• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২, ২০১৯, ০৮:৩৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২, ২০১৯, ০৯:১৯ পিএম

গল্প

যদি পারেন, আমার সাথে একটু গল্প করেন

যদি পারেন, আমার সাথে একটু গল্প করেন

কাগজের প্লেনটা নিয়ে সারা ঘর উড়াচ্ছে আর বারান্দায় গিয়ে গ্রীলের ফাঁক গলে বাইরে হাত বাড়িয়ে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে আসছে। এভাবে একে একে দশটা প্লেন উড়িয়েছে। দশ মিনিটে নাকি দশটা প্লেন বানিয়েছে। বলছিল ঈশান। সময় সুযোগ পেলেই বসে যায় পুরনো খাতা নিয়ে। একের পর এক পৃষ্ঠা ছিড়ে ছিড়ে বানিয়ে ফেলে প্লেন, পাখি, ফুল।
ছবি আঁকায়ও পারদর্শী। কোন একাডেমিক শিক্ষা ছাড়াই আঁকে বেশ। প্লেন  আর গাড়ির ছবি বেশি আঁকে। পশু পাখি, আর মানুষের হার্ট ও আঁকে। একদিন মানব সার্কেল একে তাকিয়েছিল বেশ কিছু সময়। আর্ট করে করে আল্লাহু লিখেছে কয়েকটা। সেগুলো প্লাস্টিক দিয়ে বাধাই করে ওয়ালে টাঙ্গিয়ে রেখেছে।


দশ বছরের ঈশান বাইরে খুব একটা বের হয় না। এক স্কুল ছাড়া। বাবা মা ও চায়না  নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে ঘোরাফেরা করুক। যা দিন কাল। হাত বাড়ালেই নেশার দ্রব্য। কোন মানুষের সাথে মিশে কি করবে। মা বাইরে কাজ করে। দেখেশুনে রাখবে কে? তার চেয়ে ঘরে বসেই করুক না কিছু। চার দেয়ালের এই ছোট্ট জগতটা তাই ওর কাছে খুব প্রিয়। নিজস্ব তৈরী একটি স্বপ্নময় জগত। সেখানে খুব বেশি কিছু না থাকলেও আছে টেলিভিশন, কম্পিউটার, খাঁচার পাখি, একুইরিয়ামের মাছ আর টবের গাছ গাছালি। 
পড়ালেখার রুটিন জীবন ওর ভাল লাগে না। স্কুলের ভাল রেজাল্ট করা নিয়ে যা বলে, শুনলে যে কেউ হাসবে। পড়াশুনা করা হয় নাকি শুধু জানার জন্য। জানা শেষ, পড়াও শেষ। এই যে তোমরা এত পড়েছো, কয়টা মনে আছে বলোতো ?


মা বলে, কিন্তু ভাল রেজাল্টেরও তো দরকার আছে। বড় সার্টিফিকেট হলে বড় সম্মান। বড় চাকরী, বড় টাকা।বড় সার্টিফিকেট অর্জন করার জন্য সারাদিন পড়ার কোন প্রয়োজন নেই মা। বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব ভাল করে জানতে পারলেই কিছু লিখে আসা যায়। মার্কসও পাওয়া যায়।রেজাল্ট হয় মধ্যম। প্রথম সারিতে আসতে পারে না। আর একটু চেস্টা করলেই হয়তো পারে। মায়ের চেস্টার কোন অভাব নেই। ছেলে তার ব্যারিস্টার হোক, মনে প্রাণে চায়।পড়ালেখার রুটিন জীবন ভাল না লাগলেও স্কুলে যায় ইশান। পিঠের উপর দশ কেজি ওজনের বইয়ের ব্যাগটা নিয়ে যখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে হাটতে হাটতে স্কুলের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। মায়ের বুকটা হু হু করে উঠে। এত বড় ব্যাগ। এত বই খাতা। সাথে পানির বোতলও। মা বেশি বই নিতে নিষেধ করে। ইশান প্রতিবাদ করে। সব বই না নিয়ে গেলে টিচার মারবে। মা ভাবে ক্লাশে সবার হাতে বই থাকতে হবে। তাহলে ক্লাশ দুএকটা কম হলে হয় না ? 


