• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০১৯, ০৪:৪৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৭, ২০১৯, ০৪:৫৩ পিএম

কবি শামসুর রাহমানের দু’টি ‘কবিতা’ লেখার গল্প

কবি শামসুর রাহমানের দু’টি ‘কবিতা’ লেখার গল্প

বাঙালির স্বাধীকার, মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তী বিভিন্ন গণসংগ্রাম নিয়ে যে ক’জন কবি কবিতা লিখেছেন তাদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান অন্যতম। তার লেখনীর মধ্য দিয়ে তিনি তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গাঁথা। কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা ফুটে ওঠে তার কবিতার পরতে পরতে। শামসুর রাহমানের কবিতা তার বাস্তব প্রমাণ। তার লেখা ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখা। শুধু ‘স্বাধীনতা তুমি’ নয় ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে তার কবিতা ‘আসাদের শার্ট’সহ বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে তিনি তার কবিতা দিয়ে তিনি এভাবেই ঋদ্ধ করে রেখেছেন, যে স্বাধীকারের সংগ্রামে তার কবিতা কখনও কখনও ভাষা যোগাতো সংগ্রামী মিছিলের।

বাংলা কবিতার সুদীর্ঘ যাত্রা পথে শামসুর রাহমান একটি অধ্যায়। গণসম্পৃক্ত সেই কবির আজ ১৩ম প্রয়াণ দিবস। এ দিবসে কবিকে যেভাবে স্মরণ করা উচিৎ তা হচ্ছে না। অথচ নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে গঠিত কবিতা উৎসব কমিটির তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক এবং কমিটির সভাপতি। আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, শামসুর রাহমান বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তাকে কবিশ্রেষ্ঠ বলা হতো। দুই বাংলায় তার জনপ্রিয়তা ও শ্রেষ্ঠত্ব সমান্তরাল ধারায় প্রতিষ্ঠিত। কবিকে প্রথম দেখেছিলাম বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করার সময়। পোশাক-আশাক কি ঝলমলে! মানে ওই বয়সেও তিনি ছাপা কাপড়ের শার্ট পরতেন, ডান হাতে বাঁধতেন ঘড়ি। আমৃত্যু তার এ পোশাকই ছিলো।

    কবি শামসুর রাহমানের আত্মজীবনী ‘কালের ধূলোয় লেখা’ বইটিসহ তার আরো ৪টি বই সম্পাদনা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তখন তার গভীর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। প্রতিদিন তার বাসায় যেতাম, খেতাম, আড্ডা দিতাম। প্রাণ খুলে কথা বলতাম তার সঙ্গে। তার আচার ব্যবহারে মনে হতো, তিনি এক আশ্চর্য দেবশিশু। কী সাধারণভাবে লাজুক ভঙ্গিতে বলতেন, ‘ভাই কাল রাতে একটা কবিতা লিখে রেখেছি, তোমাকে না দেখিয়ে কাউকে দেইনি। তুমি একটু দেখে দাও। ভাই, দেখ, ভালো না লাগলে সত্যি করে বোলো কিন্তু। খারাপ হলে খারাপ বোলো। আমি একটুও কষ্ট পাবো না, রাগও হবো না। কবিতাটা তো ভালো হওয়া চাই।’ 
    তারপর যখন কবিতাটা পাঠ করে বলতাম, ‘রাহমান ভাই, চমৎকার কবিতা!’ তখনও তিনি এক দেবশিশুর মতো হাসতে হাসতে বলতেন, ‘সত্যি বলছো তো ভাই? দেখ, আমি কিন্তু তোমাকে খুব বিশ্বাস করি।’ রাহমান ভাই’র এই শিশুসুলভ আচরণের মধ্যে কোনো ভণিতা ছিল না। তিনি কখনো কারো ওপর রাগ করেছেন, এমনও আমি দেখিনি। রাহমান ভাই’র বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ কীভাবে লেখা হলো এ কাহিনী আমি তার কাছ থেকে শুনেছিলাম।

তিনি বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে যখন পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালিদের ওপর নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালাতে শুরু করে তখন মানুষ হতভম্ব হয়ে যায়। রাহমান ভাইদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন সবাই ধীরে ধীরে একত্রিত হয়। তারপর তারা তাদের গ্রামে বাড়ি নরসিংদীর পাড়াতলীতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ওখানে রাহমান ভাই নিজেকে খুব অসহায় মনে করতেন। একদিকে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে বর্বর বাহিনী, তারা পাহাড়ে, নগরে, গ্রামে- সবখানে খুনের রাজত্ব কায়েম করছে। হেমন্তের পাকা ধানের মতো লাশ ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে, সারা দেশে চলছে গণহত্যা। এর মধ্যে গড়ে উঠতে শুরু করেছে প্রতিরোধ যুদ্ধ।

