তারিখ যাই হোক, সারা বিশ্বে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্ব মা দিবস হিসেবে পালিত হয়। সে হিসাবে আজ মা দিবস। সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়।মাকে যথাযথ সম্মান ও ভালোবাসা দেয়াই দিবসটির মূল উদ্দেশ্য। যদিও মায়েদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন হয় নাকি? বা বিশেষ একটা দিনই শুধু মায়েদের জন্য? এ নিয়ে বিশেষ তর্কবিতর্ক রয়েছে।
কিন্তু বাঙালিদের কাছে প্রতিটি দিনই মা দিবস।আজ সকাল থেকেই অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী যার যার মাকে ভালোবাসা জানাচ্ছেন। মায়ের ছবি দিয়ে নিজের ভালোবাসা ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করছেন।আসলে মাকে নিয়ে কিছু বলার নেই। মা এমন একটি শব্দ, এমন একটি আশ্রয়, এমন একটি সম্পর্ক - যাকে নিয়ে কিছু লেখা যায় না। মা - শুধু মা। অনেক আগে থেকে গ্রামে রুমালের গায়ে নকশা করে সেলাই করে বাঁধিয়ে রাখা হতো ‘মা নেই ঘরে যার সংসার অরণ্য তার।’ যাদের মা নেই তারা এটাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। বাংলা সাহিত্য মা’কে নিয়ে রচনায় ঋদ্ধ। কি গদ্য কি পদ্য- মা আছেন সাহিত্যের চারদিক জুড়ে। বাংলা ভাষার কয়েকজন যশস্বী কবির কবিতায় মায়ের উপস্থিতি দেখানো হলো।
মায়ের কবিতা
মনে-পড়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে
একটা কি সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে-
মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।
মাকে আমার পড়েনা মনে।
শুধু যখন আশ্বিনেতে ভোরে শিউলিবনে
শিশির-ভেজা হাওয়া বেয়ে ফুলের গন্ধ আসে
তখন কেন মায়ের কথা আমার মনে ভাসে।
কবে বুঝি আনত মা সেই ফুলের সাজি বয়ে-
পূজোর গন্ধ আসে যে তাই মায়ের গন্ধ হয়ে।
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে শোবার ঘরের কোণে,
জানলা থেকে তাকাই দূরে নীল আকাশের দিকে-
মনে হয় মা আমার পানে চাইছে অনিমিখে।
কোলের পরে ধরে কবে দেখত আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে সারা আকাশ ছেয়ে।
মা
কাজী নজরুল ইসলাম
যেখানেতে দেখি যাহা
মা-এর মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!
হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
কত করি উৎপাত
আবদার দিন রাত,
সব স’ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!
আমাদের মুখ চেয়ে
নিজে র’ন নাহি খেয়ে,
শত দোষী তবু মা তো তাজে না।
ছিনু খোকা এতটুকু,
একটুতে ছোট বুক
যখন ভাঙিয়া যেতো, মা-ই সে তখন
বুকে করে নিশিদিন
আরাম-বিরাম-হীন
দোলা দেয় শুধাতেন, ‘কি হোলো খোকন?’
আহা সে কতই রাতি
শিয়রে জ্বালায়ে বাতি
একটু আসুখ হলে জাগেন মাতা,
সব-কিছু ভুলে গিয়ে
কেবল আমায়ের নিয়ে
কত আকুলতা যেন জাগন্মাতা।
যখন জন্ম নিনু
কত আসহায় ছিনু,
কাঁদা ছাড়া নাহি জানিতাম কোন কিছু,
ওঠা বসা দূরে থাক-
মুখে নাহি ছিল বাক,
চাহনি ফিরিত শুধু আর পিছু পিছু।
তখন সে মা আমার
চুমু খেয়ে বারবার
চাপিতেন বুকে, শুধু একটি চাওয়ায়
বুঝিয়া নিতেন যত
আমার কি ব্যথা হোতো,
বল কে ওমন স্নেহে বুকটি ছাওয়ায়।
তারপর কত দুখে
আমারে ধরিয়া বুকে
করিয়া তুলেছে মাতা দেখো কত বড়,
কত না সে সুন্দর
এ দেহে এ অন্তর
সব মোর ভাই বোন হেথা যত পড়।
পাঠশালা হ’তে যবে
ঘরে ফিরি যাব সবে,
কত না আদরে কোলে তুলি’ নেবে মাতা,
খাবার ধরিয়া মুখে
শুধাবেন কত সুখে
কত আজ লেখা হোলো, পড়া কত পাতা?’
