• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০১৯, ০৮:৪৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২২, ২০১৯, ০৫:৪৪ পিএম

কত্থক কন্যা অনন্যা 

কত্থক কন্যা অনন্যা 

ওয়াফী রহমান অনন্যা নাচের মানুষ। নাচের সঙ্গেই তার আত্মিক প্রেম ও গভীর ভালোবাসা। নাচই তার ধ্যান, জ্ঞান ও প্রাণ। শয়নে-স্বপনে, নিশি-জাগরণে তার ভাবনার শুধুই নাচ। তার কল্পনার আকাশজুড়ে নিরন্তর শ্বেতশুভ্র পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় শুধুই নাচের মুদ্রা। শৈশব, কৈশোর থেকে অদ্যাবধি জীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি নাচের শিক্ষা নিয়েছেন, চর্চা করেছেন নাচের। স্বাভাবিক নিয়মেই তিনি ধাবমান জীবনের রীতি-নীতি ধারণ করেছেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুতলয়ে ছুটেছেন এবং বৈরী সময়েও নীরবে নিভৃতে নাচের চর্চা করেছেন, নানা ব্যস্ততার মাঝেও নাচের চর্চা থেকে তিনি কখনো দৃষ্টি সরাননি, নাচকে কখনো ছেড়ে থাকেননি। প্রাত্যহিক জীবনের সকল ব্যস্ততার মাঝেই তিনি নাচের জন্য সময় বের করে নিয়েছেন, নাচের সঙ্গেই থেকেছেন। কেননা এই নাচ মিশে আছে তার সমস্ত অস্তিত্বের সঙ্গে।  শৈশব, কৈশোর থেকে নাচ নিয়ে তাই পথচলা অব্যাহত আছেন এবং তিনি এই ধারায় পথ চলতে চান জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। 

বাবা-মায়ের সঙ্গে ওয়াফী রহমান অনন্যা- ছবি: সংগৃহীত

অনন্যার বেড়ে ওঠা 
অনন্যার জন্ম ২৫ মার্চ, ঢাকায়। পিতা জাতীয় সংসদের সাবেক সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও গণপরিষদের সদস্য ওয়ালিউর রহমান রেজা। মা বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সুমাতা রহমান। অনন্যার সোনালী শৈশব কাটে ব্যাস্ত মহানগরী ঢাকার মোহাম্মদপুরে। এর শহরের আলো, বাতাস আর মাটির গন্ধে বেড়ে উঠেছেন তিনি।  প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছেন মোহাম্মদপুর গার্লস স্কুলে। আর উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন  মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী স্কুল এন্ড কলেজ।  ছোট বেলায় অনন্যা প্রায়ই টিভির ভেতর ঢুকে পড়তে চাইতো। ছুঁয়ে দেখতে চাইতো টিভির ভেতরের লোকগুলোকে। ওদের দেখাদেখি অবিরাম নেচেছে শিশু অনন্যা।  শৈশবের সেসব কথা মনে থাকে কারও? বড়রা মনে করিয়ে দিলে হাসি পায়! অনন্যাকে এসব কথা মনে করিয়ে দিতেন মা সুজাতা রহমান। এরই মধ্যে নাচের জন্য অনন্যা পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। ব্যক্তিগত জীবনে অন্যন্যা বিবাহিত এবং রামি, রাদিফা নামের দুই সন্তানের জননী, আর স্বামী বিশিষ্ট ব্যাংকার। 

