টিতে চুলা ধরাবে কি করে ?

বুড়া হউরি বক্ বক্ করে চলেছে আপন মনে বৃষ্টির তালে তালে তেমনি অঝোরে। ‘নুডির গরও নুডি মাঙডার গরও মাঙডা অহনও আন্ডা বাজে না ক্যারে আমার লাগি? হিদা গেলেগা গো হাইতাম না ত দেরি অইলে। তুই হাইবি নুডি মাগী, নাইলে আন্ডা বাজি গোয়ার ভিত্তে হান্দায়া দিমু। আমারে অহনও চিনছস না নুডির ঝি’। এই গালিটা দেবার পর নছিমনের জেদ চেপে যায়, যতো খুশি গাইল পাডুক কিন্তু মা বাবা তুলে বকলে মাথায় চাই করে রক্ত উঠে যায়।

গোবেচারা স্বামীটা নিজের বৃদ্ধ মাকে কিছু বলতে পারেনা, অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পোয়াতি বউয়ের দিকে। এবার নছিমন ভারী শরীরটাকে নিয়ে চলে পাকের ঘরের দিকে। পা ফেলে সাবধানে, পিছলে না যায় আবার। ইস্ শেষ রক্ষা কি হয় ! ছপাত প্যাকের মধ্যে পা পড়ে আর অমনি সরাৎ করে পিছলে যায় নছিমন, বুঝে ওঠার আগেই বহু দূরে ছিটকে গিয়ে কোমরে ব্যথা পায়। চিৎকার দিতে দিতে ‘আল্লাগো ......ও আল্লা’ বলে জালালী দোয়া পড়া শুরু করে লা ইলা হা বলা শেষ না হতেই জ্ঞান হারায়।


 ৩.

লন্ড ভন্ড হয়ে যায় সবকিছু, সব। নছিমন আছরে পড়ে কোমরে আঘাত পাবার পর পরই পেটের পানি ভেঙ্গে যায়, ঝপাৎ করে এক কলস মতো পানি আচানক বেরিয়ে আসে পেশাবের রাস্তা দিয়ে। সুরুজ মিয়া চিৎকার শোনার সাথে সাথে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে।লম্বা কদম ফেলে মুহূর্তের মধ্যে পাঁজা কোলা করে তুলে আনে কর্দমাক্ত এবং স্রাব মিশ্রিত ভেজা নছিমনকে। নছি ও নছি বলে ডাকলে একটু সাড়া পায় বউটার। শুধু বলে ‘দাইরে খবর দেও ব্যাদনা উঠছে, বলেই আবার কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে যায় নছিমন।

‘এমুন কু আলামত ‘ দেখে নছিমনের হউরি অজিফা বেওয়া নিশ্চুপ হয়ে যায়। একটু আগে খিদার জ্বালায় বউটাকে কতোই না গাইল দিলো এখন মায়া লাগছে বউটার জন্য। ঘন আঁধার মেঘে ঢাকা আকাশটার রোদন কমলো তখন দুপুর সময়টায়, বিলম্ব করেনি এক্কেবারে এক ছুটে দাইকে নিয়ে বাড়ী পৌঁছে যায় সুরুজ মিয়া। দাইয়ের নাম বেঙ্গির মা, বায়না হয়েছে টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে সময়টা যখন কুজ্ঝটিকাময়। গামলা ভরা গরম পানি , পরিষ্কার কাপড় আর নতুন ব্লেড নিয়ে ছটি ঘরে ঢুকে যায় বেঙ্গির মা ও নছিমন।

ধড়াম ধড়াম বাজের আওয়াজ আর ফরৎ ফরৎ বিদ্যুতের চমক হচ্ছিলো একটু পর পর বাচ্চাগুলো ভয়ে গুটি সুটি হয়ে দাদীর পাশে বসে আছে, অজিফা বেওয়া ততক্ষনে তসবিহ পড়তে শুরু করেছেন। আবার আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো সেই গ্রামে। অধৈর্য নিয়ে তবু ট্যাকার কারনে অপেক্ষমান দাই, ছটফট ছটফট ব্যথাকাতর নছিমনের চিৎকার সুরুজ মিয়ার মনটাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখছিলো। সন্ধ্যা ঘনায় যখন তখন বৃষ্টিটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। ক্ষুধার্ত ও শুষ্ক ওদের সকলের মুখ টিমটিমে কুপির আলোয় আরো ম্লান দেখায়। সে বাড়ীটায় শুধু শোনা যায় বেঙ্গির মায়ের ধমকা ধমকি ‘চিল্লাইও না বেটি চিল্লাইও না, কোঁত দেও আরো জোড়ে কোঁত দেও’

 


৪.

