• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০১৯, ০৯:১৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ২৩, ২০১৯, ০৯:১৯ এএম

আমাদের চিন্তার বাতিঘর 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্মদিন আজ  

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্মদিন আজ  

আজ ২৩ জুন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৪তম জন্মদিন আজ। খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তকের জন্ম ১৯৩৬ সালে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈখালী গ্রামে। তাঁর বাবা হাফিজ উদ্দিন চৌধুরী ও মা আসিয়া খাতুন। বাবার চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব কেটেছে রাজশাহীতে ও কলকাতায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, নটরডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের লিডস্‌ এবং লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৫৭ সালে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পেশায় সাহিত্যের অধ্যাপক এবং অঙ্গীকারে লেখক। এই দুই সত্ত্বার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তা মোটেই বৈরী নয়, অবৈরী- পরস্পরের পরিপূরক এবং সম্পূরক। আর এ কারণেই তাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা এবং জীবন তপস্যা একই ধারায় প্রবহমান। তাঁর ব্যক্তি জীবন এবং লেখক জীবনের মধ্যে নেই কোনো ব্যবধান। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। সে পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে তিনি একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘নতুন দিগন্ত’ সম্পাদনা এবং প্রকাশ করছেন এবং  ‘সমাজরূপান্তর অধ্যায়ন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে যে রূপান্তর ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করছেন। পত্রিকা প্রকাশ এবং সমাজ রূপান্তর অধ্যায়ন কেন্দ্র এই দুইয়ের  লক্ষ্য সমাজের পবির্তনকে প্রভাবিত করা এবং এ আন্দোলনকে একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বা সমাজ গঠনের দিকে নিয়ে যাওয়া। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাম্যবাদী রাজনৈতিক দর্শন সবার কাছে পরিষ্কার। মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইকে এগিয়ে নিতে তিনি সক্রিয়।  তিনি সবসময়ই তাঁর অবস্থানে অবিচল ও অনড়। কোনো রাষ্ট্রীয় প্রলোভন তাঁর অবিচল অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি তাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কর্তৃক দুবার উপাচার্য হওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। সমাজ বিপ্লবের  প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁর প্রত্যেক প্রবন্ধের মধ্যে যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে প্রবন্ধগুলোর সমষ্টিগত উপস্থাপনার মধ্যেও। সাহিত্যিক জীবনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন মূলত দুটি বিষয়ে।

একটি সাহিত্য অপরটি সংস্কৃতি। তিনি যে বিষয়েই লেখেন না কেন তাতে আদর্শিক বিবেচনাকে কখনোই উপেক্ষা করেন না। তাঁর লেখা এবং বক্তব্য যেমন গভীর তেমনি উপস্থাপনায় প্রীতিপদ। পেশায় তিনি শিক্ষক কিন্তু তার রচনা এবং বক্তব্যে কোনো শিক্ষকতা নেই। যা আছে তা হলো গভীর দার্শনিকতা ও ইতিহাস চেতনা।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য যাদের নিরলস অবদানে সমৃদ্ধ তিনি তাদের অন্যতম। তিনি মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ, প্রগতিশীল ও মুক্তমনা।গবেষক হিসেবে, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, অনুবাদক এবং সমাজ-সংগঠক হিসেবে এই কাজই করে যাচ্ছেন গত পাঁচ দশক ধরে। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-পরবর্তী বাংলাসাহিত্য যে ক’জন মৌলিক চিন্তাবিদ পেয়েছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাদের মধ্যে একজন। তাঁর প্রবন্ধ সব সময়ই সাহিত্যধর্মী। 

যখন রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ে লিখেন তখনও তাতে সাহিত্য থাকে। তাঁর প্রবন্ধের প্রধান গুণ চিন্তার মৌলিকতা, স্বচ্ছতা ও পারম্পর্য। চিন্তা ও চিন্তার প্রকাশের কারণে তাঁর প্রবন্ধ যেমন উপভোগ্য তেমনি ভাবনা উদ্দীপক। দৈনিক  ‘সংবাদ’ পত্রিকায় ‘গাছপাথর’ কলামের মাধ্যমে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পাঠকের চিন্তাশক্তিকে জোরালো করেছেন।

শিক্ষক হিসেবে তিনি ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সবার কাছেই তিনি প্রিয় শিক্ষক, স্যার। লেখক হিসেবে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। দেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয় থেকে রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার, ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ প্রতিটি বিশ্লেষণধর্মী রচনা পাঠকদের চিন্ত-চেতনাকে শাণিত করে। প্রবন্ধ সাহিত্যে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তিনি। সত্তরের দশকের থেকে বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিকে নিয়মিত কলাম লিখেন তিনি। তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে তার কলামগুলো। 

