• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০১৯, ০৪:৩৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২৭, ২০১৯, ০৫:৫৬ পিএম

মাগধী বা গৌড়ীয় প্রাকৃতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কি?

মাগধী বা গৌড়ীয় প্রাকৃতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য  কি?

মাগধী প্রাকৃত: মগধের একটি ভাষা অঞ্চল আর গৌড়ীয় প্রাকৃত হলো গৌড়ের একটি ভাষা অঞ্চল। মাগধী ভাষা অঞ্চল : মগধ অঞ্চলের ব্যবহৃত ভাষাকে মাগধী আর গৌড় অঞ্চলে ব্যবহৃত ভাষাকে গৌড়ীয় মাগধী প্রাকৃত ভাষা বলা হয়। মগধ আর গৌড়ের  রাজনৈতিক অবস্থা বিচারে বলা যায়, দুটি রাজ্যের উত্থান কাছাকাছি সময়ে এবং মগধ থেকে কোনো জাতি বা মাগধীয় কোনো জনগোষ্ঠী গৌড়ে এসে বসতির সূচনাও করেনি। এ দুই অঞ্চলের বসতির সূচনা সুপ্রাচীন কালের। কোনো জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীর দ্বাড়া ভাষা-সংস্কৃতিতে দায়বদ্ধ নয়, হয়ে কিছু হয়েও থাকে উভয়ে উভয়ের কাছে। গ্রিয়ার তাঁর ‘ল্যাগোয়েজ সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র কাজের সময়ের কাজের সুবিধাংর্থে ভারতকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন অঞ্চলের দায়িত্ব প্রদান করলে, পরবর্তীতে সে অঞ্চলের নামেই তিনি আঞ্চলিক ভাষার নামকরণ করেন।

জর্জ গ্রিয়ার সনের সেই নামকরণ থেকেই পরবর্তীকালে ভারতীয় ভাষার নাম; তারই দুটি অঞ্চল মাগধ এবং গৌড়। গ্রিয়ার সনের এই নামকরণ থেকে কোনোভাবেই প্রমাণ করে না যে, একদল লোক প্রথমে মগধে বসতি স্থাপন করে, পরে গৌড়ে এসে বঙ্গভাষার জন্ম দিয়েছে। বরঞ্চ সেক্ষেত্রে গ্রিয়ার সন এগিয়ে যে, তিনি প্রত্যেক কাছাকাছি ভাষাকে একটি পরিবারের উঠান করেছে এবং সেই উঠান ঘিরে, উঠানের চার পাশে অনেক ভাষা পরিবার গড়ে উঠেছে। এমতাবস্থায়, কোন যুক্তিতে মগধের ব্যবহৃত ভাষার সাথে গৌড়ের ভাষার পরের ধাপ নিরুপন করা হলো তা আমাদের বোধগম্য নয়। মাগধী প্রাকৃতের পরের ধাপ গৌড় প্রাকৃত হলে গৌড়ের পূর্বতন বসতি রাজনৈতিক ইতিহাস সব মিথ্যা হয়ে যায় অথবা তাঁকে (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্) প্রমাণ করতে হবে যে, গৌড়ের ভাষার মাগধীযুক্ত হওয়ার আগে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা ছিলো। তা যেহেতু করা হয়নি, সুতরাং আমরা বলতে পারি তাঁর এ পর্ব বিন্যাস ছিলো যুক্তিহীন, অপ্রয়োজনীয়।

বলা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের বঙ্গাঞ্চলের একটি উঠুনের চারপাশে বহুঘর। প্রত্যেক ঘরের বাসিন্দারা একই উঠানে একই সরঞ্জামে রান্না করে কিন্তু স্বাদ হয় ভিন্ন। ভাষার এ স্বাদ ছাড়া বৃহৎ বঙ্গে ভাষার মৌলিক আর কোনো পার্থক্য চোখে পরে না। আঞ্চলিক উচ্চারণে বস্তুর নাম পরিবর্তন হয়নি। হয়েছে উচ্চারণের পরিবর্তন। ‘আয় যাই নাহাইগা’ দক্ষিণ টাঙ্গাইল; চট্টগ্রামে হয়েছে- ‘আইনাই’; প্রমিত বাংলায় বলা হবে, -এসো গোছল করে আসি।
ভাষার এমন গঠন প্রকৃতি দেখে স্পষ্টই বলা যায়, আঞ্চলিক ভাষাই প্রকৃত ভাষা এর কোনো উপভাষা নেই। আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে গ্রন্থবদ্ধরূপ দেয়াকেই বলা হয় ভাষা বা প্রমিত ভাষা। যেমন: বাংলা ভাষা। বঙ্গাঞ্চলের সমস্ত অঞ্চলের প্রমিত রূপ।