ইশানের হেটে যাওয়া মা দুর থেকে দেখে। মনে হয় পিঠটা দিন দিন কুজো হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে গিয়ে উঠবে স্কুল বিল্ডিং এর ছয় তলায়। কস্ট করলে শক্ত মানুষ হওয়া যায়, মুরুব্বীরা বলে। কিন্তু মায়ের মন তো সে কথা বোঝেনা। আকুলি বিকুলি করে। সরকার বই কম দেয়ার জন্য স্কুলগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কিন্তু প্রাইভেট স্কুলগুলো যেন বেশি করে বই না দিলে তাদের ব্যাবসা হয় না। ছেলেমেয়ে বইয়ের  বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত। পড়বে কখন? এত এত বই পড়েও কয়টি শহরের ছেলে মেয়ে বিসিএস ক্যাডার হতে পেরেছে? যত বড় বড় সরকারী চাকরী সবই তো ঐ গ্রামের স্কুলের কম বই পড়ে আসা ছেলেমেয়েগুলোই অধিকার করে নিচ্ছে। তাহলে কি শিখাচ্ছে স্কুলগুলো? কি আছে বাড়তি বই এর মধ্যে ?
বিকালে যখন বাসায় ফিরে, ওর মুখটা শুকিয়ে ছোট হয়ে যায়। জুতা খুলে, স্কুল ব্যাগ বিছানায় ফেলে, দ্রুত চলে যায় বারান্দায়। যেখানে খাঁচার ভিতর বন্দি প্রিয় পাখি। ওকে দেখে পাখিগুলিও যেন ছুটাছুটি শুরু করে। জোরে জোরে ডাকতে থাকে। পশু পাখির প্রতি এ তীব্র আকর্ষন মাঝে মাঝে মাকে বিরক্ত করে তোলে।  আরও ছোট থাকতে গরু গরু করে পাগল হয়ে যেতো। এখনও সেই গরু হাস মুরগী। কুরবাণীর  সময় জানালা আর বারান্দা থেকে ফিরানো যায় না। কি জানি ও কি ভবিষ্যতে খামারী হবে? মা  ইউটিউবে খামারিদের নিয়ে প্রোগ্রাম দেখতে দেখতে একজন খামারী সম্পর্কে জানতে পেরেছে, যে কিনা দেশের বাইরে থেকে পড়াশুনা শেষ করে এসে খামারি ব্যবসা শুরু করেছে। মন্দ কি ? 

আমাদের রক্তের ভিতর দাষত্বের একটা গোপন ছাপ রয়ে গেছে। যা থেকে আমরা বের হতে পারি না। তাই পড়ালেখা শেখার সাথে সাথে স্বপ্ন দেখতে থাকি ছেলে আমার বিখ্যাত ব্যারিস্টার হবে। নইলে কোন অফিসের বস। নিজের দেশের সম্পদ ব্যাবহার করে কিছু করলে যে দেশের উন্নতি হয়। কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হয়, সে কথা মাথায়ই আনি না। 
পাখিদের সাথে কিছুক্ষন খেলা করে গোসল খাওয়া শেষ করে ঘুমায় ইশান। প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ি ঘুম থেকে উঠে দেখে মা অফিস থেকে ফিরে রান্না ঘরে ব্যস্ত। ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা শেষ করে বই নিয়ে বসে। আসে টিচার। টিচার চলে গেলে শুরু হয় মায়ের হৈচৈ। মানে পড়ানোর পালা । পড়া আদায় করা হলে ছুটি। ঈশান ছুটি চায় না। পড়া শেষ হলে কিছুক্ষন মায়ের সঙ্গ চায়। গল্প করতে চায়। মায়ের অত সময় কই? মা কত কত  সামাজিক কার্যক্রম  করে। সেখানে তাকে প্রচুর সময় দিতে হয়। 
দিনগুলো কেমন যেন হয়ে গেছে। সবার হাতে মোবাইল ফেসবুক আরও কত কি। কেউ কারো দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসত ও যেন নেই। প্রয়োজন ছাড়া পরিবারের কেউ কারো সাথে দুদন্ড বসে গল্প করে না। আড্ডা দেয় না। আগের দিনগুলির কথা ভাবলে মনটা ব্যাথায় লুটোপুটি খায়। ছুটির দিনগুলোতে সবাই একসাথে বসে কত রকম গল্প-গুজব করা হতো। লুডু , দাবা খেলা জমতো। যার মজা এখনকার ছেলেমেয়েরা বুঝলোই না। 


ঈশানের  মোবাইল ধরা মানা। কম্পিউটারেও সময় বেধে দেয়া। সেই বেধে দেয়া সময়ে গুগল ঘেটে ঘেটে স্পেস নিয়ে কত কি যে দেখে। আর সেসব খুঁজে নেয়া বিষয়গুলো অন্য কাউকে জানাতে না পারলে ওর পেট যেন ফুলে উঠে। নিজের বাহাদুরিটা গোপন রয়ে যায়। ছুটে যায় বোনের কাছে। বোনের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে। সেও পুরো মাত্রায় নিজের রঙিন জগতে মাতোয়ারা। ছোট ভাইকে সময় দেয়ার মতো পানসে কাজ কি তার দ্বারা সম্ভব? ঈশান ঘরময় ঘোরে। বাবা, বাবা বলে ডাকে। বাবা টিভি দেখায় মগ্ন। পাশে বসে খানিক বক বক করে চলে আসে।কম্পিউটারে বেধে দেয়া সময়ের বাইরের বাকি সময়টা তাকে ভাবতে বলা হয়েছে। সৃষ্টিশীল কিছু ভাবুক। তা কি আর হয় ? ঘুরে ফিরে ঈশান মায়ের কাছে আসে। এটা সেটা বলে একমনে বক বক করে চলে। মাঝে মাঝে বিরক্তি ঝাড়ে। শুনছো কিছু? আমি কি বলেছি শুনছো ? বলতো ?একদিন দেখা গেল সারা ঘরের ওয়ালে ওয়ালে কাগজে লেখা ‘যদি পারেন আমার সাথে একটু গল্প করেন।’ এমনকি ওর প্রিয় পাখির খাঁচার সামনেও একটা ঝুলছে। সেখানে লেখা, ‘শুধু তোমাদেরকে ধন্যবাদ। তোমরাই আমাকে সময় দাও। আর কেউ না।’


