• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৪, ২০১৯, ০৭:৫৬ এএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৪, ২০১৯, ০২:১০ পিএম

স্বাগত ১৪২৬

এলো রে বৈশাখ

এলো রে বৈশাখ

‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।’ —

আজ রোববার। পহেলা বৈশাখ। শুভ বাংলা নববর্ষ। স্বাগত ১৪২৬।

বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি ও গর্বিত ঐতিহ্যের রূপময় ছটায় উদ্ভাসিত সর্বজনীন উৎসবের দিন।

আনন্দ-হিল্লোল, উচ্ছ্বাস-উষ্ণতায় দেশবাসী আবাহন করবে নতুন বছরকে।

অর্থ-সঙ্গতি থাকুক আর নাই থাকুক, সবার হৃদয়ে আজ রবীন্দ্র-নজরুলের সুর জেগে উঠবে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...,’ কিংবা ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’

নতুন এই দিনটি পুরনো সব ব্যর্থতা ও আবর্জনার জঞ্জাল সরিয়ে নতুন আশা, কর্মোদ্দীপনা, স্বপ্ন, প্রত্যয় ও প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হওয়ার ডাক দিচ্ছে।নতুনের কেতন ওড়ানো বৈশাখ এসেছে নতুন সম্ভাবনা, প্রত্যাশা ও সমৃদ্ধি অর্জনের লড়াইয়ে জয়লাভের প্রতিশ্রুতি ও প্রেরণা নিয়ে।

খরতাপ কিংবা অকাল বর্ষা উপেক্ষা করে দেশের প্রতিটি পথে, মেলায়, অনুষ্ঠানে থাকবে লাখো কোটি মানুষের প্রাণচাঞ্চল ও উৎসব মুখরতার এক বিহ্বলতা।

নতুন বছর মানেই এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশায় পথ চলা। বুকভরা তেমনি প্রত্যাশা নিয়ে নতুন উদ্যমে ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি আজও সোচ্চার হয়ে উঠবেন সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ নিধনের দাবিতে। সেই সঙ্গে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রায়িক ও সুখীসমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়েও লাখো-কোটি বাঙালি শামিল হবেন সর্বজনীন বৈশাখি উৎসবে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আকাঙ্খার সঙ্গে একাকার আজ নববর্ষে আমাদেরও প্রত্যাশা—  ‘এসো এসো এসো হে বৈশাখ/তাপস নিঃশ্বাস বায়ে... মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক...’ শাশ্বত সেই শুচিশুভ্রতার স্বপ্নে অতীতের জীর্ণ মালিন্যকে পেছনে ফেলে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার দিন আজ।

নতুন স্বপ্নের লাল হালখাতা খোলার দিন পহেলা বৈশাখ। তাই নববর্ষ বাঙালি ঐতিহ্যের অহঙ্কার।

নববর্ষ উদযাপনে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ এখন উৎসবে মাতোয়ারা।

সবার প্রাণে বেজে উঠেছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই দৃপ্ত আকাঙ্খা— ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড় ... তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’-এই সুরধ্বনির ভেতর দিয়েই নতুন বছরে সব অপ্রাপ্তি আর ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হবে নববর্ষ।

দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা যাই হোক না কেনো সবার মনে আনন্দ-উৎসবের শখ-আহ্লাদ এতটুকু কমেনি বরং বেড়েছে। নতুন বছরের কাছে মানুষের প্রত্যাশা সামনের দিক আরও ভালো হোক। ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা’ পুড়িয়ে ফেলে, হতাশা-অবসাদ-গ্লানি ঝেড়ে-মুছে ফেলে নতুন উদ্দীপনায় জাগরণের আহ্বান জানাচ্ছে বৈশাখ। হিংসা-দ্বেষ, ক্ষুদ্রতা, কলুষ, কুসংস্কার এবং পশ্চাৎপদতার নিগড় ভেঙে ফেলে, অসুন্দরকে বর্জন করে সমাজ মুক্ত হোক, সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসুক, প্রগতির আলোয় উদ্ভাসিত হোক সমাজ এ আহ্বান জানাচ্ছে বৈশাখ।

