• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: মে ৮, ২০১৯, ০৪:২৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৮, ২০১৯, ১০:২৭ পিএম

সাজাদপুরে জমিদার রবীন্দ্রনাথ

সাজাদপুরে জমিদার রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ কবি-সাহিত্যিক, আবার জমিদারও বটে। জমিদারির দায়িত্ব প্রদানের পূর্বে পিতা দ্বেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথসহ পরিবারের অনেকেরই পরীক্ষা নিয়েছিলেন। তারা কেউই যথার্থ উত্তীর্ণ হতে পারেননি। পিতার নিকট কবি রবীন্দ্রনাথ পরীক্ষায় পাস করেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন জমিদারির। তাই বলে তিনি আত্মভোলা নন। তাই দায়িত্ব নিলেন সকল জমিদারির। এরই অর্ন্তগত ডিহি সাজাদপুর আর এটি ইউসুফ শাহীর পরগণার অন্তর্গত। বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পৌর এলাকার দ্বারিয়াপুরের প্রাণকেন্দ্রে ৪.৬৮ একর জমির ওপরে প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর জমিদারের কুঠিবাড়ি ও কাছারিবাড়ি। পূর্বদিক দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে খোনকারের জোলা (বর্তমানে ভরাট) এবং পশ্চিম-উত্তর দিকে বাড়ির মূল প্রবেশদ্বার বরাবর কৃত্রিমভাবে তৈরি করা পরিখা খনন। ১৮৩৪ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বল্পমূল্যে এই জমিদারিটি ক্রয় করেছিলেন নিলামের মাধ্যমে। নিলামে ক্রয়কৃত জমিদারিটির মূল্য ছিল ১৩ টাকা ১০ আনা। এর পূর্বে এটি ছিল নাটোরের রানী ভবানীর বংশধরদের। তাদের এই জমিদারি লাটের খাজনা প্রদানে অসমর্থ হওয়ায় তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার নিলামে বিক্রি করে দেয়। তখন দ্বারকানাথের বয়স প্রায় ৪১ বছর। সেকালে সাজাদপুর ছিল মোটামুটিভাবে সমৃদ্ধ এলাকা।

শুধু ঠাকুর জমিদারবাড়ি নয়, ঢাকার জমিদার রূপনারায়ণ বন্দ্যোপধ্যায়ের ও করোটিয়ার চাঁদ মিয়া খাঁনপন্নিদের জমিদারি সদর কাছারি ছিল এখানে। আরও কিছু ছোট-বড় জমিদারদের বাড়িঘর ও কাছারি নিয়ে সমৃদ্ধ ছিল সাজাদপুর। এখানে কোর্ট বসত। একজন মুন্সেফ বিচারপতি হিসেবে সর্বক্ষণ অবস্থান করতেন। দেওয়ানি বা ভূমিসংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা এখানেই নিষ্পত্তি হতো। সাজাদপুর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ থানা  বা পুলিশ স্টেশন। আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকত ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ বাহিনী। নাটোরের রাজার জমিদারি নিলামে উঠলে ৫ জন জমিদার ওই পরগণা নিলামে ক্রয় করেন। তারা হলেন, কলকাতার ঠাকুর জমিদার, ঢাকার বন্দ্যোপাধ্যায় বা ব্যানার্জী জমিদার, সলপের সান্যাল জমিদার, স্থলের পাকরাশি জমিদার এবং পোরজনার  ভাঁদুরী জমিদার।