পড়া লেখা ভাল হ’লে
দেখেছ সে কত ছলে
ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম করে।
বলে, ‘মোর খোকামনি!
হীরা-মানিকের খনি,
এমনটি নাই কারো!’ শুনে বুক ভরে।
গা’টি গরম হলে
মা সে চোখের জলে
ভেসে বলে, ‘ওরে যাদু কি হয়েছে বল’।
কত দেবতার ‘থানে’
পীরে মা মানত মানে-
মাতা ছাড়া নাই কারো চোখে এত জল।
যখন ঘুমায়ে থাকি
জাগে রে কাহার আঁখি
আমার শিয়রে, আহা কিসে হবে ঘুম।
তাই কত ছড়া গানে
ঘুম-পাড়ানীরে আনে,
বলে, ‘ঘুম! দিয়ে যা রে খুকু-চোখে চুম’।
দিবানিশি ভাবনা
কিসে ক্লেশ পাব না,
কিসে সে মানুষ হব, বড় হব কিসে;
বুক ভ’রে ওঠে মা’র
ছেলেরি গরবে তাঁর,
সব দুখ হয় মায়ের আশিসে।
আয় তবে ভাই বোন,
আয় সবে আয় শোন
গাই গান, পদধূলি শিরে লয়ে মা’র;
মা’র বড় কেহ নাই-
কেউ নাই কেউ নাই!
নত করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!
কত ভালবাসি
কামিনী রায়
জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-
“মা, তোমারে কত ভালোবাসি!”
“কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়।
“এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।
“তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?”
মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি জানি।”
“তবু কতখানি, বল।”
“যতখানি ধরে
তোমার মায়ের বুকে।”
“নহে তার পরে?”
“তার বাড়া ভালবাসা পারি না বাসিতে।”
“আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে হাসিতে!
কখনো আমার মাকে
শামসুর রাহমান
কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।
যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর
সংসারেও এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।
যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক'রে আজীবন, কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে!
নোলক
আল মাহমুদ
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
-হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণ বেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই...।(সংক্ষেপিত)
জননী জন্মভূমি
সুভাষ মখোপাধ্যায়
আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-কে
-কখনও মুখ ফুটে বলি নি।
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে
কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু
-শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভ’রে উঠত
আমার ভালাবাসার কথা
মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি।
হে দেশ, হে আমার জননী-
কেমন ক’রে তোমাকে আমি বলি...
কোন এক মাকে
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
“কুমড়ো ফুলে-ফুলে
নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজনে ডাঁটায়
ভরে গ্যাছে গাছটা
আর, আমি ডালের বড়ি
শুকিয়ে রেখেছি,
খোকা তুই কবে আসবি।
কবে ছুটি?”
-চিঠিটা তার পকেটে ছিলো,
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।
“মাগো, ওরা বলে,
সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো মা, তাই কি হয়?
তাই তো দেরি হচ্ছে।
তোমার জন্যে কথার ঝুড়ি নিয়ে
তবেই না ফিরবো।
লক্ষী মা রাগ ক’রো না,
মাত্র তো কটা দিন।”...
মা
কাজী কাদের নেওয়াজ
মা কথাটি চোট্ট অতি
কিন্তু জেনো ভাই,
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর
তিন ভুবনে নাই।
সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক
মাথার 'পরে আজি,
অন্তরে মা থাকুন মম
ঝরুক স্নেহরাজি।
রোগ বিছানায় শুয়ে শুয়ে
যন্ত্রণাতে মরি,
সান্তনা পাই মায়ের মধু
নামটি হৃদে স্মরি।
বিদেশ গেলে ঐ মধু নাম
জপ করি অন্তরে,
মন যে কেমন করে
আমার প্রাণ যে কেমন করে।
মা যে আমার ঘুম পাড়াত
দোলনা ঠেলে ঠেলে
শীতল হত প্রাণটা, মায়ের
হাতটা বুকে পেলে।