• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০১৯, ০৭:৫৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ২৫, ২০১৯, ০৮:০০ পিএম

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

কামাল লোহানী : একজন শিল্পী - সংগ্রামী

কামাল লোহানী : একজন শিল্পী - সংগ্রামী

কামাল লোহানী । একজন সংগ্রামী মানুষের প্রতিকৃতি। পেশায় সাংবাদিক হলেও সংস্কৃতির সংগ্রামে যিনি আজও অবিচল। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে  ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার রাষ্ট্রবিরোধীতা শুরু তারপরে আর পিছে ফিরে তাকাননি। অংশ গ্রহণ করেছেন দেশের সবক’টি গণসংগ্রামে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অস্বীকার করতে যে পাকিস্তানি কার্যক্রম তিনি তার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রসারে তখন ছায়ানট গঠিত হয়। তিনি ছিলেন ছায়ানটের প্রথম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে আবার সংবাদপত্রে যোগদান করেন। সংবাদপত্রের সাংবাদিক - কর্মচারিদের বেতন ভাতা নিয়মিত করতে সাংবাদিক ইউনিয়ন শুরু করেন।  ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। কখনও সুবিধাভোগী ছিলেন না।

জীবনের বহু বছর সাংবাদিকতা করে, মিছিল করে, জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করলেও কামাল লোহানীর একখন্ড জমি বা বাড়ি,গাড়ি হয়নি। চোখের অসুখ ছিলো বেশ আগে থেকেই। এখন বয়সের সাথে বিভিন্ন অসুখ দেখা দিচ্ছে। লিখতে চান  এখনও। তবে বাড়ি-গাড়ির জন্য তার আক্ষেপও নেই।  সবার প্রাণের মানুষ তিনি।  লোহানী কাকা বা লোহানী ভাই , সবার আপনজন তিনি। এট তার অর্জনতার কথা প্রাণ ছুঁয়ে যায়। অসাধারণ বক্তা তিনি।এই চির বিদ্রাহী তার বক্তৃতায় কোন কিছু ছাড় দেন না। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলন ,গণনাট্য সংঘের কার্যক্রম নিয়ে কিছুদিন আগেও যে লেখাটা লিখেছেন  সে লেখাটা  ভারতবর্ষের কৃষক ও গণসংস্কৃতি আন্দোলনের  একটি দলিল। তিনি লিখেছেন-


‘ স্বাধীনতা সংগ্রামে যে রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি সংস্কৃতিক আন্দোলন বিছ্ছিন্নভাবে ঘটেছিল, তাকে কমিউনিস্টরা সংঘবদ্ধ করে একটি সংগঠণে রূপ দিয়েছিলেন , যাকে বাংলায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বলা হয়। গণনাট্যের এই সংগঠন সারা ভারতকে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রবল বেগে। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনে কিংবা আন্দোলন- সংগ্রামে ক্রমশ: এই গণসঙ্গীত-নাটকের জোয়ার জেগেছিল, সেই সেদিন। বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামেও এদের বিরাট অবদান রয়েছে। যেমন ধরুন, বৃটিশ শোষকদের অন্তিমকালে বাংলায় কৃষক সমাজ তেভাগার সংগ্রাম শুরু করলেন। যা অব্যাহত ছিল ভারতবিভাগের পরও। বৃটিশ ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে চলে যাবার পরও ভারতে কংগ্রেস সরকার ও পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানের পূর্বাংশে অর্থাৎ এই পূর্ব বাংলায় সেই তেভাগা আন্দোলনই ছিল পাকিস্তানি শাসকদের  বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত। প্রচণ্ড দমন নীতি চায়িয়েছিল লীগ সরকার। বহু কৃষকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, মামলা চাপিয়ে দিয়ে তাদের বিশাল সংখ্যায় গ্রেফতার করেছিল ‘স্বাধীন’ বলে আখ্যায়িত পূর্ব পাকিস্তানে।