সাজাদপুর কাছারিবাড়ি ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত একটি হলদে রঙের দ্বিতল ভবন। ভবনটির দৈর্ঘ্য ২৬.৮৫ মিটার, প্রস্থ্যে ১০.২০ মিটার, উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার। ভবনটির প্রতিটি তলায় সিঁড়িঘর ব্যতীত বিভিন্ন আকারের ৭টি কক্ষ রয়েছে। ভবনটির উত্তর ও দক্ষিণে একই রকম বারান্দা। গোলাকৃতি জোড়া মাপে খামের উপরাংশের অলংকরণ, বড় মাপের দরজা, জানালা ও ছাদের উপরে প্যারাপেট দেওয়ালে পোড়ামাটির কাজ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভবনের পশ্চিম-উত্তর কোণে গোলাকৃতির দ্বিতীয় তলায় ওঠার সিঁড়ি। এ ভবনের পশ্চিম দিকে জমিদারি পরিচালনা ও খাজনা আদায়ের দপ্তর বা নায়েব কাছারি ও মালখানা এবং কর্মচারীদের আবাসগৃহ। মাঝ বরাবর ৮ ফুট ব্যাসার্ধের পাকা ইঁদারা, যেখান থেকে জমিদারবাড়ির সমস্ত জল সরবরাহ করা হতো। কাছারি ভবনের মূল ফটকের সামনে থেকে বেশ ক্ষাণিক দূরে ছিল বিরাট আকৃতির (প্রায় দেড় শত বছর পূর্বের) বকুল গাছ (ঐতিহাসিক বকুলতলা নামে পরিচিত)। উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে বিশাল বাগান ঘেরা ঠাকুর জমিদারির কুঠিবাড়ি। দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪৬ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শাহজাদপুরে তিনি ইংরেজ ম্যানেজার জেসি মিলারকে রেখে সকল জমিদারি ব্যবসা-বাণিজ্য স্বহস্তে পরিচালনা করতেন। পিতার মৃত্যুতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের প্রধান হলেন। নরম স্বভাবের হওয়ায় তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়সম্পত্তি পরিচালনায় ছিলেন অপটু। অদক্ষতার কারণে দ্বারকানাথ ঠাকুরের অর্জিত সকল সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গেলে শুধু শাহজাদপুর, শিলাইদহ, পতিসর ও কটক- এ চারটি জমিদারি টিকে থাকে। ১৮৪০ সালে ট্রাস্ট করা হয় এ চারটি জমিদারি দ্বারকানাথের অবর্তমানে কোন অংশীদার ভোগদখল করতে পারবেন, কিন্তু বিক্রি করতে পারবেন না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুরের জমিদারির কর্তৃত্ব পালন করেন ১৮৪৬ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত।

১৮৯০ সালের জানুয়ারি মাসে ২৯ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে শাহজাদপুর এসে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত শাহজাদপুরের জমিদারিটি দেখভাল করেন। অধীনস্থ কর্মচারীদের সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। আর এ কর্মচারীরা তাকে ভালোবাসতো অন্তর থেকে। তেমনি এক ভৃত্যের নাম মমিন মিয়া। তার ৮ বছরের কন্যাসন্তানটি হঠাৎ মৃত্যুবরণ করায় পিতার মতো রবীন্দ্রনাথও শোকাভিভূত। তিনি এ শোকগাথা স্মৃতি নিয়ে লেখেন তার চৈতালী কাব্য গ্রন্থের একটি কবিতা। জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন। ঠাকুরবাড়িতে অজস্র লোকের ভিড়েও প্রাজ্ঞ পিতার আকাশে নিরাশ করেননি তিনি। এতদিনে সকল গৎবাঁধা নিয়মকানুন একেবারে উল্টে দিলেন। তার সময়ে জমিদারের আয় বেড়ে গেল, অথচ প্রজারা মহাখুশি। ঠাকুর পরিবারের যতগুলো আয়ের উৎস তার মধ্যে শাহজাদপুরের রাজস্ব আয় ছিল অনেক বেশি। ডুবন্ত ঠাকুর পরিবারের ধারদেনা শোধ ও ঠাকুর পরিবারের বিশাল ব্যয়বহুল জীবনযাত্রার অর্থ জোগানের ক্ষেত্রে সিংহভাগ অবদান এই সাজাদপুরের প্রজাদেরই প্রাপ্য। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রসদনে ঠাকুর জমিদারের কিছু খাতাপত্র আছে। সেখানে ১৮৯৪ সালে (বঙ্গাব্দ ১২৯১) একটি জমা-খরচের খাতায় খাজনা আদায়ের হিসাব পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়-