জীবন কতোটা যন্ত্রনার এবং নিষ্ঠুর, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়াটা যে আজন্ম লব্ধ পাপ, সেটা জানার জন্য এক স্যাঁত স্যাঁতে ভর সন্ধ্যারাতে ভূমিষ্ঠ হলো আছিরুন। হায় নছিমনের রক্তপ্রবাহ আর তো বন্ধ হয় না! বেঙ্গির মা উঁচু কন্ঠে ডাকতে থাকে ছটি ঘর থেকে ‘ও সুরুজ মিয়া সুরুজ মিয়া, তোমার বউয়ের অবস্থা বেগতিক গো!’ জলদি সদরে নিতে হইবো নাইলে শ্যাষ! ‘ক্যামনে নিবো এতো জলদি?’ ভেবে সুরুজ মিয়া অকুল পাথারে পড়ে, হিচকি তুলে কাঁদতে থাকে। নছিমনকে বুঝি আর বাঁচানো গেলো না।

আছিরুন মাকে হারায় ভূমিষ্ঠ হবার পর পরই। যথা সময়ের আগে চলে আসার কারনে বুদ্ধি বা হাঁটা চলা কিছুই সময় মতো হয়নি ওর। বাড়ীর সবার ছোট হওয়া স্বত্তেও মেয়েটা বড্ড অবহেলা অযত্নে বড় হতে থাকে। কিছু পেতে চাইলেই ওর ভাগ্যে জোটে গাল মন্দ। প্রতিবন্ধী বলে ওকে ডাকে সবাই ‘ব্যাহা’ বলে। চর থাপ্পরকে আছিরুন বোঝে তো খুবই স্বাভাবিক আচরন হিসেবে। এমনই তো হয় কিছু চাইলে তাই কাঁদে না মেয়েটা। কতো না পুতুল পেতে চায়, একটা সুন্দর জামা পেতে চায়, বড় ভাই বোনদের ছেড়া কাপড়গুলো ওর জন্য বরাদ্দ থাকে বছরকে বছর। খাবার জোটে উচ্ছিষ্ট আর এঁটো, বড়জোর সকালের পান্তাটা আর সবার মতো।

নছিমনের মৃত্যুর পর বছর না পেরোতেই সুরুজ মিয়া সাঙ্গা করে আরেক গরীব ঘরের মেয়ে হাওয়া বিবিকে। হাওয়া বিবির কোলে আসে আরো দুই সন্তান। অথর্ব আছিরুনের প্রতি সদা নির্দয় থাকে হাওয়া বিবি, দুইচোক্ষে সহ্য করতে পারে না ওকে। কোন কারন ছাড়াই গায়ে হাত তোলে, পারে না শুধু একেবারে মেরে ফেলতে। আছিরুন স্কুলে যায় না সারাদিন বাড়ী থাকে আর প্রতিক্ষনে নিগৃহীত হয়, ওই ক্ষনে লাথ্থি তো পরক্ষনে কিল থাপ্পর। কেউ কখনো আদর করেনা আছিরুনকে কখনোই না।

৫.