জনগণ প্রথমেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সেদিন যে, এই জালিম মুসলিম লীগ সরকার আমাদের জন্যে নয়। পাঠক মনে পড়ে কি চল্লিশ দশকের শেষভাগের সেই গণআন্দোলনকে? ওই আন্দোলনে কৃষক ছিলেন মূল শক্তি। একে বৃটিশ ও পাকিস্তনী শাসকগোষ্ঠী দমন করতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পর্যন্ত নামিয়েছিল এবং অকথ্য নির্যাতন, গ্রেফতার , ধর্ষণ নানা কৌশলে অংশগ্রহণকারীদের শায়েস্তা করা হচ্ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষকরা সংঘবদ্ধ হয়ে এই পাশবিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ময়মনসিংহে কমরেড মণি সিংহ, রাজশাহীতে ইলামিত্র-রমেন মিত্র , সিলেটে কমরেড অজয় ভট্টাচার্য, দিনাজপুরে হাজী দানেশ, ভামারাম সিং, গুরুদাস তালুকদার, রংপুরে পাবনায় কমরেড অমূল্য লাহিড়ী, খুলনায় কমরেড বিষ্ণু চ্যার্টাজি, ফরিদপুরে কমরেড শান্তি সেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। তাইতো সংগ্রামের পথরেখায় আমাদের যে যাত্রাভিযান শুরু হয়েছিল রক্তের আখরে, সেই পরিক্রমায় রেণুকনা দিয়ে লিখিত হয়েছে সংস্কৃতি-সম্ভাবনা আর সেই রক্তের কারুকাজে অনুবীক্ষণ করেছি পরিবর্তনের, সংশোধনের। এ পথেও সংস্কৃতিই ছিল চৈতন্যের হাতিয়ার।’ (সংস্কৃতিই গণঐক্যের বলিষ্ট হাতিয়ার)।

এসব লেখার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে তিনি যে কৃষক মেহনতী মানুষের সংগ্রামের সাথে মিশে আছে যে সংস্কৃতি,তিনি তারই প্রতিনিধিত্ব করেন। মেহনতী মানুষের সংগ্রামে সংস্কৃতি যে মূল হাতিয়ার সেটা সহজেই প্রতিভাত হয়।  বিশেষত তাঁর বই- লড়াই সংগ্রামের গানের ভুমিকা পড়লেও দেখা যায় যে  পাকিস্তান আমলের যত গণসংগ্রাম তাতে সংস্কৃতির ভুমিকা কি ছিলো। সংস্কৃতি যে গণমানুষের মুক্তির হাতিয়ার সে বিশ্বাসের কথা তিনি বার বার প্রমান করেছেন। তার লেখায় চলনে- বলনে মেহনতী মানুষের সংগ্রাম ও তার সংস্কৃতি  সমাজ প্রগতির মূল বিষয় সেটা তিনি প্রমান করেছেন।  তিনি লিখেছেন-‘এ যাবতকালে বাঙালী সংগ্রাম জন্ম দিয়েছে অগণিত গান, নাটক, গল্প, নৃত্যনাট্য, চিত্রকলা। বিদ্রোহ আর বিপ্লবের সময় আর স্থানে, সংগ্রামে আর আন্দোলনে লোকজ সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে এই কালের নানান কবির নানান গাথা, বীরত্বগাথা, চারণকবি মুকুন্দ দাসের স্বদেশী গান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দেশপ্রেমের অগণতি লেখা ও সুর করা গান, কবি কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্যের সুতীক্ষ্ণ কবিতার ধারাল অস্ত্র আমাদের চলার পথে দিয়েছে অবারিত সাহস, অফুরন্ত বৈভব, যা দিয়ে আমরা একাত্তরকে করেছি স্মরণীয় বাঙালী জীবনে, পাকিস্তানী দস্যুদলকে বাইশ বছর পর এদেশ থেকে হটিয়ে, আগ্রাসী শক্তিকে পরাভূত করে।’ বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে অনেক কাজ করেছেন তিনি, লিখেছেন অনেক গবেষনালব্ধ লেখা। এখন নিজের হাতে লিখতে কষ্ট হয়। তাই উদীচীর এক তরুন কর্মী তার কথার শ্রুতি লিখন করেন।