ঠাকুরদের সকল আয়ের উৎসের মধ্যে জমিদারের এই আয় হলো 

০১.       পরগনা বিরামহিমপুর জমা                        -          ৫২,৮৫৭/-
০২.       ডিহি সাজাদপুর জমা                                -           ৭৮,৩৩৮/-
০৩.      পরগনা কালীগ্রাম জমা                              -            ৫০,৪২০/-
০৪.       তালুক পান্ডুয়া জমা                                  -           ১৫,৮৪৫/-
০৫.       তালুক বালিয়া জমা                                  -           ৫,৫০০/-
০৬.      কিসমত সদকী জমা                                  -           ৪৩১/-
০৭.       মৌজা বিরাটগ্রাম জমা                               -            ২৩৫/-
                                                                                  ২,৩২,৯৪৯/-
গত বর্ষের বাকি                                                            -  ১৩২৫/-                                          
                                                                                    - ২,৩৪,২৭৫/-         
মোট খরচ                                                                      - ২২৯৬৫১/- 

বাঙালি ও বাংলাকে বিশ্বের পরিমণ্ডলে সমাদৃত করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথই ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস। বাঙালির জাতীয়তা ও জাতিসত্তার সমস্তটুকু জুড়েই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। সাহিত্য ও সংস্কৃতির সব শাখায় নিজের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রবিঠাকুর বাঙালিকে সমৃদ্ধ করেছেন। ৭ বছরের কর্মজীবনে সাজাদপুরের নানা স্মৃতিবিজড়িত রবীন্দ্রনাথকে করেছে নানাভাবে ভাবান্বিত। বৃষ্টির দিনে উত্তরের বারান্দায় বসে বাতাসে নুয়ে পড়া লিচুগাছ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সেই জোড়া তালগাছ কালের সাক্ষী হয়ে। পূর্বদিকে বয়ে যাওয়া ছোট নদীটি খেয়া পারাপার হাটগামী লোকজনদের দেখে মুগ্ধ হতেন।

জমিদার রবীন্দ্রনাথ সাজাদপুরে এসে এখানে গোসম্পদ লালন-পালনের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে মুলতান ও হরিয়ানা থেকে উন্নত জাতের বেশকিছু ষাঁঢ় ও গাভী সাজাদপুরে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তাঁর আনা উন্নত জাতের গাভী ও ষাঁঢ়ের সাথে স্থানীয় জাতের গাভীর সংকরায়ন শুরু হয়। তখন কলকাতা থেকে সাজাদপুরে চলাফেরার একমাত্র বাহন ছিল নৌকা বা বোট। প্রতি বছর রবিঠাকুর তাঁর প্রিয় পদ্মা বোটে চড়ে এ জমিদারি পরিদর্শনে আসতেন। যাতায়াতের পথে রবীন্দ্রনাথ রাউতারার গিরিশচন্দ্র ঘোষবাড়ির ঘাটে যাত্রাবিরতি করতেন। ঘোষবাড়ি থেকে সংগ্রহ করতেন ছানা, ঘি ও মাখন। এগুলো কলকাতার ঠাকুর পরিবারের জন্যও পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথ। এভাবেই গিরিশচন্দ্র ঘোষ পরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক সময়ে ঘোষ পরিবার তাদের বিপুলসংখ্যক গরু চড়ানোর জন্য ঠাকুর পরিবারের জমিদারির অনাবাদি জমি চারণভূমি হিসেবে বিনা খাজনায় দাবি করেন। রবীন্দ্রনাথ গো-পালনের সুবিধার্থে বাংলা ১৩০২ সনের ২৯ চৈত্র তারিখে মোক্তা ৫ শত টাকা নিয়ে এলাকার বিশাখালী, জালঝার, ছোটঝার, দখলবাড়ী, জামাতদার, ইঁটাখোলা, হারনি, বিলদাবানিয়া, লাছনা, খাগরা, নামক বেশ কয়েকটি ছামের ১শ ৯২ বিঘা জমি পাট্টার মাধ্যমে গিরিশচন্দ্র ঘোষকে লিখে দেন (রবীন্দ্রনাথ স্বাক্ষরিত অর্ডার বুক)। ১৮৯৪/৯৫ খ্রিস্টব্দে জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই এলাকার কৃষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য এবং দুগ্ধজাত গোসম্পদ পালনে উৎসাহিত করার জন্য কৃষকদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করেছিলেন। পরে ভারতের পুশা ভ্যাটেরিনারি কলেজ থেকে উন্নত জাতের মুলতানি ও সিন্ধি জাতের ষাঁঢ় ও গাভী এনে গিরিশচন্দ্র ঘোষের মাধ্যমে এলাকার কৃষকদের সরবরাহ করেছিলেন।

