• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০১৯, ০৯:৪৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০১৯, ০৮:৩৮ পিএম

পহেলা বৈশাখে ইলিশে নিরুৎসাহিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ

পহেলা বৈশাখে ইলিশে নিরুৎসাহিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ


পহেলা বৈশাখ বাঙালির সার্বজনীন উৎসব।বাংলা নববর্ষের এই দিন খাবারের তালিকায় ইলিশ রাখাটা একটা সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে গত দু'দশক ধরে।পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়াকেই অনেকে বাঙালিয়ানা মনে করে থাকেন।কিন্তু গত ২ বছর ধরে দেশের মানুষের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা যেন কমে আসছে। 

মূলত বছর ২ আগে দেশের মানুষের কাছে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পহেলা বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তার সে আহ্বানে মানুষ সাড়া দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

বৈশাখের আগে রাজধানীর বাজার ঘুরেও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।। বাজারে ইলিশ পাওয়া গেলেও বাজার জমছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির অনুসঙ্গ নয়। এটা ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে পারছে। ফলে পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।         
 
জানা গেছে, ২০১৭ সালের পহেলা বৈশাখের আগে জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পয়লা বৈশাখে ইলিশ না খেতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সে সময় গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘পয়লা বৈশাখে ইলিশ না ধরতে ও না খেতে আমি সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এর পরিবর্তে আপনারা খিচুড়ি, সবজি, ডিম ভাজা এবং পুড়িয়ে শুকনো মরিচ খেতে পারেন।’ 

সে সময় গণভবনের সূত্রগুলো গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল, গত ২ বছর পয়লা বৈশাখে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর খাদ্যের তালিকায় ইলিশ ছিল না। 

প্রধানমন্ত্রীর ওই আহ্বানের পর বৈশাখের প্রথম দিনে ইলিশ-পান্তা বর্জন করেছিল বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনও। ফলে দু'দশক ধরে নববর্ষে পান্তা-ইলিশের যে ব্যবসা জেঁকে বসেছিল তাতে এসেছে মন্দাভাব।
 
তবে বছর ঘুরে আগামী ১৪ এপ্রিল ফের আসছে বাংলা পঞ্জিকার নতুন বছর।  এবারও রাজধানীর বাজার ঘুরে ব্যাপক হারে ইলিশের দেখা মিলল। দামেও আগের বছরগুলোর মতই।

মঙ্গলবার সকাল থেকে রাজধানীর কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ উঠেছে। প্রতিটি ইলিশ বাজার ও আকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন দামে। দামও বেশ চড়া। প্রতিটি  ৬শ’- ৮শ’ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৭শ’-৮শ’ টাকায়। 
বাজারে ইলিশের জোড়া ১৩’শ থেকে ১৮শ’ টাকা, হালি ৩ হাজার থেকে ৩২শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

তবে গত বছরের মত এবার ক্রেতা মিলছে না বলে জানালেন ইলিশ ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের নারায়ণ রাজবংশী মৎস্য বিতানের কর্ণধার নারায়ণ রাজবংশী জানান, এবার পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ তেমন একটা বিক্রি হচ্ছে না। গত বছরের মত সাধারণ মানুষ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে ইলিশ কিনছেন না। তবে কি কারণে তা বলতে পারেননি তিনি। একই কথা জানালেন ওই বাজারের ইলিশ ব্যবসায়ী মাসুদ মিয়া।   
 
এর আগেও বিভিন্ন সময়ে পহেলা বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার জন্য দেশের মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন অনেক দেশ বরেণ্য মানুষ। গত দু'বছর ধরে পহেলা বৈশাখের আগে 'নববর্ষে ইলিশ নয়' এমন কথা বেশি উচ্চারিত হয়েছে। দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরাও ইলিশ না খেতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। বিশেষজ্ঞরা মতে, বৈশাখ প্রকৃত অর্থে খরার মাস। এ সময় কোনো ফসল ওঠে না। সাধারণ কৃষকের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়ার মতো টাকাও থাকে না। ফলে পান্তার সঙ্গে খাওয়া তার কাছে বেশ দুঃসাধ্যই ছিল সব সময়। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে গ্রামবাংলায় পহেলা বৈশাখের আয়োজনে থাকত আগের দিন ভিজিয়ে রাখা চাল। যে চালের পানি কৃষক খেতেন এবং মঙ্গলের জন্য কিষানির শরীরে ছিটিয়ে দিতেন। তারা পান্তা খেতেন কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, শুঁটকি ভর্তাসহ নানা ভর্তা দিয়ে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,  ইলিশ আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। তবে বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ কোনোভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। এ সময়টা ইলিশ সংরক্ষণের সময়, ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে। এখন ডিমভর্তি জাটকা ইলিশ ধরা হচ্ছে। একটি ডিম খেয়ে ফেলা মানে বহু মাছ খেয়ে ফেলা।

প্রয়াত দেশ বরেণ্য সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ বলেছিলেন, পহেলা বৈশাখের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের সম্পর্ক নেই। এটা গরিব মানুষের খাবার নয়। গ্রামের মানুষ ইলিশ কিনে পান্তা ভাত তৈরি করে খায়- এটা কখনও দেখিনি, শুনিনি। প্রতিবারই বর্ষবরণের আগে এ নিয়ে বিতর্ক ওঠে। সে সঙ্গে বাজারে বাড়তে থাকে ইলিশের দাম। 

অবশ্য কয়েকদিন ধরেই গণমাধ্যমে ইলিশের দাম বাড়ার খবরের সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে বৈশাখে ইলিশ রান্নার নানা রেসিপির খবরও। 

কিন্তু লোকগবেষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মৎস্য বিশেষজ্ঞরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বৈশাখের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের সম্পর্ক নেই। এটা বাণিজ্যিক কারণে আরোপিত সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বলছেন, বৈশাখ মাসে ইলিশ খাওয়ার মধ্য দিয়ে সারা বছরের ইলিশ উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

ইলিশ বাঙালি ‘সংস্কৃতির অনুসঙ্গ নয়’ এমন ইঙ্গিত করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী দৈনিক জাগরণকে বলেন, ‘প্রতিবছর মানুষ আনন্দ উল্লাসের সঙ্গে পহেলা বৈশাখে ইলিশ খায়।’ ‘বাঙালি সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়া নিয়ে তো কোন কথা নেই।’  ‘কেউ ইলিশ খেল কিনা? এ নিয়ে পহেলা বৈশাখের কোন কিছু আসে-যায় না।’’ 

এএইচএস/আরআই