রাহমান ভাই বাড়ির পাশের গাছ তলায় দাঁড়িয়ে দেখতেন কৃষাণ-শ্রমিক-মুটে-মজদুর সবাই প্রশিক্ষণ নিতে চলে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে। তিনি নিজেকে খুব অসহায় মনে করতেন। কারণ তিনি সম্মুখ-স্বশস্ত্র যুদ্ধে যেমন অংশগ্রহণ করতে পারছিলেন না, আবার মেনে নিতেও পারছিলেন না পাক-বর্বর বাহিনীর এই গণহত্যা। এমন এক অবস্থায় তাদের ঘরের পাশে একটা গাছতলায়, যেখান দিয়ে মানুষজনের হাঁটা চলা দেখা যায়, দেখা যায় এক নৌকায় পারাপার হচ্ছে মানুষ, ধানক্ষেত আরো কত কী। ওই গাছতলায় বসেই তিনি লিখে ফেললেন মুক্তিযুদ্ধের অমর কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি।’

এরপর একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটা কীভাবে লেখা হয়েছিল? রাহমান ভাই বললেন, ‘তখন আমি দৈনিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদক। ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন দুঃসাহসী ছাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ সভা করছে, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শোভাযাত্রা বের করছে। কয়েক হাজার পুলিশ, ইপিআর সেই মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই সাহসী তরুণেরা প্রত্যেকেই কমবেশি আহত হয়ে বন্দি হয়েছিল সেদিন। ২০ জানুয়ারি ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা পদদলিত করে অকুতোভয়ে পুলিশ-ইপিআরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সেদিন জনতার মারমুখী প্রতিবাদের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল পুলিশ। অকেজো হয়ে যায় কাঁদানে গ্যাস।

 সব বাধা অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন থেকে বেরিয়ে যায় বিরাট শোভাযাত্রা শহীদ মিনারের দিকে। তারপর শহীদ মিনার হয়ে মেডিকেল কলেজের দিকে। সেদিন সেই শোভাযাত্রা গুলি করা হয়। আমি বাসায় বসেই শুনলাম, একটি মিছিলে গুলি চালানো হয়েছে। সেই মিছিলের অন্যতম নায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান মেডিকেল কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তারপর জনতা আসাদের লাশ ছিনিয়ে মুখোমুখি লড়ছিল সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে। ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল তারা। শেষ পর্যন্ত জনতা আসাদের শার্ট ছিনিয়ে নেয়। আমি যখন গুলিস্তান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন দেখছিলাম, ছাত্র-জনতা মিলে একটা লাঠির সঙ্গে আসাদের রক্তমাখা শার্ট ঝুলিয়ে মিছিল করছে। দৃশ্যটি আমাকে ভীষণ আহত করেছিল। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। অফিসে গিয়েও আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না। বারান্দা দিয়ে কী এক উদ্বিগ্নতা নিয়ে বারবার হাঁটছিলাম। তারপর এক সময় কাগজ-কলাম নিয়ে বসলাম। লিখলাম আসাদের শার্ট কবিতাটি।’

রাহমান ভাই বারবার বলতেন, ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি আবৃত্তি করতে। কিন্তু এটা আমার জন্য একসময় বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ায়। রাহমান ভাই’র কোনো কবিতা সুন্দর করে পড়লেই তার চোখ জলে ভিজে যেত। তিনি বলতেন, ‘ভাই আমি মরে গেলে এই কবিতার কথা কি কেউ মনে রাখবে?’ আমি বলতাম, ‘রাহমান ভাই, বাংলা সাহিত্য যতদিন টিকে থাকবে ততদিন কবি শামসুর রাহমানের কবিতা টিকে থাকবে।’

রাহমান ভাই আশ্বস্ত হতেন। তাকে নিয়ে এ রকম অজস্র স্মৃতি, অজস্র কথা এখনো আমার কানে বাজে। রাহমান ভাই একদিন হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তার প্রথম ভালোবাসার গল্প। আরো অনেক কথা বলেছিলেন, কিন্তু শর্ত ছিল তার জীবদ্দশায় কাউকে বলা যাবে না। কিছুদিন পর শুনলাম, রাহমান ভাই ভীষণ অসুস্থ। শুনেই বাসায় গেলাম। রাহমান ভাই আমার কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকালেন। মনে হলো অনেক কথা বলতে চাইছেন। যেসব কথা কখনো বলা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন তিনি চলে গেলেন অমৃতলোকে। তার সেই অনেক কথা আমার আর জানা হলো না।

রাহমান ভাইয়ের প্রয়াণের পরে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার ‘যুগান্তর’ পত্রিকা থেকে একটা এ্যাসাইনমেন্ট দিলেন তার ওপর একটা স্টোরি করার। সেই স্টোরি আমি করেছিলাম। বিষয় ছিল, রাহমান ভাই’র সেই কক্ষটি, যেখানে বসে তিনি কথা বলতেন, আড্ডা দিতেন, গল্প করতেন, লিখতেন— সেই ঘরটির বিবরণ। স্টোরির নাম ছিল— কবি শূন্য কবিতা ঘর। ২০০৬ সালের এই দিনে (১৭ আগস্ট) তার মহা প্রয়াণে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি কবির অমর কীর্তি। জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।