• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০১৯, ০৮:৫১ এএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১৩, ২০১৯, ০৯:৩০ এএম

​​​​​​​কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ

​​​​​​​কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

যদি প্রশ্ন করা হয় এই উপমহাদেশের কথার জাদুকর কে, নিশ্চয় উত্তর আসবে তার নাম। তিনি আর কেউ নন। আমাদের পরমপ্রিয় কথাশিল্পী হুুমায়ূন আহমেদ। বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখা, চরিত্র নির্মাণ, গল্প তৈরি, লাগসই সংলাপ রচনা— এ সব কিছু মিলিয়ে তিনি এক অভিনব ধারা সৃষ্টি করেন, যে শৈলী একান্তই তার নিজস্ব। রসবোধের কারণে তার রচনা খুব সহজেই পাঠকের মন জয় করে নিয়েছে।

দেশের কথাশিল্পে গতানুগতিক ধারাকে অতিক্রম করে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন এক নিজস্ব ভুবন। সফল লেখক হিসেবে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বুদ্ধিদীপ্ত বিচরণ তাকে এনে দেয় অভাবনীয় জনপ্রিয়তা। গল্পের ভেতর বিচিত্র মানুষের সন্নিবেশ তার রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

‘‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে/ রয়েছ নয়নে নয়নে/ হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে/ হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানের এই ক’টি চরণ খুবই পছন্দ করতেন বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। শহীদ পিতা ফয়জুর রহমানের কবরে এপিটাফে চরণ দুইটি খোদাই করেছেন তিনি। ‘লীলাবতী’ নামে হুমায়ূন আহমেদের এক কন্যা জন্ম নিয়েছিল দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের গর্ভে। সন্তানটি জন্মের সময় মারা যায়। এই মেয়ের নামে নাম রেখেছেন দিঘির। তার পাড়ে শান-বাঁধানো ঘাটের পাশে মার্বেল পাথরে লিখে রেখেছেন এপিটাফ, রবীন্দ্রনাথের লেখা এই চরণ দুইটি। কবিগুরুর কথাগুলোর মতোই তিনি আজ নেই নয়নের সম্মুখে। কিন্তু সবার অলক্ষ্যেই তিনি রয়ে গেছেন সকলের নয়নে নয়নে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়_‘‘বাসনার বশে/মন অবিরত/ধায় দশ-দিশে পাগলেরও মত/স্থির আঁখি তুমি/মরমে শতত-জাগিছো শয়নে স্বপনে...’’।

হুমায়ূন আহমেদ (জন্ম -১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ :: মৃত্যু - ১৯ জুলাই ২০১২)

হুমায়ূন আছেন হুমায়ূন নাই 

দেখতে দেখতে কেটে গেল জননন্দিত এই কথাশিল্পীর মহাপ্রয়াণের ৭ টি বছর। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ক্যান্সার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি নিউ ইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী সব বাঙালির হৃদয়ে গভীর শোকের অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছিল। ওইদিন বাংলাদেশে প্রায় মধ্যরাতে খবর আসে তিনি আর নেই। সব গণমাধ্যম পরদিন তার মৃত্যুর খবর পরিবেশন করেছিল শোকাবহ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে।

মাত্র ৬৪ বছরের জীবনে হুমায়ূন আহমেদ বাংলা কথাসাহিত্যের অঙ্গনে, টেলিভিশন নাটক আর চলচ্চিত্রাঙ্গনে এমন জনপ্রিয়তায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। তার মতো অতুলনীয় পাঠকপ্রিয় ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, নাট্যকারের শূন্যতা যে কখনও পূরণ হবে না— তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। বাংলা একাডেমি আয়োজিত ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশের গ্রন্থমেলায় প্রকাশকরা যে বিপুলসংখ্যক বই প্রকাশ করেন, সব বই মিলিয়ে যা বিক্রি হতো, একা  হুমায়ূন আহমেদের লেখা বই তার প্রায় সমান বিক্রি হতো। তার মহাপ্রয়াণের ৭টি বছর পরও অব্যাহত রয়েছে। এখনও তার বই কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন পাঠক-সাধারণ। 

নন্দিত নরকে এবং একজন লেখকের আর্বিভাব

তিনি এদেশের সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশনাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বিপুল পাঠকপ্রিয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে। ভারতীয় বাংলা গল্প, উপন্যাসে নিমগ্ন পাঠকদের বাংলাদেশি লেখকদের বই পড়তে বাধ্য করেছিলেন তার আশ্চর্য জাদুকরি গল্পের জালে জড়িয়ে। মোহাবিষ্ট পাঠক হুমায়ূন আহমেদের রচনায় মধ্যবিত্ত জীবনের হাসি-কান্নার এমন নিবিড় পরিচয় পেয়েছেন, যেখানে তাদের নিজেদেরই জীবনের ছবি প্রতিবিম্বিত।

মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর ১৯৭২ সালে ‘নন্দিত নরকে’ শিরোনামে ঢাকা থেকে বের হয় একটি উপন্যাস। উপন্যাসটি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি বাঙালি মধ্যবিত্ত পাঠকদের মন জয় করে নেয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে নতুন এক ধরনের উপন্যাস বলে মনে হয়, কারণ এ ধরনের উপন্যাস তারা আগে কখনও পড়েন নি। ‘নন্দিত নরকে’ বইটি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আহমদ শরীফও বইটির প্রশংসা করে লেখেন, বাংলা সাহিত্যে একজন শক্তিশালী ঔপন্যাসিকের আবির্ভাব ঘটেছে।

জ্যোৎস্না আর বৃষ্টি ছিল তার ভীষণ প্রিয়

ভ্রমণ বিষয়ক লেখক ও নির্মাতা শাকুর মজিদ স্মৃতিচারণ করে তার একটি লেখা বলেছেন ‘‘নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিন ছিল ২০১২ সালের ২৫ মে। আগের দিন থেকে আমরা হাজির। আমরা মানে বেশি লোক নয়, অন্যপ্রকাশের মাজহার, মাসুম, কমল আর অবসর-এর আলমগীর রহমান। কথা ছিল, রাতের খাবার খেয়ে ফিরে আসব ঢাকায়। কিন্তু সে রাতে হঠাৎ করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি  নামছে নুহাশপল্লীর বাঁশঝাড়ে, মাঠে, বাগানে। বৃষ্টি থামলে মেঘের আড়াল থেকে কখনোবা ঝলসানো চাঁদ। এই জ্যোৎস্না আর বৃষ্টি, তার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের আড্ডা আমাকে ঢাকায় ফিরতে ভুলিয়ে দেয়। বৃষ্টি থামলে আমরা পুকুরপাড়ে চলে আসি। সেখানে দুটি নতুন কটেজ বানানো হয়েছে। কটেজগুলোর প্রশস্ত বারান্দা দিঘিমুখী। একটির মধ্যে ফ্লোরের ওপর আমরা সবাই বসে পড়ি। শাওন গান করে। হুমায়ূন আহমেদ নানা রকম চুটকি বলেন। আসরের কোথাও কিন্তু মনে হয় নি যে, মরণব্যাধিকে বুকে চেপে মৃত্যুর প্রহর গোনা একজন মানুষই আমাদের আড্ডার মধ্যমণি। ’’

হুমায়ূন আহমেদের শরীরে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে যান। সেখানে ২০১২ সালের জুলাই মাসের ১৬ তারিখ তিনি চলে যান লাইফ সাপোর্টে। সেখান থেকেই ৭ বছর আগে ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২৩ জুলাই নিউ ইয়র্ক থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্দেশে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে। সেখানে হাজারো মানুষের অশ্রু-পুষ্পতে সিক্ত হন তিনি। তাকে সমাহিত করা হয় তার গড়ে তোলা নন্দনকানন নুহাশ পল্লীর লিচুতলায়। সেখানেই চির-ঘুমে শায়িত হয়ে আছেন প্রবাদপ্রতীম কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ।

‘হুমায়ূন আহমেদের হিমু আর মিসির আলী সিরিজ এদেশে সাহিত্যে এক নতুন ধারা এবং এ দুটি কালজয়ী চরিত্র তাকে বিশেষভাবে অবিস্মরণীয় করে রাখবে। শুধু হাস্যরস আর নিছক মধ্যবিত্তের হাসি-কান্না ধরা পড়ে নি তার কলমে, ধরা পড়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালি সমাজ-জীবনের অনেক বড় ঘটনাও’

