শহরের এপাশটা একেবারেই অন্যরকম। এমন ব্যস্ত শহরেও যে এত নির্জন কোন এলাকা থাকতে পারে ভাবাই যায় না। অবশ্য এমনই কথা ছিল। সময় খারাপ। শহরের প্রানকেন্দ্রে আর যাই হোক আত্মগোপন করার ঝুঁকি নেয়া যায় না। একটু দূরে একটা হাইওয়ে দেখা যাচ্ছে। তার মানে এলাকাটা শহরের বাইরে কিন্তু খুব বেশি দূরে নয়।
তানজিমের সাথে এমনই কথা ছিল। এই ফ্ল্যাটে আসার দুদিন পরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রাজিব। ভালো লাগছে। গত দুদিন মরার মত ঘুমিয়েছে। এত ক্লান্ত কোনদিন বোধ করেনি। এখন সকাল ৭ টা। বাতাস এখনও কিছুটা ঠাণ্ডা। এক কাপ কফি বানিয়ে কাঠের চেয়ারটাতে বসল ও। আশেপাশে কয়েকটা উঁচু দালান। নিচে বড় একটা বস্তি। কর্মজীবী মানুষের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। সবাই ছুটছে। স্কুল, কলেজ, চাকরি, ব্যবসা। একটা বড় অংশের মানুষ ছুটছে গার্মেন্টসে। রিক্সা, গাড়ি, মটর সাইকেল এর শব্দ। প্রায় পাঁচ বছর পরে এবার দেশে এসেছে রাজিব। মনে হচ্ছে এই পাঁচ বছরেই শহরটা অনেক বেশি অস্থির হয়ে গেছে। অচেনা লাগছে। অথচ এই শহরের এক ব্যস্ততম প্রান্তে জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা ওর। শৈশবটা হঠাৎ করেই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। মধুর, মায়াবী, স্বপ্নিল শৈশব! ভালবাসায় ভরা ছোট্ট একটা পরিবার। বাবা-মা-আর ছোট বোন। ভালোবাসা, মায়া, খুনসুটি সব ছিল। প্রাচুর্য ছিল না, তবে অর্থের অভাবও ছিল না সে অর্থে। যতটুকু ছিল তা পূরণ হয়ে যেতো ভালবাসায়। ছবির মত একটা পরিবার।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ও। সম্বিৎ ফিরল একটা ছোট বাচ্চার চিৎকারে। পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দৌড়ে এল একটা ছোট বাচ্চা। বয়স দুইএর মত হবে। জোরে জোরে হাসছে। প্রাণখোলা, নিষ্পাপ হাসি। পেছনে আসলো মা। মাই হবে হয়তো।
“চলো খাওয়া শেষ করবে, চলো”।
“না” হাসতে থাকে বাচ্চাটা-
“না। যেতে হবে। “ জোর করে মা।
বাচ্চাটার হাসি আরও বেড়ে যায়। বারান্দার গ্রিল শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ছেলেটা। মা টানাটানি করে। হঠাৎ মেয়েটার চোখ পড়ে রাজিবের দিকে। অস্বস্তিতে পড়ে যায়। রাজিবও বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। এটা অন্য কোন দেশ না যে অপরিচিত কোন মেয়েকে ‘হ্যালো’ বলবে। ও একটু হাসে। মেয়েটাও অস্পষ্ট ভাবে হাসার চেষ্টা করে। তারপর জোর করে ছেলেটাকে নিয়ে যায় ভেতরে। আর তখনি অবন্তির কথা মনে পড়ে যায় ওর। প্রায় বছর তিনেক হল ওর বিয়ে হয়েছে। স্বামী ব্যাংকার। একটা বাবু হয়েছে ওর; ছেলে। ভালো আছে। রাজিবকে প্রচন্ড ঘৃণা করে। এই খবরগুলো রাজিব কখনও কষ্ট করে যোগাড় করেনি। ওর বন্ধুরাই জানায় ওকে ফেইসবুকে। ওদের অনেক আগ্রহ।
রাজিব আরও কিছুক্ষন বারান্দায় বসলো। রোদের তাপ বাড়ছে। যখন ভাবছে উঠে যাবে তখনই ফোনটা এলো। তানজিমের দেয়া ফোন। নাম্বারটা শুধু ওই জানে।
- হ্যালো
- হ্যালো। ভাইয়া।
- বল।
- সব ঠিকঠাক?