পরবর্তীতে তাঁর পরামর্শেই মহাত্মা গান্ধীর মতাদর্শে পরিচালিত ভারতের খাদি প্রতিষ্ঠানের আওতায় এলাকার দুগ্ধ ব্যবসা পরিচালিত হতে থাকে। খাদি প্রতিষ্ঠান এলাকার কায়েমপুর ইউনিয়নের নতুন গ্রামের সন্নিকটে মাঠের মধ্যে উঁচু ভিটা তৈরি করে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রপাতি স্থাপন করে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে থাকেন। বর্তমানে পরিত্যক্ত ওই স্থানটি আজও খাদির ভিটা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গবাদিপশু-সমৃদ্ধ এ অঞ্চলের বিশাল গোসম্পদের ওপর ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথের সেই মহৎ উদ্যোগকে বাঁচিয়ে রাখতে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সমবায় ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে উল্লাপাড়ার লাহিড়ী মোহনপুর রেলস্টেশনের পাশে এবং পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গভাবে শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ীতে বড়াল নদীর তীরে মিল্কভিটার বিশাল কারখানা গড়ে তোলেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথের কারণেই শাহজাদপুর দেশের দুগ্ধশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে আজ দেশ-বিদেশে।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারি পরিচালনা এবং পল্লী পুনর্গঠন তার সামগ্রিক বোধ ও চেতনার এক গুরুত্বপূর্ন অধ্যায়। পরিপূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পেতে যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ১৯০৭ সালে পাবনা শহরে জাতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, “গ্রামের মধ্যে চেষ্টার কোনো লক্ষণ নাই। জলাশয় পূর্বে ছিল, আজ তাহা বুজিয়া আসিতেছে; কেননা দেশের স্বাভাবিক কাজ বন্ধ। যে গোচারণের মাঠ ছিল তাহা রক্ষণের কোনো উপায় নাই, যে দেবালয় ছিল তাহা সংস্কারের কোনো শক্তি নাই। যে সকল পণ্ডিত সমাজের বন্ধন ছিলেন তাঁহাদের গণ্ডমূর্খ ছেলেরা আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যবসায় ধরিয়াছে। জঙ্গল বাড়িয়া উঠিতেছে, ম্যালেরিয়া নিদারুণ হইতেছে, দুর্ভিক্ষ ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছে; আকাল পড়িলে পরবর্তী ফসল পর্যন্ত ক্ষুধা মিটাইয়া বাঁচিবে এমন সময় নাই। অন্ন নাই, স্বাস্থ্য নাই, আনন্দ নাই, ভরসা নাই, পরস্পরের সহযোগিতা নাই, আঘাত উপস্থিত হইলে মাথা পাতিয়া লই, মৃত্যু উপস্থিত হইলে নিশ্চেষ্ট হইয়া মরি, অবিচার উপস্থিত হইলে দেবের উপর তাহার ভার সমর্পণ করিয়া বসিয়া থাকি।”