ফাতেমা বিনতে রফিক, সুন্দরী, উচ্ছ্বল আর প্রাণশক্তিতে ভরা এক মেয়ে যে সদ্য এম বি বি এস পাশ করেছে। মনের ভেতরে স্বপ্ন সীমাহীন। কেবল প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে, প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ের পরিকল্পনাও চলছে তখন। তেমনি এক স্বপ্নঘোরের কালে এক সকালে চোখে কাজল পরে আর ঠোঁটে হাল্কা রংয়ের লিপষ্টিক বুলিয়ে গেলো সার্জারির বার্ন ইউনিটে। তখন আতিকুর রহমান স্যারের অধীনে কাজ করে মেয়েটি। খুব মায়াবী মানুষ, নিজের কাজে ভীষণ মনোযোগী। রোগীর সেবায় কোনো কার্পণ্য নেই ফাতেমার।

বার্ন ইউনিটে কঠিন একটা রোগী এসেছে নার্সের কাছে জানতে পারে ডাক্তার ফাতেমা। আতিক স্যারের বিশেষ স্নেহভাজন বলে এবং ফাতেমার দায়িত্বশীলতার ওপর স্যারের খুব আস্থা আছে বলেই সে ড্রেসিংয়ের দায়িত্ব পায় একটা কঠিনভাবে আগুনে পোড়া রোগীর। নাম, বয়েস কিছুই জানতো না ফাতেমা। শুধু আতিক স্যারের এক কথায় দৌড়ে যায় ফাতেমা বারো নম্বর বেডের দিকে। স্যার বললেন যাও মেয়ে নিজেকে প্রমান করো আরেকবার যে তুমি পারো।

ডাক্তার ফাতেমা জানতো না সারাজীবনের জন্য একটা গ্লানি বোধ ওকে তাড়া করে ফিরবে সেদিনের পর থেকে। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে কাছে যায় ফাতেমা জানতে চায় রোগীর নাম পরিচয়, কি ঘটেছিলো কবে ঘটেছিলো এই দূর্ঘটনা। শীর্নকায়, ফ্যাকাশে শাদা গাত্র বর্নের এক মেয়ে ক্লান্তি আর ব্যাথায় নুয়ে পড়া দুচোখ মেলে তাকায় ওর দিকে। নাম কি তোমার মেয়ে বলতেই ক্ষীন ফ্যাশ ফ্যাশে কন্ঠে উত্তর দেয় ‘আফা আমার নাম আছিরুন বাড়ী নবীপুর’। আফা আমারে বালা কইরা দেউ, যে বেদনা করে আফা গো। দিবাইনি আফা বালা কইরা? 
আছিরুন কিংবা দুঃখনামা

 ৬.

আছিরুনের শরীরের ওপর থেকে হাসপাতালের শাদা চাদরটা সরানো মাত্রই কি দেখে ফাতেমা! এতোটা বিভৎস এতোটা দগ্ধ শরীর নিয়ে মেয়েটা কি করে বেঁচে আছে ! একদম কোমড় থেকে পায়ের পাতা অব্দি ঝলসে যাওয়া শরীরের অংশটায় একটুও চামড়ার অস্তিত্ব নেই। হলদেটে শাদা থিকথিকে ঘা হয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়, প্রচন্ড দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ঘা থেকে। কুঁকড়ে গেছে শরীরের নীচের অনেকটা অংশ, একটুখানি নড়া চড়া করতে পারছিলো মেয়েটা তবু। এমনকি বা পায়ের পাতায় গর্ত মতো হয়ে ঘিনঘিনে ম্যাগোটও জন্মেছে ইস্! ক্যামন করে ঘটলো ফাতেমা জানতে চাইলে গ্যাঁ গ্যাঁ গ্যাঁ শব্দ করে কাঁদছিলো, জবাব দেয়নি।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় ফাতেমা বুঝতে পারছিলো না ক্যামন করে শুরু করবে আছিরুনের চিকিৎসা? মনেও জোড় পাচ্ছিলো না, মনে হচ্ছিলো সে গুটিয়ে যাচ্ছে নিজেরই ভেতরে। মনে জোড় যে রাখতেই হয়, ডাক্তারকে শক্ত থাকতে হয়। ভেতরে দলা পাকানো কান্নাটাকে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বের করে দিয়ে এক ছুটে আতিক স্যারকে ডেকে আনে। ‘স্যার আপনার অপিনিয়ন দরকার’ । আতিক স্যার দেখে বলেন ‘কেইস জটিল বেশি রিকভার তো হবে না, যতটুকু পারো ড্রেসিং করো ইনফেকশনটা যেনো না ছড়ায় আর কনট্রাকচার যেনো না বাড়ে খেয়াল রাখো’।

