• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০১৯, ০৬:৩১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৮, ২০১৯, ০৬:৩২ পিএম

গল্প

নামকরণ

নামকরণ

বাস থেকে নেমেই ছাউনি খোঁজে ফিজার। ঘন অন্ধকারে কোথাও ঠাহর করা যায়না। কোনো আলো নেই। আলোর জন্য হঠাৎ করে আসতে থাকা নাইট কোচের আলোই ভরসা। এসি বাস থেকে নেমে বৃষ্টির পানি মাথায় চাপায় অস্বস্তি লাগছে। ভাগ্যিস হাতে ব্যাগ নেই। । গভীর রাতে বাস থেকে অচেনা অজানা একটা জায়গায় নেমে পড়ার ঝক্কি তো আছেই। রাস্তা বুঝে নিয়ে বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছে সে। কাটাখালী কেন নামলো? যাবে তো জুবেরি।

এই যে স্থানিক নাম, ওর খুব ভালো লাগে। যদিও নাম বদল হয় খুব এ দেশে। জায়গা, স্থাপনা, সম্পর্ক, মানুষ কিছুই বাদ যায় না, আবার হয়তো এক সময় নামই থাকে না। তখন কোনো এক হতভাগা এসে নামকরণ করে, আমজনতা তাতেই অভ্যস্ত হয়। জিরো পয়েন্ট কোনো নাম হতে পারে? অবশ্য শুরুটা মাঝখান থেকে হয় বলেই না বিজ্ঞানভিত্তিক নাম জিরো পয়েন্ট। তবু কেন জানি এই নামকরণে দূরদর্শিতার অভাব আছে, এটা বরং মিডল পয়েন্ট নাম দেয়া যেতো। না, সেটাও বা হবে কেন? বাংলায় কি আর নাম হয় না? আমরা কি নামহীনতায় ভুগছি? ভুগছিই তো।

ওর নিজের নাম ফিজার, বাবা রেখেছেন। কিন্তু সবাই জানে এটা ওর আসল নাম নয়। আসলের বিপরীত তো নকল। তাহলে লোকে কি ওকে নকল নামে চেনে? সার্টিফিকেটে ফিজারের নাম স্নিগ্ধ আকতার। স্কুলে নামের জন্য ওকে সবাই বুলি করতো। তাই কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে ও আসল নামটা বলে না, ডাক নামটাই বলে দেয়।

মেজাজ খিচড়ে গেছে। তার ওপর বেড়েছে বৃষ্টির বেগ। রাত প্রায় শেষ, ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। সকাল উঁকি দেবার আগে আগে আবছা আলোয় বড় রাস্তার ওপারটা অদ্ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। সিগারেট বের করলো পকেট থেকে। প্যাকেটের ওপরে পলির আস্তর থাকায় সিগারেট ভিজেনি, কিন্তু দেশলাই ভিজে গেছে। সিগারেট ধরানোর উপায় নেই। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল না ওর। স্মরণিকাই জোর করতো সিগারেট খেতে। এমনি এক ভেজা বৃষ্টির রাতে ফিজারের জন্মদিনে এলাচ মেশানো সিগারেট আর লাইটার নিয়ে এসে হাজির। আহ্সান উল্লাহ হলের দারোয়ান গভীর ঘুমে অচেতন। জসিম মামু গেটে ছিল। ১১৪ নম্বরে দরজা ধাক্কাচ্ছে। ‘মামা ওঠেন, আপায় আইছে’। 