- হু।
- নাশতা করেছেন?
- না। এইতো উঠলাম।
- বুয়া আসছিল?
- না।
- আসবে। টেনশন কইরেন না।
- ওকে।
- ও হ্যাঁ। ভাইয়া। উনাকে আপনার এই নাম্বারটা দিয়েছি। যদি এমারজেন্সিতে লাগে।
- কাকে? বুয়াকে?
- আরে না। উনাকে। মানে যিনি আপনার কাজটা করছেন।
- ঠিক আছে। উনার নাম কি?
- উনাদের তো কোন নাম হয় না। মানে আসল নাম বলে না। আপনাকে উনার নাম বলবে আসাদ।
- ঠিক আছে। তুমি সাবধানে আছে তো?
- আমাকে নিয়ে টেনশন কইরেন না। আচ্ছা রাখি। আপনার প্রয়োজনীয় সবজিনিস সময়মত পৌঁছে যাবে। তারপরেও কিছু লাগলে জানাবেন।
- আচ্ছা।
- তাহলে রাখি। বেশিক্ষন কথা বলা ঠিক হবে না।
- রাখো।
ফোন রেখে ড্রইং রুমে এসে বসে রাজিব। একটু খটকা লাগছে! তানজিমকে কি বিশ্বাস করা ঠিক হচ্ছে? তিন দিন হয়ে যাচ্ছে। কোন খবর নাই। অথচ সবকিছু ঠিক করেই দেশে এসেছে সে। দুই দিনেই হয়ে যাওয়ার কথা। ঘটনাটা ঘটার সময় দেশে থাকতে চেয়েছিল ও। এটাই হয়তো ভুল হয়ে গেল! তানজিমকেও বেশি দিন চেনে না। ওর কাজিনের বন্ধু। তারপর বিদেশ থেকেই যোগাযোগ। যদি তানজিম ওকে প্রতারিত করে? ওকে ফাঁসিয়ে দেয়? কাজ হোক বা না হোক ওকে ফিরতেই হবে। যেকোনো মুল্যে। বারটি বছর ধরে বুকের মধ্যে যে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে তার অবসান চায় সে। তাই বলে বারটি বছর ধরে বিদেশের মাটিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিলে তিলে যে জীবন, যে ক্যারিয়ার সে গড়ে তুলেছে তাতো ধ্বংস করে দিতে পারে না।
সে রাতে ঘুম হল না একফোঁটাও। অনেক চেষ্টা করল রাজিব ঘুমানোর। একসময় বইও পড়তে চেষ্টা করল। ভালো লাগলো না।বড় চাঁদ উঠেছিল। পূর্ণিমা ছিল কি? অবন্তি পূর্ণিমার খবর রাখতো। ফোন করে জানাত পর্যন্ত। ও ছিল প্রকৃতি প্রেমিক। আচ্ছা, ও কি এখনও পূর্ণিমা ভালবাসে? পূর্ণিমা রাতে স্বামীর হাত ধরে চাঁদ দেখে? রাত একটা। চাঁদের আলো তেরছা হয়ে বিছানায় এসে পড়েছে। রাজিব বারান্দায় এসে বসে একটা সিগারেট ধরাল। প্যাকেটে দুইটা অবশিষ্ট। রাত কাটবে কিভাবে? তানজিম কে সিগারেট পাঠাতে বলা উচিত ছিল। চাঁদের আলোয় চারপাশ সয়লাব। যেন রাত না, দিন। রাস্তায় মানুষজন কমে গেছে। দুই-একটা রিক্সায় মানুষ ঘরে ফিরছে। পরিশ্রান্ত নগরবাসী ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেছে। ভোর হলেই দৌড়াতে হবে জীবিকার খোঁজে। রাজিবের মনে হল মানুষগুলো কত সুখী! চাইলেই ঘুমাতে পারে। আজ বারটি বছর সে একটি রাতেও আরাম করে ঘুমায়নি। প্রতিটি রাতেই একই দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করেছে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরে যখন ওর রুমমেটটা অকাতরে ঘুমিয়েছে তখন ওর চোখে ভেসেছে কয়েকটা মুখ। ওর মা, বাবা আর অবন্তির মুখ। আর একটা মুখ। ভয়ংকর একটা মুখ। যে মুখটা চোখের সামনে এলেই রাজিবের সারা শরীর কাঁপতে থাকে। সে মুখটি গাল কাটা বাবুর।
কিছুক্ষণ পরে উঠল রাজিব। ঘরের বাতি বন্ধ করে বিছানায় এলিয়ে দিল শরীর। ঘুম এলো। আর এলো সে দুঃস্বপ্নটাও। রাজিবদের বাড়ীর কাছের একটা রাস্তা। রাত ১১ বা কিছু বেশি। ওর বাবাকে ধাওয়া করেছে গাল কাটা বাবুর কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ। উনি প্রানভয়ে দউরাচ্ছেন আর চিৎকার করে রাজিবকে ডাকছেন। পাশের একটা গলি থেকে রাজিব এলো। দউরাচ্ছে বাবার পিছে। ওর পিছে অবন্তি। হাতে একগুচ্ছ কাশফুল। রাজিবের বাবা হোঁচট খেয়ে পড়ে যান একটা চায়ের দোকানের সামনে। তাকে ঘিরে ধরে সন্ত্রাসিরা। এরপরে কোত্থেকে যেন কাটা বাবু আসে আর ছুরিকাঘাত করতে থাকে বুকে-পিঠে। গগনবিদারি চিৎকার করে রাজিবের বাবা। চিৎকার করে ওঠে রাজিব। ঝাপিয়ে পরে বাবার বুকে। চিৎকার করে অবন্তি। প্রায় প্রতি রাতের মত আজও চিৎকার করে ঘুম ভাঙে রাজিবের। সারা শরীর ঘেমে-নেয়ে গেছে। বুক জোরে জোরে ওঠানামা করছে। উঠে বাতি জ্বালায়। রাত তিনটা সাইত্রিশ। একই স্বপ্ন সে দেখে যাচ্ছে বছরের পর বছর। অথচ যে রাতে ওর বাবা খুন হন, সে রাতে ও ঢাকায় ছিল না; কয়েকে বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়েছিল অবন্তিদের গ্রামের বাড়িতে। একদিন বিকালে বেড়াতে বের হয়ে ওকে দিয়েছিল একগুচ্ছ কাশফুল।
পরপর দুইগ্লাস পানি খায় রাজিব। টি-শার্টটা পাল্টায়। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে।টিভি চালু করে দেখার চেষ্টা করে। ভালো লাগে না। সোফাতেই আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। একসময় তন্দ্রার মত আসে আর তখন রাতের দ্বিতীয় স্বপ্নটা দেখে সে।
গ্রাম। একটা নদী। নদীর পাড়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে রাজিব, অবন্তি আর পাশের ফ্লাটের সেই বাচ্চাটা। পূর্ণিমা রাত। চাঁদের আলোয় চারপাশ মাখামাখি। অবন্তির পরনে কালো রঙের একটা শাড়ি। কালোর উপরে শাদা জরির কাজ। ওর জন্মদিনে রাজিব দিয়েছিল ওকে। বাচ্চাটা রাজিবকে বলে,
- বাবা, বলতো এখন দিন না রাত?
- রাত।
- হয়নি। বলেই খিল খিল করে হাসতে থাকে বাচ্চাটা।
- কেন হয়নি?