ডাক্তার ফাতেমা বিনতে রফিক শক্ত হাতে সকল প্রস্তুতি নিয়ে ধীরে ধীরে শুরু করে কাজ। আছিরুন বলেই না কি ঘটেছিলো, শুধু কাঁদে শুধুই কাঁদে । ফাতেমা প্রতিদিন দুবেলা ড্রেসিং করে, আস্তে আস্তে শোয়া থেকে বসানোর ট্রেনিং দিতে থাকে। আর একটু একটু করে আছিরুন নিজের গল্প বলা শুরু করে। তৃতীয়দিন বিকেলের ড্রেসিংয়ে আছিরুনকে আবার জিজ্ঞেস করে ফাতেমা, এবার চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে খুব ফিশ ফিশ করে বলে আফা গো হুনবাই তুমি। আছিরুনের জবাবটা শুনে নিজেকে আর সংবরন করতে পারেনা, ফাতেমা কাঁদে আছিরুনও কাঁদে।


 ৭.

অগ্রহায়ন মাস, শুকনো শুনশান এক সকালে সবাই যখন বাড়ীর বাইরে, উঠোনে পক্ পক্ ঘুরে বেড়াচ্ছিলো মুরগি মা আর তার মায়াবী হলদে ছানাগুলো। তখন তাকে পাকের ঘরে নিয়ে ‘আতকা গায়ে কেরাসিন ঢাইল্লা আগুন লাগায়া দেয়’ কে ? ‘ব্যাহা মাইয়া কেউ শাদী করবো না, বহায় বহায় বাত দিতো কে? কেউ না গো, মইরা গেলে তো অতো চিন্তা করন লাগেনা’। সৎমা ঠান্ডা মাথায় এ কথা বলতে বলতে ওর গায়ে সপৎ আগুন ধরিয়ে দেয়। এ কথা শুনে ক্রোধে ও কষ্টে নিজেকে সামলে নিতে পারে না ফাতেমা দ্রুত হোষ্টেলে ফিরে যায় সেদিন। মানুষ এতো নির্দয় হয় ভেবে কূল খুঁজে পায় না! সেদিন থেকে জীবনবোধ অনেক পাল্টে যায় ফাতেমার।

আছিরুনের তবু মরণ হয় নাই। সেদিন ওর বিকট চিৎকারে প্রতিবেশিরা ছুটে এসে আগুন নেভায়। কোনো চিকিৎসা পায়নি, বাড়িতেই ফেলে রাখা হয়েছিলো আছিরুনকে কতগুলো দিন। ওর ক্রমাগত ক্রন্দনে শেষমেষ সুরুজ মিয়া হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে এলে ওখানকার সিভিল সার্জন বলেন এ রোগীর চিকিৎসা এখানে হবে না। তাই সেখান থেকে সিলেট ওসমানীতে নিয়ে আসা হয় মৃতপ্রায় আছিরুনকে। আছিরুনদের নিয়তি এমনই ক্রুর বাস্তবতার নির্দয় সত্যর সুতোয় বোনা আজন্ম দুঃখের নকশীকাঁথা।

আছিরুনের সেরে ওঠা এবং পূর্নবাসন নিয়ে অনেক কিছু ভেবে পরদিন ওয়ার্ডে এলে আর কোথাও খুঁজে পায় না ফাতেমা মেয়েটাকে। নেই তো নেই! নার্সকে জিজ্ঞেস করলে ডিসচার্জ শিটটি এনে দেয় আর সাথে মুচলেকাটিতে লেখা ছিলো ‘রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন জানিবা স্বত্তেও নিজ দায়িত্বে নিয়া গেলাম’ স্বাক্ষর করা নাম হাওয়া বিবি। পুলিশ কেইস হতে পারে তাই আগেই রোগী নিয়ে ভেগে গেছে ওরা। মরবেই তো আছিরুন তবে ধুকবে, কতোটা ব্যথায় কাতরাবে মরার আগে ভেবে শিউরে ওঠে ফাতেমা। বুকের মধ্যে চাপা কষ্টটা আজ অব্দি তাড়া করে, কোনো একলা ক্ষনে ফাতেমা এখনও মনে মনে বলে আছিরুনরে বোন আমার ক্ষমা করে দিস এই অপারগ আমাকে।