সারারাত হল আড্ডার পর শেষ রাতে চোখটা সবে বুজে এসেছিল, কিন্তু স্মরণিকার কথা শুনতেই হুড়মুড় করে উঠে বসলো ফিজার। মামুনকে ডাকলো। মামুন ফিজারের প্রাণের বন্ধু, গলা জড়াজড়ি করে ঘুমায়। মামুন অঘোরে বেঘোরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সাড়া না পেয়ে চোখ ডলতে ডলতে গেস্ট রুমে এলো। এই বৃষ্টির রাতে তুমি? স্মরণিকা কথা বলে না। যদিও এভাবে এতোরাতে হলে আসার নিয়ম নেই। কিন্তু নিয়ম তো আবার নিয়ম ভাঙার জন্যই তৈরি হয়। জসিম মামু সকল অসাধ্য সাধনকর্তা। এককালে প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছিল কিনা! মামু গেস্ট রুমের সামনের চেয়ারে নাক ডাকছে তখন। দু’হাত দূরত্বের সোফায় বসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে স্মরণিকার দিকে, হাতে শরৎ রঙের ফুল ছাপিয়ে কাচের চুড়ির দিকে দৃষ্টি যায়। সুনসান গেস্ট রুমে চার চোখ আর নিঃশ্বাসের দ্রুতলয়, নির্ভরতার সূত্র মেনে চুড়ি ভাঙে, হাতে বিঁধে যায়।

 বাইরে তখনো টিপটিপ বৃষ্টি। ‘শুভ জন্মদিন’ বলে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে স্বরণিকা দ্রুত বেরিয়ে আসে হল থেকে। আজও সেরকম বৃষ্টি। স্বরণিকার হাতে চুড়ির দাগটা কি আছে এখনো? আছে হয়তো। অনুভবের ক্ষত কি শুকালো? ফজরের নামাজ শেষে মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বের হচ্ছেন। চারদিকে আলো ফুটে উঠেছে। হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় পদ্মার বাঁধে উঠে পড়লো সে। প্রমত্তা পদ্মার দিকে চোখ যেতেই বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। দু’একটা রিকশা দেখা যাচ্ছে, জুবেরি বলতেই উঠে বসলো। অন্য সময় অবশ্য চেনা না চেনা দরদাম নিয়ে কথা হতো, আজ সে হিচিংয়ে গেলো না। দিশার কাছে দ্রুত পৌঁছাতে চায় ফিজার।

 দিশার কাছে পৌঁছাবার জন্যে মনের ভেতরের গতি দ্রুতগামী রিকশার চেয়েও বেশি আজ। ঠাণ্ডা বাতাস বুকে এসে লাগছে, ফিজার ভাসছে নবাগত আহ্বানে। স্মরণিকা ফিজারের ছন্নছাড়া জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। প্রথমদিকে যোগাযোগ কিছুটা কমিয়ে দিলেও এখন পুরোপুরি বন্ধ। মাত্রাতিরিক্ত নারীঘেঁষা ফিজারকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারেনি কখনো। ফিজারও যে খুব বিশ্বস্ত হতে চেয়েছে তাও নয়। জীবন কতো বিচিত্র! 

দিশার সাথে পরিচয় বেশিদিনের না। দেখাও হয়নি। গতকাল ফোনে কথা বলতেই বলতেই হঠাৎ দেখার ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। বাসে উঠে পড়লো সে। দিশাকে চমকে দিতেই এভাবে আসা। একটা সময় স্মরণিকা এভাবে চমকে দিতো ফিজারকে। ফিজারও আজ সে রাস্তা ধরেছে। নামকরণ, নাম পরিবর্তন, আসল নাম, নকল নাম, পুরাতন প্রেম- এইসব নানা আবর্তে ঠোকর খেতে খেতে মানুষ কি আস্তে আস্তে বোধহীন হয়? একের স্থলে আরেক খুব সহজেই মানিয়ে যায়। হঠাৎ এভাবে চলে আসায় দিশা কি বিরক্ত হবে? হলে হোক।

ঘড়ি দেখে নিলো। ৫টা ৩০ মিনিট। শান্ত স্নিগ্ধ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সৌন্দর্য পথে পথে। বিস্তীর্ণ মাঠ, অতিকায় গাছ। রিকশা থামলো আম গাছতলায়। এখন কি ডাকবে? ফোন করলো দিশাকে। গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করে এলে মন্দ হতো না। কিন্তু এখানে আসার কথা তো আগে থেকে ঠিক করা ছিল না। দিশা আসছে এইদিকে। নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে নিলো, এভাবেই শুরু হলো ফিজারের অন্য গল্প, সে গল্পের নতুন নামকরণ।