  
মেহনতী মানুষের প্রতিনিধি কামাল লোহানীর জীবন অনেক বর্নাঢ্য । কামাল লোহানী নামেই সমধিক পরিচিত হলেও পারিবারিক নাম তাঁর আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। তাঁদের বসতি ছিল যমুনা পাড়ে। খাস কাউলিয়ায়। আগ্রাসী যমুনা-গর্ভে তাঁদের বাড়িঘর জমি-জিরেত চলে যাওয়ার পর তাঁরা সিরাজগঞ্জেরই উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে পাবনা জেলা স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রাবস্থায় কামাল লোহানীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। 

১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমনের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলায় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষসহ কামাল লোহানী ও অন্যান্য সহযোদ্ধা গ্রেপ্তার হন। ১৯ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কারাবাস। মুক্ত হতে না হতেই আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তার হন। এই কারাবাসকালীন তিনি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে দীক্ষিত হন এবং আজীবন সেই আদর্শে অবিচল রয়েছেন। ১৯৫৫ সালে গ্রেপ্তার হলে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের সঙ্গে একই জেলকক্ষে বন্দিজীবন কাটান।১৯৫৮ সালে কামাল লোহানী জড়িত হয়ে পড়লেন নৃত্যশিল্পের সঙ্গে।

 ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’-এ একজন কৃতী নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।  ১৯৬২ সালে কামাল লোহানীকে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে ১৯৬৭ সালে রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’ গড়ে তোলেন। ক্রান্তি ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাংগঠনিক তৎপরতায় সহসাই  সংগীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, সুখেন্দু দাশ, আবদুল লতিফসহ অনেক শিল্পী ক্রান্তির পতাকা তরে যুক্ত হন। স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে গণমানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে ক্রান্তি সংগীত পরিবেশন করতে শুরু করে। তিনি ২০১২ সালের ডিসেম্বরে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি পদে আসীন হন। নিরাবেগ বোঝাপড়া নিয়ে এখনও দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে কাটে তার দিন।

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং আন্দোলনের সাথী তাঁরই চাচাতো বোন সৈয়দা দীপ্তি রানীকে ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন। এর পরেই শুরু হল জীবিকার চাপ । কামাল লোহানী বনেদী সংবাদপত্র ‘দৈনিক আজাদ’-এ যোগ দিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ষোল মাসের মাথায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি পিআইবিতে ফিরে আসেন। পিআইবি'র মহাপরিচালক তাঁকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠান। এই সময় রাজনৈতিক অভিযাত্রার পাশাপাশি যুক্ত হল সংস্কৃতি সংগ্রাম। কামাল লোহানী ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটের বিজয়ের পর আবারও দু’বছরের জন্যে শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন  করেছেন।

 তাঁর লেখা প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে, ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘আমরা হারবো না’, ‘সত্যি কথা বলতে কি’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘এদেশ আমার গর্ব’, ‘মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘যেন ভুলে না যাই’,  ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’,  ‘দ্রোহে প্রেমে কবিতার মত’ এবং কবিতার বই ‘শব্দের বিদ্রোহ’। প্রকাশিতব্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘শত্রু বধের উৎসবে’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’ – দ্বিতীয় খন্ড, ‘যেন ভুলে না’ – দ্বিতীয় খন্ড। এছাড়াও তাঁর ঘটনাবহুল সাংবাদিকতা জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজের বানীকে লেখ্যরূপে প্রেস ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ প্রকাশ করেছে ‘অগ্রজের সঙ্গে একদিন’। তিনি বর্তমানে স্মৃতি কথা লেখায় নিজেকে ব্যাপৃত রয়েছেন।

 তার জীবন ও কর্মের  স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি ১৯৯১ সালে। প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা এবং রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা পান তিনি। এ ছাড়া ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর ক্রান্তি স্মারক- ২০০৩, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারক সহ দেশে-বিদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সম্মাননা তাঁর মিলেছে। বাংলা একাডেমী ফেলো কামাল লোহানী জাহানারা ইমাম পদক পেয়েছেন ২০০৮ সালে। ২০১৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি।
কামাল লোহানী ও দীপ্তি লোহানী দম্পতির এক পুত্র ও দুই কন্যা।তিনি তার বড় মেয়ে বন্যা লোহানীর কাছেই থাকেন। শিল্পী সংগ্রামী কামাল লোহানীর জন্মদিনে তার সংগ্রামী জীবন ও কর্মের প্রতি জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য। 

/ডিজি