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনেকের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, আদর্শ লেখক ও প্রিয় সাহিত্যিক। অনেক বিজ্ঞজনেরই অভিমত, তাঁর কাব্যিক ছন্দময় গদ্য লেখার ক্ষমতার সঙ্গে একমাত্র বুদ্ধদেব বসুর তুলনা চলে। তাঁর গদ্যরীতি অসাধারণ এবং পাঠককে অন্যরকম আকর্ষণে টানে। উপস্থাপনা ভঙ্গি, বক্তব্য, বিন্যাস সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় অসাধারণ ছন্দময় গদ্যের রূপকার। এজন্যই তিনি অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে মোটাদাগে মননশীল লেখক বললে তাকে পুরোপুরি আবিষ্কার করা হবে না, তার বিশেষত্ব খুঁজতে হবে তার ভাষা আর ভাষার মধ্যে মিশিয়ে রাখা সংবেদনশীলতার প্রয়োগ দেখে। তার ‘বেকনের মৌমাছিরা’, ‘বৃত্তের ভাঙ্গাগড়া’, ‘নিরাশ্রয়ী গৃহী’, ‘বাংলা সাহিত্য ও বাঙালী মধ্যবিত্ত’, ‘আরণ্যক দৃশ্যাবলী’, ‘শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ’, ‘আমার পিতার মুখ’, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক’, ‘স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি’, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ’, ‘বাঙালীকে কে বাঁচাবে’, ‘টলস্টয় অনেক প্রসঙ্গের কয়েকটি’, ‘নেতা, জনতা ও রাজনীতি’, ‘গণতন্ত্রের পক্ষ-বিপক্ষ’, ‘শেষ মীমাংসার আগে’, ‘শ্রেণী, সময় ও সাহিত্য’, ‘স্বপ্নের আলো ছায়া’, ‘কেউ বলে বৃক্ষ, কেউ বলে নদী’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের সত্য-মিথ্যা’, ‘লেনিন কেন জরুরী’, ‘লিঙ্কনের বিষণ্ণ মুখ’, ‘শেক্সপীয়রের মেয়েরা’, ‘জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি-(১৯০৫-৪৭)’ ‘কুমুর বন্ধন’সহ  প্রায় ৮৫টি বইতেই রয়েছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিশেষত্বে মেশানো সৃষ্টিশীল গদ্যভাষার প্রয়োগ। প্রবন্ধের ভাষাও যে সৃষ্টিশীল হওয়া সম্ভব সেটাই তিনি করে দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন শব্দের প্রয়োগের মাধ্যমে বাক্যকে 
মজবুত করার অপার ক্ষমতা। শব্দে অর্থের ধারণক্ষমতা কীভাবে বাড়াতে হয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেটি তার লেখায় অনেকবার দেখিয়েছেন। প্রবন্ধের গদ্য  যে শুধু অন্য লেখার বা বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বয়ে বেড়ায় তা-ই নয়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধের ভাষা নিজেই সৃষ্টিশীলতার স্বাদ দিতে সক্ষম। শুধু  ঘরে বসে জ্ঞানার্জনই নয়, তার লেখা মুক্তির প্রতিশ্রুতি জনসমাজে প্রতিধ্বনি তুলতে পারে। মানুষকে মুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমাজ বাস্তবতায় সচেতন। সারাজীবন তিনি শাসকশ্রেণীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখেছেন। এটাকেই সাহিত্যে প্রধান মাধ্যম হিসেবে নিয়েছেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায়, ‘কথাটা শুনতে ভালো যে, সাহিত্য পরিপূর্ণরূপে অরাজনৈতিক, কিন্তু এ একটা মিথ্যে কথা। কেবল যদি মিথ্যাই হতো তবে মস্ত কোনো দোষ ছিল না, কেননা সত্য থাকলে মিথ্যাও থাকবেই। বঙ্কিমচন্দ্র অযথার্থ বলেননি যে, নিত্য মল্লযুদ্ধে বল বাড়ে। এবং যে-সত্য মিথ্যাভীরু তার পলাতক ও অপোগন্ড স্বভাবের প্রতি মিল্টনের বিতৃষ্ণা সর্বজনীনতার দাবিদার। সাহিত্যের রাজনীতি-নিরপেক্ষতার দাবিতে কেবল মিথ্যা নেই, প্রতারণাও আছে।’ 

জেড এইচ/আরআই