নাচের সঙ্গে পথচলা 
স্বরলিপি শেখার বয়সেই অনন্যা ভর্তি হন নাচ শেখার স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই তিনি নাচের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। আর এই প্রচেষ্টাই তাকে আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সম্মান এনে দিয়েছে। নিজ বাড়িতে শিল্প, সাহিত্য ও সুষ্ঠুধারার সাংস্কৃতিক আবহের মধ্য বেড়ে উঠেছেন তিনি। ১৯৮৩ সালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই ভর্তি হন ধানমণ্ডির বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে। চার বছরের শিশু অনন্যাকে নিতেই চায়নি বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস (বাফা)। পরে নৃত্যগুরু রাহিজা খানম ঝুনু বলেছিলেন, ছোট, তাতে কী? শিখুক। শেখার ফল দিয়েছিল ছোট্ট অনন্যা। একদিন সত্যি সত্যি টিভির ভেতর ঢুকে পড়ল সে। ১৯৮৯ সালে বিটিভির নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় সাধারণ নৃত্যে হলেন প্রথম, আর কত্থকে তৃতীয়। বিচারক শিবলী মোহাম্মদ সেদিন বলেছিলেন, মন দিয়ে শিখলে কত্থকে ভালো করবে অনন্যা। পণ্ডিত বিরজু মহারাজের এই শিষ্যই পরে হলেন অনন্যার কত্থকগুরু। তার কাছেই শুরু। ১৯৯৯ সালেউচ্চমাধ্যমিকের পর আইসিসিআরের বৃত্তি নিয়ে শিখতে চলে যান দিল্লিতে। সেখানে শ্রীরাম ভারতীয় কলাকেন্দ্র থেকে কত্থক নৃত্যের উপর প্রখম বিভাগ পেয়ে সাফল্যের সঙ্গে পোস্ট গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করেন। শুধুমাত্র ‘অভিব্যক্তি’র উপর এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ড. উমা শর্মার কাছে। মোট পাঁচ বছর ধৈর্য ধরে করেছেন নাচের ওপর ডিপ্লোমা— পোস্ট ডিপ্লোমা।

 

অনন্যার আনন্দ
২০০০ সালের পর অনন্যা পরপর তিনবার ভারতের প্রাচীণ কলাকেন্দ্র হতে কত্থক নৃত্যের উপর পেয়েছেন পুরস্কার।  অনন্যার সবচেয়ে বড় আনন্দ দিল্লিতে পড়াশোনা করা এবং অবস্থার ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রপতি ভবনে নৃত্য পরিবেশন করে প্রশংসিত হওয়া। ২০০৪ সালে দিল্লিতে পড়াশোনা শেষ করে তিনি বাংলাদেশে আসেন। সেই থেকে নৃত্যমঞ্চ নামক একটি ইনস্টিটিউট চালু করেন। এরপর বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমিতে বেশকিছু দিন শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি স্কুলে নৃত্যশিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ পরিবেশন করছেন। 
লক্ষ্ণৌ ঘরানার শিল্পী অনন্যা। নম্র আর লাস্যময় সেই ঘরানা। তার চোখ জুড়ানো নাচ দেখেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের অতিথি আর কামানিয়া মিলনায়তনের দর্শকেরা। এসব জায়গায় নাচ করা কম সম্মানের নয়। দেশে তার নৃত্যনাট্য সবুজ নারী সাড়া ফেলেছিল। মঞ্চে মৃচ্ছকটিক নাটকে প্রধান চরিত্র করার জন্য লেগে থাকতে হয়েছিল দুই বছর। তবে পরিবেশনার থেকে বেশি সময় গেছে শেখানোয়। নতুন করে বোধোদয় হয়েছে— আবার মঞ্চে ফিরতে হবে। শাস্ত্রীয় পরিষদ, শুদ্ধসংগীত প্রচারগোষ্ঠীর মতো সংস্থাগুলোর সঙ্গে অনন্যার নিজের দল ‘নৃত্যমঞ্চ’ অনুষ্ঠান করছে।  কেননা তার প্রত্যাশা জায়গা টেলিভিশন কিংবা সিনেমা নয়।  ছোট কিংবা বড় পর্দার শিল্পী হতে চান না তিনি। তার ভাষায়, ‘না, আরও কিছু বেশি। টিভির পর্দায় শাস্ত্রীয় নৃত্য দেখে ভালো নাচের দর্শকের মন ভরে না। তার দরকার বিরাট মঞ্চ। শিল্পীর চাই চোখের সামনে শত শত, হাজার হাজার দর্শক। মঞ্চে ঢুকে তিনি দর্শকদের সঙ্গে চোখে-চোখে সংযোগ করবেন। এই যোগাযোগ ছাড়া পারফরম্যান্সের আনন্দ কোথায়? তবে দর্শকের মানসিকতা উন্নত করতে হবে। শাস্ত্রীয় নৃত্যের মতো উচ্চাঙ্গের বিনোদনের পেছনে অর্থ ব্যয় করা শিখতে হবে।