তিনি শাহজাদপুরে প্রথমবার এসেই ২০ জানুয়ারি ১৮৯০ সালে পরিদর্শন করেন শিক্ষানুরাগীরূপে শাহজাদপুর হাইস্কুল। পরিদর্শনকালে শিক্ষার্থীদের আয়োজনে তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সুনীতি সঞ্চারিণী নামে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। যে সভায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই সভাপতিত্ব করেন। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মন্সেফ ও স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। পরিদর্শন বইয়ে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি এখনো বিজড়িত। পরির্দশন বইয়ে কবি লিখেন,  Visited the school for the first time, went round all the classes. I did not try to frighten the boy out of their wits by cursory esami- nation, which I find they have often enough. I have every reason to belive that the head aster is doing his duty conscionably and I dare say the school is as good as any other of its kind.   20-1-90 --Rabindranath Tagore.

প্রধানত ঠাকুর জমিদারির পৃষ্ঠপোষকতায়ই পরিচালিত হতো শাহজাদপুর হাইস্কুল। জমিদার হিসেবে এই স্কুল ও শিক্ষানুরাগীদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি ছিল বিশেষভাবে। এ রকম একটি ঘটনা ১৮৯০ সনের জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যানার্জী জমিদার কাছারিবাড়ি প্রাঙ্গণে যাত্রাগান চলার সময়ে হাইস্কুলের ছাত্ররা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে ব্যানার্জী জমিদারের ম্যানেজার রমাপতি বাবু ছাত্রদের শাসিয়ে একজনকে কান ধরে যাত্রা প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেন। এ ঘটনায় শাহজাদপুর হাইস্কুলের ছাত্রনেতা স্কুল ক্যাপটেন আজিজ মেসেরসহ স্কুলের ছাত্ররা স্কুলের সামনে একদিন পেয়ে রমাপ্রতি বাবুকে প্রতিশোধ নিতে উত্তমমাধ্যম দেয়। রমাপতি বাবু নালিশ জানান থানায়; পুলিশ এলো স্কুলছাত্রদের গ্রেফতার করতে। স্কুল হেডমাস্টার দ্বারকানাথ সেন থানার পুলিশদের স্কুলে ঢুকতে দেন না। কারণ স্কুলের প্রেসিডেন্ট হলেন পদাধিকার বলে সিরাজগঞ্জের এসডিও। তখন সিরাজগঞ্জের এসডিও মিস্টার বেল, তিনি বিচার করবেন বলে জানিয়ে দেন সকলকে। এ বিষয়ে হেডমাস্টার গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।

সব শুনে জমিদার রবীন্দ্রনাথ হেডমাস্টারকে জানালেন তিনি যা করেছেন যথার্থই করেছেন। সেদিনের হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত ছিল ক্যাপটেন আজিজ মেসের। যথাসময়ে এসডিও সাহেব এলেন, শুনলেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ আছেন শাহজাদপুরে। তখন তিনি রবীন্দ্রনাথকেও আহ্বান করলেন ওই বিচারের সময় উপস্থিত থাকতে। বিচার সময় সারিবদ্ধ স্কুলছাত্রদের শনাক্ত করতে পারল না রমাপতি বাবু। ছাড়া পেয়ে গেল আজিজ মেসের বাহিনী। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছেন- সাহেব তাঁবুর বারান্দায় বসে বিচার করছেন। স্কুলের ছাত্রসংক্রান্ত বিচার স্কুলবাড়িতে না হয়ে তাঁবুতে হলো কেন? সে যুগে ছোট ছোট শহরগুলোতে মহকুমা প্রশাসক এক একদিন এক একস্থানে তাঁবু খাঁটিয়ে ক্যাম্প কোর্ট বসাতেন। রমাপতি বাবুর কেসটিরও এভাবেই বিচার হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন- কাজেই দুপুর বেলা পাগড়ি পরে কার্ডে নাম লিখে পালকি চড়ে জমিদার বাবু চলেন। সাহেব তাঁবুর বারান্দায় বসে বিচার করেছেন। দক্ষিণ পার্শ্বে পুলিশের দল। বিচারপ্রার্থীর দল মাঠেঘাটে গাছতলায় পড়ে অপেক্ষা করে আছে- একেবারে তার নাকের সামনে পালকি নামালে। সাহেব খাতির করে চৌকিতে বসালে। ছোকরা হেন, গোঁফের রেখা উঠেছে- চুল খুব কটা।