ভোরে দিগন্তের তিমিরে সূর্যোদয়ের প্রথম রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সূচিত হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪২৬-এর জন্মক্ষণ। তখন থেকেই বৈশাখের সর্বজনীন উৎসব-আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে সারা দেশ, সব বয়সের মানুষ। শহরের রাস্তা ও উদ্যানে নেমেছে অগুণিত মানুষের ঢল। শুধু তাই নয়, শহর-নগর, গ্রাম-গ্রামান্তর সর্বত্রই বইছে বর্ষবরণের প্রাণোচ্ছল উৎসব-তরঙ্গ।

কাকডাকা ভোর থেকে দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা-গভীর রাত পর্যন্ত আজ চলবে বৈশাখবরণ।কোথাও গান বাজছে, কোথাও মেলা বসেছে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ঢাকের শব্দ, ঢোল, বাঁশি, নাগরদোলার শব্দ, পায়ে পায়ে উত্থিত ধুলিপুঞ্জের মধ্যে মানুষের গুঞ্জরণ-ধ্বনি, নাগরদোলায় ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে ভয় জাগানো কিছু শব্দ, শিশুর কলরব উচ্ছ্বাস।

বৈশাখী মেলায় তাকালেই দেখা যাচ্ছে রঙ-বেরঙের হাতের চুড়ি, কানের দুল, চুলের ফিতা, রঙিন বেলুন, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল, মুড়ি-মুড়কি, উখরা-খই, হাওয়াই মিঠাই, জিলাপি, চিনির সাচ-বিন্নির খই-বাতাসা, ঘর-গেরস্থলির দরকারি বস্তু.. আরও কত কি!

শনিবার (১৩ এপ্রিল) চৈত্রের শেষ দিনে গ্রাম ও শহরে ব্যবসায়ীরা গত বছরের বিকিকিনির হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে দিয়েছেন।

রোববার (১৪ এপ্রিল) খুলবেন লাল মলাটের হালখাতা। রমনার বটমূলে ষাট দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নবউন্মেষকালে ছায়ানট সেই যে কাকডাকা ভোরে নববর্ষকে আবাহনী গান গেয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, সেটি আজ রাজধানীবাসীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।

এখন রাজধানীর পথ মিশেছে রমনায় এসে।বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ভোর সাড়ে ৫টায় হাজারও কণ্ঠে গানে গানে বর্ষবরণ করে নেয় সুরের ধারা ও চ্যানেল আই।

আজ সরকারি ছুটি। সংবাদপত্র অফিসও আজ বন্ধ থাকছে। সংবাদপত্রগুলো বের করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি রেডিও-টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।

দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ।

পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব উল্লেখ করে প্রখ্যাত লোকবিদ অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘‘বাংলা নববর্ষে মহামিলনের আনন্দ উৎসব থেকেই বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট- ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করবার আর কুসংস্কার ও কুপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার অনুপ্রেরণা পায় এবং জাতি হয় ঐক্যবদ্ধ।

ভাষা সংগ্রামী ও রবীন্দ্র গবেষক ডা. আহমদ রফিক বলেন, ‘‘সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট বাস্তবতায় এবারে উৎসব শুধু উৎসব নয়, এবার প্রতিবাদী একটা চরিত্র বেরিয়ে আসা উচিত, যা পহেলা বৈশাখকে ষাটের দশকে অসাম্প্রদায়িকতার মঞ্চে পরিণত করেছিল।’’  

নাট্যজন রামেন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘‘পহেলা বৈশাখ আমাদের সর্বজনীন উৎসবগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এবারও বৈশাখে মুখর হবে।’’

চলচ্চিত্রকার ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘‘এবারেও নববর্ষে বাঙালির অঙ্গীকার হবে- একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠন। এবারের উৎসব হবে আরও উদ্দীপনাময়। জনজোয়ারের সামনে প্রতিক্রিয়াশীলদের বাধা খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে।’’

সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘‘প্রতিবাদ শুধু সম্মুখ সংগ্রামেই হয় না, গানের সুরেও সূচিত হতে পারে।এবার বাঙালি তার ঐতিহ্য ছড়িয়ে দেবে মানুষের মননে ও মগজে।’’

মোগল সম্রাট আকবরের নির্দেশে তার সভাসদ আমীর ফতেহউল্লাহ খান সিরাজী প্রায় চারশ’ বছর আগে হিজরি সনের সঙ্গে মিল রেখে ফসলি সন হিসেবে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। তখনই বঙ্গাব্দের সূচনা হয় বৈশাখের প্রথমদিন থেকে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তা এই জনপদের মানুষের গর্বিত ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। বৈশাখি উৎসব সংস্কৃতির অন্যতম সমৃদ্ধ এক উপাদানে পরিণত হয়েছে।