নাচ নিয়ে অন্যন্যার ভাবনা 
নাচ নিয়ে নিজের ভাবনা বিষয়ে অনন্যা জাগরণকে বলেন, আগের চেয়ে নাচের প্রচার ও প্রসার অনেকে বেড়ে গেছে। বেসরকারি চ্যানেলগুলো নাচকে প্রধান্য দেয় এবং বেশ গুরুত্বের সঙ্গে সম্প্রচার করে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও নাচের গুরুত্ব বেড়েছে। সব মিলিয়ে সমাজে নাচের মর্যদা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু শাস্ত্রীয় নাচের চর্চা এখনো কম। নাচকে এগিয়ে নিতে হলে শাস্ত্রীয় নাচের বিকাশ ও বিস্তার জরুরি। আমি কত্থক নাচের উপর লেখাপড়া করেছি। তাই আমি অন্যান্য নাচের পাশাপাশি কত্থকের আরো প্রচার ও প্রকাশ চাই। কত্থকের যতই প্রচার ও প্রকাশ ঘটবে তাই আমার ভালো লাগবে। অনন্যার মতে, আমাদের দেশের শিল্পীদের মধ্যে ধৈর্য কম। নাচ একটি সাধনার বিষয়। পরিপূর্ণ শিল্পী হতে হলে ধৈর্য্যের সঙ্গে দিনের পর দিন সাধন করা প্রয়োজন, এক্সপেরিমেন্ট করা প্রয়োজন। যে যত চর্চা করবে তার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা তত বাড়বে। সাধনা ছাড়া কোনো সাফল্য পাওয়ার কোনো পথ খোলা নেই। অনেকে একটি নাচ শিখেই প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, নৃত্যশিল্পী হিসেবে সেরা হতে চায়। এই মানসিকতা অব্যাহত থাকলে নাচকে আমরা এগিয়ে নিতে পারবো না।   

 

অনন্যার আইকন 
নৃত্যশিল্পী ও শিক্ষক রাহিজা খানম ঝুনু  অনন্যার আইকন।  রাহিজা খানম ঝুনুর জন্ম ঢাকায়  ১৯৪৩ সালে ২১ জুন। বাবা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, মা সয়ফুন্নেসা বেগম। ১৯৬০ সালে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক।১৯৫৫ সালে গেন্ডরিয়া উচ্চ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের (মনিজা রহমান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষক বাসন্তী গুহঠাকুরতার উদ্যোগে মঞ্চস্থ নৃত্যনাট্য ‘ঘুমন্ত রাজকন্যা’ নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে নৃত্যচর্চা শুরু। এরপর বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে নৃত্যকলায় ডিপ্লোমা করেন। তার শিক্ষক ছিলেন অজিত সান্যাল এবং জি এ মান্নান। বর্তমানে এ বুলবুল ললিতকলা একাডেমির অধ্যক্ষ এবং নৃত্যকলা বিভাগের প্রধান। তিনি জি এ মান্নান পরিচালিত নকশী কাঁথার মাঠ নৃত্যনাট্যের নায়িকা সাজুর ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করে জনপ্রিয় হন। এছাড়া বাফা প্রযোজিত চণ্ডালিকা, প্রকৃতির লীলা, শ্যামল মাটির ধরাতলে, মায়ার খেলা, শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, হাজার তারের বীণা, উত্তরণের দেশে, সূর্যমুখী নদী, রাজপথ জনপথ, বাদল বরিষনে নৃত্যনাট্যে নৃত্য পরিবেশন করেন। নৃত্য পরিবেশনার জন্য ঘুরেছেন পৃথিবীর বহুদেশে। নৃত্য পরিচালনা করেছেন নাও ছাড়িয়ে দে, সোনালী আঁশ, সৃজন ছন্দে, সুর ও ছন্দ, জলকে ছল, ঝুমুর নৃত্য অন্যতম। নৃত্যকলায় অবদানের জন্য ১৯৯১ সালে একুশে পদক, ২০০৫ সালে বাংলা একাডেমির ফেলোসহ বিভিন্ন পুরুস্কার পেয়েছেন।