সাজাদপুরের এ বাড়ি সম্পর্কে ০২/০৭/১৮৯৫ ছিন্নপত্রে লিখেছেন, কাল থেকে সাজাদপুরের কুঠিবাড়িতে উঠে এসেছি।...  বেশ লাগছে। মাথার উপরে ছাদটা অনেক উঁচুতে এবং দুই পাশে দুই খোলা বারান্দা থাকাতে আকাশের অজস্র আলো আমার মাথার উপরে বর্ষণ হতে থাকে- এবং সেই আলোতে লিখতে পড়তে এবং বসে বসে ভাবতে ভারী মধুর লাগে।

সাজাদপুরের কুঠিবাড়িতেই অবস্থিত ছিল সে সময়ের সাজাদপুরের পোস্ট অফিস। একবার আগুন লেগে পোস্ট অফিসটি পুড়ে গেলে তখন সাময়িকভাবে অফিসটি চলে আসে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির এক তলাতে। পোস্ট মাস্টার মহেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রিয় হয়ে ওঠেন সম্ভব-অসম্ভব গল্পের জন্য জমিদার রবীন্দ্রনাথের কাছে। প্রায়ই খোশগল্পে মেতে উঠতেন দুজনায়। জমিদারির আভিজাত্যের বালাই থাকত না সে আলোচনায়। এই পোস্টমাস্টার ও তার কাজের মানুষ খোনকারের জোলার দক্ষিণ পাশে ছিন্নমূল বসতি রতনকে নিয়ে রচিত হয় নন্দিত ছোটগল্প পোস্টমাস্টার। গল্পগুচ্ছের বেশ কয়েকটি গল্প ছাড়া, তার সোনার তরী থেকে চৈতালী রচনা যুগের অনেকগুলো কবিতা এবং গানও এ সাজাদপুরে রচনা করেছিলেন। এখানে বসে লিখেছিলেন- তাঁর বিসর্জন নাটকটি, আর কিছু প্রবন্ধও। যে খালে কবিগুরুর পদ্মা ও চিত্রা বোট এসে লাগত কুঠিবাড়িতে। সে খালের ওপারে বেঁদে বহরের জীবনযাপনের কাহিনী সুদূর কলকাতায় লিখেছেন অতিযত্নে।

১৮৯৭ সালে ঠাকুর জমিদারি ভাগাভাগি হলে রবীন্দ্রনাথের মেজো কাকা গিরীন্দ্রনাথের বংশধরগণ শাহজাদপুরের এই জমিদারিটি পড়ে তাদের ভাগে। গিরীন্দ্রনাথের নাতি গগনেন্দ্র, সমরেন্দ্র ও অবনীন্দ্রনাথ শেষ সময়কাল পর্যন্ত শাহজাদপুরের জমিদার ছিলেন।

সেই খোনকারের জোলাটি (ছোট নদী) ৮০-র দশকে ক্ষমতাসীনরা ভরাট করে ফেলে সেখানে গড়ে তোলেন জনাকীর্ণ হাটবাজার। উত্তর দিকের বাড়ির গেটের সামনে খোলা মাঠটি হয়ে গেছে বেদখল। উত্তর দিকের মূল সদর বাড়ি ঘুরিয়ে দক্ষিণের পিছনবাড়ি দিয়ে এখন কুঠিবাড়িতে ঢোকার মূল সদর দরজা। পশ্চিমে কর্মচারীদের আবাসস্থলে গড়ে উঠেছে ১৯৯৪ সালে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি মিলনায়তন।

লেখক : সাংবাদিক