কোনো প্রমিত ভাষার কোনো উপভাষা থাকতে পারে না। কেন না, প্রমিত ভাষা গঠিত হয় আঞ্চলিক ভাষাকে স্তম্ভ করে। তবে, আঞ্চলিক ভাষার উপভাষার অবস্থানকে আস্বীকার করা যায় না। যেমন: চট্টগ্রামের ভাষার সাথে নোয়াখালীর; নোয়াখালীর ভাষার সাথে কুমিল্লার ভাষা নিকটবর্তী ভাষা বা উপভাষা। আজকের প্রমিত বাংলা ভাষার সাথে অহমীয়া বা অহমীয়া ভাষার সাথে বাংলা উপভাষা বা নিকটবর্তী ভাষা বলে দাবী করা যেতে পারে। তাই বলে প্রমিত বাংলা উপভাষা রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রামের ভাষা এটা থাকা উচিৎ নয়। মাগধী প্রাকৃত ও গৌড় প্রাকৃত যে সময় গৌড় ছিলো সে সময় মগধও ছিল। বর্তমান গয়া, পাটনা আর বঙ্গের কিছু কিছু অংশ নিয়ে মগধ রাজ্যের শাসনাধীন। প্রথমে ‘রাজগৃহ’ পরে ‘পাটলিপুত্র’ ছিলো মগধের রাজধানী।

‘কর্ণসুবর্ণ’ গৌড়ের রাজধানী শঙ্কনরেন্দ্র গুপ্তের হাত ধরে পালেরা এ রাজ্যের শাসনকর্তা। এর অবস্থান বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর পূর্বাঞ্চল বৃহত্তর বগুড়া, চাপাইনবাবগঞ্জ, মালদহ জেলা এর মূল ভূভাগ। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দিতে মগধের পতন আর গৌড় টিকে ছিলো প্রায় খ্রিস্টীয় দশক শতক পর্যন্ত। তাই বলার সংগত কারণ আছে যে, গ্রিয়ার সনের মাগধের প্রাকৃত আর ড. শহীদুল্লাহ্ গৌড় প্রাকৃত একই ধারাবাহিকতার ফসল নয়। রাজনীতিতে রাষ্ট্রসীমা পরিবর্তন হলেও মানুষের ব্যবহার্য ভাষার বিশেষ কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। উচ্চারণে সামান্য পরিবর্তন রাজনৈতিক সীমার কারণে নয়, তা একান্তই ভৌগোলিক সীমার কারণে। আর এমতাবস্থায় ভাষা তার আপন অবস্থানে সব সময় ঠিক ঠিক টিকে থেকেছে।

মগধের মানুষ যেমন কোনো এক ভাষা ব্যবহার করতো তেমনি গৌড়ের লোকও তাদের ভাষা ব্যবহার করতো বঙ্গের লোকেরাও ঠিক তাই করতো। এরা কেউ ভাষাহীন ছিলেন না। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকের বঙ্গ তার নিজস্ব স্বাধীনতায় জীবন যাপন করেছে। কটিল্যের অর্থশাস্ত্রে (৩৫০ - ২৮৩ খ্রিস্টপূর্ব) বঙ্গ, পুন্ড্র, কামরূপ ও গৌড় আলাদা আলাদা রাজ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। সুতরাং যে অঞ্চলটুকু যে রাজ্য ভোগ করেছেন- সেই অঞ্চল, সেই অঞ্চলের ভাষা আর জনগন একই নামে চিহ্নিত হয়েছে। সুতরাং মাগধী প্রাকৃত, গৌড় প্রাকৃত হয়ে বাংলা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।