বাংলা নববর্ষে হালখাতাই মুখ্য ছিল এককালে। তার সঙ্গে কিছু উৎসব ছিল, ছিল কিছু আনন্দসম্ভার। এখনও হালখাতা আছে। ক্রমেই মুখ্য হয়ে উঠছে আনন্দ-উৎসব। নাচ, গান, মেলা, লাল রঙের হালখাতা, মিষ্টিমুখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, নতুন পাঞ্জাবি, শাড়ি, ফতুয়া কেনার ধুম, খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো, শুভ নববর্ষ জানানোর রেওয়াজ-উৎসবের নানা অনুষঙ্গে নববর্ষ উদযাপন নিত্য-নতুন মাত্রিকতায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে চলেছে।

কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রয়োজনে ফসলি সনে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে যে বাংলা সনের সৃষ্টি, তার সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক যত, ততটাই সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। চৈত্রসংক্রান্তি এবং বাংলা নববর্ষ প্রাচীনকালে হিন্দু সমাজে পূজাসহ নানা আচারের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কালক্রমে তা ধর্মীয় সীমানা অতিক্রম করেছে।

মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ এই ভূখণ্ডের মানুষের কাছে দিন দিন এ উৎসব থেকে ধর্মের আচার আনুষ্ঠানিকতা কমে গিয়ে বরং সাংস্কৃতিক আয়োজনটাই প্রধান হয়ে সব ধর্মের মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে।

পহেলা বৈশাখে রবীন্দ্র-নজরুলসহ বাংলা ভাষার কবিদের কাছে বরিত হয়েছে বিচিত্র ভাবের আবেগে বহুকাল আগে থেকেই। আজও সে ধারা বহমান। বৈশাখের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।

‘ওই আসে ওই নব হরষে’ বলে যে উদ্দীপনা জাগায় বাংলা নববর্ষ বৈশাখ, কিংবা কবি কাজী নজরুল যখন বলেন, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়’ তখন বৈশাখের ধ্বংসের মধ্যে নবসৃষ্টির উদ্দীপনা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।

নববর্ষে দেশজুড়ে আজ যে উৎসবের আলোড়ন, তা লড়াইয়ের ফসল। আমরা বাংলা নববর্ষকে অর্জন করেছি সাংস্কৃতিক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যখনই সাম্প্রদায়িকতার বাধা এসেছে, তখনই সাংস্কৃতিক কর্মীরা রুখে দাঁড়িয়েছেন। ষাটের দশকে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শাসকরা যখন বাঙালির প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথকে 'হিন্দু' বলে তার সাহিত্য বর্জন করল, রেডিও-টেলিভিশনে নিষিদ্ধ হলো রবীন্দ্রসঙ্গীত, তখনই প্রগতির যোদ্ধা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকর্মীরা ছায়ানট গঠন করে রমনার বটমূলে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ডিএল রায়সহ পঞ্চকবির গানে বর্ষবরণের দ্রোহী কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হয়।  সেই ধারাই দিনে দিনে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে করেছে বেগবান। রাজনীতিকেও মুক্তিযুদ্ধের পথে যেতে বিপুল সহায়তা করেছে। এখনও যে কোনো বাধার মুখে বৈশাখ আমাদের নতুন করে প্রতিরোধের প্রেরণা জোগায়। কেননা বৈশাখের একটা রুদ্র রূপ যে আছে, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতেই তা দেখে নেওয়া যায়— ‘হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,/ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন_ পিঙ্গল জটাজাল,/তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণে ভয়াল/করে দাও ডাক_/হে ভৈরব হে রুদ্র বৈশাখ।’

 

বৈশাখের এই রুদ্ররূপের মধ্যেই আছে দ্রোহের বাণী, ধ্বংসের নৃত্য আর নবসৃষ্টির ইশারা। ফলে বাংলা নববর্ষে এই প্রেরণা মনে আসবেই— যখনই এক একটি বড় বাধা আসে, তখনই সৃষ্টির নব জোয়ার, ঘটে বাঙালির নবজাগৃতি। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নতুন নয়। বারবার এসেছে ছোবল। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে রমনায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মৌলবাদীরা বোমা মেরে নিরীহ মানুষ আর সংস্কৃতিকর্মীদের হত্যা করে কি থামাতে পেরেছে মানুষের ঢল। এখন আরও বড় সে আয়োজন। বিস্তৃত হতে হতে উৎসব যেন গণজোয়ার আজ। চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতীকী মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ সর্বত্রই তো নবজাগৃতির বাণী। 

ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে, ধনী-নির্ধন, শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত-সব বয়সী মানুষের সর্বজনীন উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে এই পার্বণ। রাজধানী ঢাকার রমনার বটমূলে নববর্ষের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার কথা সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। ছায়ানটের শিল্পীদের রুচিশীল সঙ্গীত-ঝঙ্কার উপভোগ করতে প্রাণের বন্যা বয়ে যাবে রমণীয় রমনায়। ভোরের নরম সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা তবলা, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ আর পুং বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে একটি তাল বাদন পরিবেশনের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবেন। বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত অগণিত নারী-পুরুষ-শিশু যোগ দেবেন আনন্দস্নাত মিলনমেলায়।

গ্রামবাংলার নিত্যদিনের খাবার ‘পান্তাভাত’-এর আস্বাদ গ্রহণ করবেন নাগরিকরা।

পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি আজকাল আর রাজধানী ঢাকার রমনাতেই শুধু সীমাবদ্ধ নেই, নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার বাইরে গ্রামবাংলায় এক ভিন্ন আমেজে বর্ষবরণ হবে। সেখানে মেলা আয়োজনই মুখ্য। খাবারের মধ্যে চিড়া-দই, খই-মুড়ি ও আম কিংবা সজনে-ডালেরই প্রাধান্য। ঘরে ঘরে বিশেষ রান্না-বান্নাও হচ্ছে আজ।

আধুনিক জীবনে নানা উপাচারের সমারোহে খেরোখাতায় হিসাব রাখার প্রচলন এখন উঠেই গেছে। তবু বাঙালির চিরায়ত উৎসবের দিন পহেলা বৈশাখে আজ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হবে হালখাতা। মিষ্টিমুখ করানো হবে ক্রেতাদের। বৈশাখি রঙ লাল-সাদায় বাহারি নকশা করা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া থাকবে নারীর বসন। পায়ে আলতা, হাতে মেহেদি আর খোঁপায় থাকবে তাজা ফুলের মালা। পুরুষের পোশাক ফতুয়া-পাঞ্জাবিতে থাকবে লাল-সাদার আধিপত্য।

রাজধানী ছাড়াও গ্রামাঞ্চলেও বৈশাখকে বরণ করে নিতে বসবে বৈশাখী মেলা, লোকজ গানের পালা ও যাত্রাপালা। এসব আয়োজনে গ্রামের সহজ-সরল মানুষরা রাতভর মেতে থাকে নির্মল আনন্দে। বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী খাবার ইলিশ-পান্তা ছাড়াও, এদিন ঘরে ঘরে তৈরি হবে মুখরোচক পিঠা, পায়েস ও দেশীয় নানা ধরনের পিঠা। তবে এদিন রাজধানীর অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতেও থাকবে পান্তা-ইলিশের আয়োজন।

সরকারি কর্মসূচি­

বিভাগীয় শহর, ঢাকা মহানগর, দেশের সব জেলা-উপজেলায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে গ্রামীণ লোকজ মেলাসহ দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সরকার।

কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবার (এতিমখানায়) উন্নতমানের খাবার পরিবেশন, শিশুদের নিয়ে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং কারাবন্দিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে।

সব জাদুঘর ও প্রত্নস্থান সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা এবং শিশু-কিশোর, ছাত্র-ছাত্রী, প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের বিনা টিকিটে প্রবেশ করতে পারবে।

বর্ষবরণে নানা আয়োজন

বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এরইমধ্যে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো বেশিরভাগই রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানের বৈশাখী অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করছে।

ছায়ানট : ‘অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ’ স্লোগান ধারণ করে ভোরে রমনার বটমূলের শুরু হয়েছে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়কে স্বাগত জানানো হয়  রাগালাপ দিয়ে। এরপর শিল্পীরা একে একে পরিবেশন করছেন প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও সৃষ্টির মাহাত্ম্য নিয়ে ভোরের সুরে বাঁধা গানের গুচ্ছ। ছায়ানটের বর্ষবরণ ১৪২৬ সরাসরি সম্প্রচার করছে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি বিভিন্ন টেলিভিশন ও এফএম রেডিও স্টেশন। বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে ছায়ানটের অনুষ্ঠান দেখা যাচ্ছে ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে (bit.ly/chhayanaut)।