লেখাটা দেখার পর মা ঈশানকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। নিজের জন্য মনে মনে একটা রুটিন তৈরী করেছে। সেখানে ঈশানের সাথে গল্প করার জন্য ওর মনের কথা শোনার জন্য ওকে সঙ্গ দেয়ার জন্য কিছুটা সময় রেখেছে।কখনও কখনও ইশানকে বাসায় একা থাকতে হয়। বাবা মা বোন যার যার কাজে বাইরে গেছে। হয়তো স্কুল বন্ধ। ইশান খাঁচাশুদ্ধ পাখি ঘরে নিয়ে আসে। সারা ঘর খাবার ছড়িয়ে খেতে দেয়। কিন্তু পাখি গুলোকে বের করার সাহস পায় না। যদি উড়ে যায়। মাঝে মাঝে খাঁচার ভিতর হাত ঢুকিয়ে খাবার খাওয়াতে চেষ্টা করে। পাখি খাওয়ার পরিবর্তে আঙ্গুলে ঠোকর দেয়। তবু হাত পেতে ধরে রাখে।এতদিনে জেনে গেছে এই পাখিরা গাছের পাতা খায়। ছোট্ট টবের বেতগাছটা তাই ন্যাড়া। তুলসির ডাল ভাঙে। সেটা নিয়ে খাঁচার ফাঁক গলে ওদের মুখের কাছে ধরে। পাখি গুলো ঠোকরায়। মন দিয়ে যখন ঠোকরাতে থাকে তখন সেটাকে টেনে নিয়ে যায়। থ মেরে পাখি গুলো বসে থাকে । আবার মুখের কাছে ধরে। আবার টেনে নিয়ে যায়। পাখির বোল্ড হওয়া দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে। এভাবে অবুঝ পাখিরা দিনে দিনে ওর সঙ্গী হয়ে যায়। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে একটি পাখি খাঁচার ভিতর চিৎ হয়ে পড়ে আছে। ঈশান ভাল করে দেখে। জীবিত আছে কি না।  কাঠি ঢুকিয়ে গায়ে আলতো করে খোঁচা দেয়। পাখি নড়ে না  শিওর হয় ঈশান। পুরুষ পাখিটা মরে গেছে। খাচা থেকে বের করে একটা শক্ত কাগজের উপর রেখে দেয়, সারা বিকাল, সারা রাত। পরদিন স্কুলে যায় না। আর সবাই যার যার কাজে বের হয়ে গেছে। ঈশান একটি ছোট্ট চিরকুট লিখে লটকে দিয়েছে মরা পাখির পায়ে। 


রাত বেড়ে যাচ্ছে। পচে গন্ধ ছড়াবে। পাখিটাকে ফেলে দেয়ার জন্য বললে, ইশান রাজি হয় না। মায়ের দৃষ্টিগোচর হয় পাখির পায়ের চিরকুটটি। খুলতে দেখলে রেগে যাবে তাছাড়া মনটাও খারাপ। মা। চুপিসারে খুলে একঝলক দেখে নেয় লেখাটা। Thank You, bye,   একটা ছবিও তুলে রাখে মোবাইলে। মনে মনে ভাবে কত অভিমানেই না কথাটা লিখেছে। মায়ের বুকে মোচড় খায়।  রাতে অনেক অনুরোধ করার পর টবের মাটিতে নিজের হাতে সেটাকে পুতে দেয়। কবরের উপর দুটি তুলসি চারা লাগিয়ে রাখে।
আজ  ঈশানকে নিজের কাছে কাছে রাখছে মা। ইচ্ছা, ভিতর থেকে কষ্টের অনুভূতি বের করে আনা। পাশে বসিয়ে বলে,ঈশান, তুমি যে চিরকুটটা ওর পায়ে বেঁধে দিয়েছো। সেখানের লেখাটা পড়ে আমার বুকের ভিতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠেছিল। 
ঈশানের মুখ ভার, কিছুই বলে না।
তোমাকে আমি আরও একজোড়া পাখি কিনে দিব। কষ্ট পেও না। ধীরে ধীরে ঈশান স্বাভাবিক হয়ে বলে, জানো মা, ঐ কথাটা আমি কেন লিখেছি ? মা মনে মনে ভাবে ছেলে আমার হালকা হতে শুরু করেছে।
কেন লিখেছো ?
পাখিটা আমাকে এতদিন সঙ্গ দিয়েছে তাই ওকে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলেছি। আর আমার কাছ থেকে তো চিরদিনের জন্য চলে গেলো, সেজন্য বলেছি, ‘বাই’। 
আমার টবে পুতে রেখেছি এইজন্য যে, মনে হবে পাখিটা আমার কাছেই আছে।
কথাগুলো শুনে মায়ের  চোখ ভিজে যাচ্ছিল। 

/ডিজি