অনন্যার নাচ কত্থক 
ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের আট ধরনের মধ্যে একটি। এই নৃত্যের ফর্ম প্রাচীণ উত্তর ভারতের যাযাবর সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রধান চারটি ধারার বাকি তিনটি হচ্ছে ভরতনট্যম, কথাকলি, মণিপুরী। কথক শাস্ত্রীয় নৃত্যের একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ধারা। সব রকমের শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে কত্থক সবচাইতে জনপ্রিয়। প্রাচীনকালে বিভিন্ন দেবদেবীর মহাত্ন বর্ণনায় কয়েকটি সম্প্রদায় ছিল যারা নৃত্য ও গীত দিয়ে দেবদেবীর মহাত্নাবলী পরিবেশন করতেন। এসব সম্প্রদায়গুলো কত্থক, গ্রন্থিক, পাঠক ইত্যাদি ইত্যাদি। সবকটির মধ্যে কত্থক একটি বিশেষ স্থান আজও অধিকার করে রয়েছে। কত্থকনৃত্যে প্রধানত রাধা কৃষ্ণের লীলা কাহিনীই রূপায়িত হত। দীর্ঘকাল ধরে ধর্মীয় উৎসব ও মন্দির কেন্দ্রিক পরিবেশনা হওয়ায় কত্থক নৃত্যের কোনো সুসংহত রুপ গড়ে ওঠেনি। মোঘল আমলে দরবারী সংগীত ও নৃত্যের যুগ সুচিত হলেই কত্থক নৃত্যের একটি সুসংহত রুপ গড়ে ওঠে। কথক নৃত্যের সবচাইতে বেশি বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দিতে লোখনৌ এর আসাফুদ্দৌলা ও ওয়াজীদ আলী শাহ এর দরবারকে কেন্দ্র করে। কত্থকের দ্বিতীয় ধারার বিকাশ ঘটে জয়পুর রাজ দরবারে। পরবর্তীতে বারাণসীতেও কত্থক নৃত্যের বিস্তার ঘটে। নৃত্যই  কত্থকের প্রাণ তবে সহযোগী সঙ্গীতও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কত্থক নৃত্যে মোট বারোটি পর্যায়। তবলা  বা পাখোয়াজের লহরায় তাল নির্ভর নৃত্য পদ্ধতিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বারোটি পর্যায়ে রয়েছে গণেশ বন্দনা, আমদ, থাট, নটবরী, পরমেলু, পরণ, ক্রমলয়, কবিতা, তোড়া ও টুকরা, সংগীত ও প্রাধান। প্রাম্ভিক প্রর্যায়ে থাকে গণেশ বন্দনা ও আমদ। নটবরী অংশে তাল সহযোগে নৃত্য পরিবেশিত হয়। পরমেলু অংশে বাদ্যধ্বনীর সাথে নৃত্য পরিবেশিত হয়। পরণ অংশে বাদক বোল উচ্চারণ করে ও নৃত্যশিলপী পায়ের তালে তার জবাব দেয়। এরপর তবলা বা পাখোয়াজের সাথে নৃত্য পরিবেশিত হয়। ক্রমান্বয়ে বিলম্বিত ও পরে দ্রুত তালের সাথে নৃত্য পরিবেশিত হয়। করতালি দিয়ে তাল নির্দেশ করাকে বলে প্রাধান। কত্থক নৃত্যের প্রধান পোশাক লম্বা গোড়ালী পর্যন্ত পেশোয়াজ নামক এক ধরণের সিল্কের জামা ও চুড়িদার পাজামা। উজ্জ্বল প্রসাধন ও অলংকার ব্যবহৃত হয়।

জেডএইচ