তেষ্টা
যার কথা মনে ক’রে এই পথ-চলা কোথাও পায় নি তাকে মন; হেঁটে-হেঁটে-হেঁটে তেষ্টাই সার। পথের পাশের সূর্যাস্তেরঘোরলাগা রঙএক কাপ চা একদিন কথা দিয়েছিল: যে -করেই হোক মেটাবেই মৃত্যুর আগের এইআবক্ষ তেষ্টা। তারপর কতদিন কতরাত সেই কাঁধে-কাঁধসারিবদ্ধ জীর্ণ ছাপড়াগুলোয়শুনেছি অবাধ খিস্তিখেউড়;
হতভম্ব আমি দেখেছি কতজন কতচৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছে অবলীলায়;
আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি কেউ!
অন্তর্বয়ন
কিছুতেই মন নেই আজ, তবু এই বন ভবনে
দায়ে পড়ে মুখ গুজে আছি চেয়ারে-টেবিলে;
ডেস্কটপ-নথির প্রতিটি পৃষ্ঠায় রূপালি
ভেসে উঠছে তার মুখ, পথ চেয়ে চেয়ে যার
ক্ষয়ে গেছে অতল শ্যামল দুই চোখ!
হয়তো এখনো আমাকেই ভেবে ভেবে জেগে আছে
দখিন হাওয়ায় দোল খাওয়া একাকী গোলাপ
রবীন্দ্রসংগীতের সাথে একান্তে ভাগ করছে নিজের বিরহ;
আমার তো ছুটি নেই মিলছে না এতটুকু অবসরও
অপেক্ষায় থেকে থেকে ফুরালপ্রতীক্ষার ফাল্গুনও...
অফিসের মূল ভবনের ঝুল বারান্দায় দাঁড়াতেই
দৃষ্টি লুফে নেয় বৃহৎ বাগান অপার মুগ্ধতা ঘিরে ধরে
নীলাভ সবুজ ঢেউয়ে জেগে ওঠে রূপকথার ঘুমন্ত পরী!
পাশেই লালবাড়ির আভাস হাদিস পার্কও
ঠিক ধরা দেয় না, যেন বাগানই ওখানে একটু গড়িয়ে
নেমে গেছে!
বহু-ব্যবধানেও প্রতিটি বৃক্ষ পেয়েছে নিজ আয়তন;
বাগান কি পার্কের নকশাতেই সৃজিত, না-কি
সমগ্র একত্রে দৃশ্যমান তাই একটাই মনে হয়?
হয়তো কেউ না আমিই বানিয়েছি নকশাটি, এইভাবে
আমার হৃদয়ে যে তারই অন্তর্বয়ন উত্তরাধিকার-রক্ষার
গূঢ় অর্থে যাকে অনিচ্ছায় রেখে এসেছি পৈত্রিক ভিটায়!
দুঃশব্দ
দশদিকে দশমাইক না-কি পাতিশেয়ালের হুক্কাহুয়া?
সেও তো মন্দ লাগে নি কখনো অথচ ওই কর্কশ মাইকাওয়াজ
প্রহরে প্রহরে আমার ধ্যান ভাঙে, দুঃশব্দে ঘুমাতেও পারি না!
বাদাবনে বাঘ তাড়ানোর মতো ওই অদ্ভুত আওয়াজ
কাঠঠোকরার মতো ঠোকরাচ্ছে আমার করোটি হৃৎপিণ্ড...
আমি কি লোকালয়ে মানুষখেকো বাঘের কবলে পড়েছি!
ওরা কি জানে না, নৈঃশব্দেরও নিজস্বভাষা আছে?
কান পাতলেই শোনা যায়...: তার সাথে হাত মিলিয়ে
চেতনার রঙেই কীভাবে ছোঁয়া যায় বোধের আকাশ!
নদীতে ডুব দিয়ে মাটি তুলতে গিয়ে যে-বালক
পানির প্রবল চাপে হারিয়েছে তার একটি কান
অন্যটি হারিয়ে আজ এইভাবে হয়ে যাবে সম্পূর্ণ বধির?
নিঃশব্দে ঘুমিয়ে সে যে কাকের ডাকেই জেগে উঠতে চায়।
বাক্সবার্তা
সুপক্ক এক লংকারঙা বাক্স আছে ঝাল না কেবল মিষ্টি ধরে
কর্ণ ধরে দেশ-বিদেশের মুদ্রাও আর দান হিশেবে
প্রাপ্ত সেসব ছাড়াও ধরে নগদ কড়ি কোটির অধিক!
নরসুন্দা নদীর পাড়েই ‘পাগলা’ নামের মসজিদে সেই
বাক্স খুলেই যায় মিলে যায় লক্ষ-কোটি...
শুনলে যে কেউ আনন্দে হয় আটখানা, কেউ
নৃত্য করে উদ্বাহু আর প্রাণ ভরে কেউ
আদায় করে সুসংবাদের শুকুরিয়া...
চোখ ধাঁধানো এমন রঙের বাক্স এখন কোথায় যে নেই
বাজার মাজার গঞ্জ গাঁয়ে সড়ক মহাসড়ক ধারে
জনাকীর্ণ চৌরাস্তায় অশ্বত্থ বট পাকুড় তলায়
সর্বত্র ভাইরাস হারে...
কুবিশ্বাস আর কুসংস্কার এই ভাগাড়ে দরকার আবার
কোটি কোটি অবিশ্বাসী জিজ্ঞাসু আর বিজ্ঞানমন
যুক্তিযোগে যারা নেবে সত্যাসত্য যাচাই ক’রে।
সভা
মধ্যাহ্নভোঁজের সামনে অথবা অপরাহ্নেই
আমাদের সভাগুলো বসে,কিন্তু আজ
শুদ্ধাচার সম্পর্কিত একজরুরি সভার মাধ্যমেই
শুরু হবে কর্মদিবস এরকমই কথা ছিল...
সময় উলের বল গড়িয়ে যাচ্ছে লগ্ন মাড়িয়ে
অনির্দিষ্ট পথে, তবু ব’সছে না আহুত সভা!
এই দশা অনিবার্য জেনেই কি
আমাকে ডাকছে ওই ধূসর পথ পথচারী
যারা যাপন ক’রছে মনুষ্যজীবন!
ইচ্ছের সম্মতি নিয়ে তারই প্রশ্রয়ে
আমার ভেতরে কেউ
শীতাতপ নিরাপত্তা... এইসব পেরিয়ে
রোদেলা সড়ক ধ’রে হাঁটে, দ্যাখে:
জীবন অপার অপার রাতে অগুনতি বর্ণিল ঢেউ...
২.
সভাপতি এখনও বসেন নি তাঁর নির্ধারিত আসনে
সভার আদলে শুধু সংশ্লিষ্ট উপস্থিতিভাগ হয়ে
আয়ের অংকেই গুণ করছে আজকের ব্যয়ের হিসাব!
ভূতগুলো
এত ক’রে তাড়ালাম ভূতগুলো
পড়া সর্ষের মতো সর্বত্র ছড়ালাম সর্বস্ব
আগুনের পরশমণি ছোঁয়ালাম প্রাণে প্রাণে
তবু এ-খুঁদকুড়ো পাটশাক দুধভাতে
উৎপাতলেগেই আছে
তবে কি, সর্ষেতেই ছিল এই ভূত?
কতদিন পর
কতদিন পর এক-ঘুমে কাটে একটি রাত
কতদিন পর মোরগের ডাকে ভোর আসে
কতদিন পর হাতে উঠে আসে একটি হাত
কতদিন পর নবারুণ হাসে তার পাশে!