শিক্ষার্থী-প্রাক্তনী-শিক্ষক নিয়ে, ছোট বড় মিলিয়ে এবারের অনুষ্ঠানে সম্মেলক গানে অংশ নিচ্ছেন শ’খানেক শিল্পী। ১৩টি একক ও ১৩টি সম্মেলক গান এবং ২টি আবৃত্তি ছায়ানটের অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে। ছায়ানটের আহ্বান অনুযায়ী রবীন্দ্র রচনা থেকে বেছে নেওয়া হয় আবৃত্তি দুটি। একই ধারায় গানগুলো নির্বাচন করা হয়-কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, লালন শাহ, মুকুন্দ দাস, অজয় ভট্টাচার্য, শাহ আবদুল করিম, কুটি মনসুর, সলিল চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা থেকে। জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানার আগে ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন শুভবোধ জাগরণের আহ্বান জানাবেন তার বর্ষ-কথনে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা : সকাল ৯টায় চারুকলা থেকে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে মধ্য দিয়ে এবারও দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হবে দেশ-বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। লোকজ বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের সড়ক প্রদক্ষিণ করবে।

এ বছরের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য— ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’।

মঙ্গল শোভাযাত্রার পুরোভাগে থাকবে মহিষ, পাখি ও ছানা, হাতি, মাছ, বক, জাল ও জেলে, ট্যাপা পুতুল, মা ও শিশু এবং গরুর আটটি শিল্পকাঠামো।

ঋষিজ : শিশুপার্কের পাশে নারকেলবীথি চত্বরে ‘জাগো নব আনন্দে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী। সকাল ৭টা থেকে শুরু হয়ে এই অনুষ্ঠান চলবে বেলা ১১ টা পর্যন্ত। গানে গানে নতুন বছরকে বরণের এ আয়োজনে সংবর্ধনা প্রদান করা হবে কণ্ঠশিল্পী তপন চৌধুরী এবং বাচিকশিল্পী ইশবাল খোরশেদ ও ঝর্ণা সরকারকে।

বাংলা একাডেমি :  নববর্ষ বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বইয়ের আড়ং-এর আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। সকাল ৮টায় একাডেমির রবীন্দ্র-চত্বরে নববর্ষ-বক্তৃতা প্রদান করবেন প্রাবন্ধিক-গবেষক মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী।

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের আড়ং শুরু হবে সকাল ১০টায়। আড়ং উদ্বোধন করবেন একাডেমির মহাপরিচালক ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। বইয়ের আড়ং ১০ বৈশাখ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা সবার জন্য থাকবে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর : সকাল ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করবে নৃত্যজন। দলীয় পরিবেশনায় অংশ নেবে বনফুল একাডেমি, এসওএস শিশুপল্লী, ইউসেপ স্কুল ও আগারগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। বাউল গান পরিবেশন করবেন জালাল দেওয়ান ও তার দল, রঞ্জিত দাস বাউল ও মমতা দাসী। অনুষ্ঠান সবার জন্য উন্মুক্ত।

জাতীয় প্রেসক্লাব : দিনব্যাপী উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। শুরু হবে সকাল ১০টায়।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) : সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

তারকা হোটেল, ক্লাব রেস্তোরাঁর প্রস্তুতি : হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ইন্টারন্যাশনাল, প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁও, ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেল রেডিসন, ওয়েস্টিন, লা মেরিডিয়ান, ঢাকা রিজেন্সি, সারিনা, পূর্বাণী, গ্রান্ড আজাদ, সুন্দরবন, ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, কারি অ্যাসেন্ট রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন অভিজাত হোটেল, ক্লাব ও রেস্তোরাঁয় পহেলা বৈশাখ পালিত হবে।

বৈশাখি কনসার্ট : দুপুর থেকে রাত অবধি কনসার্টের আয়োজন করেছে ঢাকার অদূরে সাভারে ফ্যান্টাসি কিংডম ও নন্দন পার্ক।

এ ছাড়াও জাতীয় জাদুঘর, শিশু একাডেমি, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, রবি রাগ, কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা, বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

এসএমএম