- কারণ, দেখ কত আলো। দিনের মত আলো। তাই এখন দিন।
- হেসে লুটপুটি খায় বাচ্চাটা। অবন্তি ধমক দেয়
- আহ, ফারহান। এত হাসে না। এভাবে হাস কেন তুমি?
- ফারহান হাসি আরও বাড়িয়ে দেয়। মজা পায় রাজিব।
ঠিক তখনই রাজিবের ফোন বেজে ওঠে। আধো ঘুমের মধ্যেই ফোনটা ধরে ও।
- হ্যালো।
- হ্যালো। ভাই, আমি আসাদ।
- ও। বল। খবর কি?
- খবর ভালো। কাজ হয়ে গেছে। গুলিতে কাটা বাবু ছাড়াও ওর এক চ্যালা মারা গেছে।
- ওকে।
- কিন্ত একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।
- কি?
- তানজিম ওদের হাতে ধরা পড়ছে। ওরা আপনার ঠিকানাও জেনে গেছে। আপনাকে পালাতে হবে। যে কোন ভাবে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।
- আচ্ছা।
- ভাই, দেরি কইরেন না। সময় নাই। আমি দুইজনরে পাঠাইছি আপনার ফ্ল্যাটে। ওদের নাম রিফাত আর মামুন। কোড থ্রি থ্রি নাইন। ওদেরকে বিশ্বাস করতে পারেন। নাম- কোড মিলায়ে নিবেন।
পাসপোর্ট, ভিসা সব আপনার সাথে আছে না?
- আছে।
- একটা পিস্তল থাকার কথা আপনার সাথে। আছে?
- হু।
- ওকে। মামুন আর রিফাত আপনাকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছানর ব্যবস্থা করে দেবে।
- ঠিক আছে।
- এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আপনাকে পৌঁছানো আমাদের দায়িত্ব।
- হু।
- ওরা পৌঁছালেই ওদের সাথে বের হয়ে যাবেন।আমি রাখলাম।
- বাই।
রাজিব খুব দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে নেয়। দরজার লক চেক করে। বন্ধ। পিস্তলটা চেক করে। মামুন দের আগেই কাটা বাবুর লোক চলে আসলে বিপদ হবে। ও শেষবারের মত বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। শেষ সিগারেটটা ধরায়। বাচ্চাটাকে আর একবার দেখতে পারলে ভালো হত। আচ্ছা, ওর নাম কি সত্যিই ফারহান? ক্ষনিকের জন্য নিজের অজান্তেই বারান্দায় গিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দার দিকে উঁকি দেয় রাজীব। উথালপাথাল জোছনা গড়াগড়ি খাচ্ছে চারদিকে।
'অত রাতে কোত্থেকে আসবে বাচ্চাটা!' নিজেকেই নিজে প্রবোধ দিয়ে রাজিব ঘুরে দাঁড়ায় ঘরে ঢুকবে বলে। আর ঠিক তখনই কি একটা ছ্যাত করে বিঁধে উঠে পিঠের বা পাশটায়, টলে উঠে পুরো শরীর! মূহুর্তের মধ্যে চোখের ঘোলাটে দৃষ্টির সামনে চির চেনা সেই মুখগুলো ভেসে উঠে, একেবারে শেষটায় সেই বাচ্চটার প্রাণবন্ত হাসি। এত সময় যে ঘুমের প্রচেষ্টা ছিলো, তাই যেন ভর করে বসেছে রাজীবের উপর। অবচেতন অবস্থায় দরজায় একটা নক। শেষবার শুনতে পায় একটা কন্ঠ, 'রাজিব ভাই, আমি রিফাত ৩৩৯...' । শব্দটা ভোঁতা ঠেকে কানে। চেষ্টা করেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না রাজীব, নিজেকে খুব হালকা মনে হয় ওর।
লেখক: প্রভাষক, কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব
এসকে