তিনি ছিলেন আশ্চর্য এক কথার জাদুকর

সেই যে সদ্য স্বাধীন দেশের পাঠক তার ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পাঠ করে আবিষ্ট হয়েছিলেন, সেই আবেশ আজও কাটে নি বাংলা ভাষার পাঠকদের। প্রথম দুটি উপন্যাস লেখার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্রের তৎকালীন তরুণ অধ্যাপক পিএইচডি গবেষণার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ায় কিছুকালের বিরতি পড়ে তার লেখালেখিতে। কিন্তু আশির দশকে স্বদেশে ফিরে রহস্য উপন্যাস ‘অমানুষ’ রচনার মধ্য দিয়ে আবার বিপুল পাঠকপ্রিয়তায় নতুন করে অভিষেক ঘটে তার বাংলার পাঠক সমাজে। প্রায় একই সময়ে টেলিভিশন নাটক রচনার মধ্য দিয়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে তার খ্যাতি। বিপুল জনপ্রিয়তায় অভিষিক্ত হয় তার প্রতিটি নাটক, উপন্যাস আর চলচ্চিত্র। তারপর আর তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হয় নি। তার প্রতিটি বই মানেই লাখ লাখ কপি বিক্রয়। এক মেলাতেই বহু সংস্করণ। প্রাণঘাতী কর্কট ব্যাধি অকালে কেড়ে নেয় এই অনন্য জননন্দিত সাহিত্যিককে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে। জীবনে যেমন তিনি ছিলেন বরণীয়, মৃত্যুর পরও এতটুকু ম্লান হয়নি তার বইয়ের চাহিদা। শুধু দুঃখ এই যে, নতুন করে আর কোনও লেখা পাবে না বাঙালি পাঠক তার কাছ থেকে। দেখা যাবে না তার কোনও নতুন নাটক কিংবা চলচ্চিত্র।

হিমু আর মিসির আলীর জনক তিনি

হুমায়ূন আহমেদের হিমু আর মিসির আলী সিরিজ এদেশে সাহিত্যে এক নতুন ধারা এবং এ দুটি কালজয়ী চরিত্র তাকে বিশেষভাবে অবিস্মরণীয় করে রাখবে। শুধু হাস্যরস আর নিছক মধ্যবিত্তের হাসি-কান্না ধরা পড়ে নি তার কলমে, ধরা পড়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালি সমাজ-জীবনের অনেক বড় ঘটনাও। তার নাটকের টিয়ে পাখির মুখের একটি সংলাপ ‘তুই রাজাকার’ বহু বছর আগে সারাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়েছিল, যা সেই সময়ে ছিল দুঃসাহসিক উচ্চারণ।

পদচিহ্ন এঁকেছেন সাহিত্যের সকল শাখায়

জীবনের অস্তবেলায় ক্যান্সারের সঙ্গে লড়তে লড়তেই লিখে গেছেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মর্মস্পর্শী ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস ‘দেয়াল’। দুই শতাধিক গ্রন্থের অমর স্রষ্টা একুশে পদক ও একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী এই কুশলী কথাশিল্পী, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার সাহিত্যের যে শাখায়ই হাত দিয়েছেন, সেখানেই রেখে গেছেন তার অসামান্য মেধার স্বাক্ষর।

মৃত্যুর ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও হুমায়ূন আহমেদ এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তার শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর। আর তিনি সাহিত্যের যে ক্ষেত্রেই নিজের পদচিহ্ন এঁকেছেন প্রত্যেকটিতেই দেখা পেয়েছেন সাফল্যের।

তার লেখা পছন্দ করেন না এমন মানুষও তার নতুন লেখাটি ‘গোপনে’ পড়ে ফেলেন। দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা তার অন্তত একটি নাটক বা চলচ্চিত্র দেখে নি কিংবা তার কোনও বই পড়ে নি। জনপ্রিয়তার জগতে তিনি একক ও অনন্য। তিনিই তরুণ-তরুণীদের করেছেন বইমুখী।

হুমায়ুন আহমেদের লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে-নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, গৌরিপুর জংশন, নৃপতি, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচীনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি।

তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে— আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা ও নয় নম্বর বিপদ সংকেত। তার পরিচালিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ও জয় করেছে দর্শক ও সমালোচকদের মন।

টিভি নাট্যকার হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সমান জনপ্রিয়। আশির দশকের মাঝামাঝি তার প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তাকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তার হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। যে চরিত্রে অভিনয় করেন গুণী অভিনেতা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বাংলা সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনকও হুমায়ূন আহমেদ । 

‘তার গল্প-উপন্যাস-নাটকের চরিত্রগুলোর প্রায় সবাই যেন আমাদের খুব পরিচিত মানুষ। প্রতিদিনের চেনা মানুষগুলোকেই তিনি আমাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দেন। ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটি ঠিক তেমনি। আমার কাছে এটা একটা অবিস্মরণীয় চরিত্র’

বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এছাড়া তিনি  বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার,  হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের পুরস্কার লাভ করেন। দেশের বাইরেও তাকে নিয়ে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তার প্রমাণ জাপান টেলিভিশন ‘এনএইচকে’ তাকে নিয়ে নির্মাণ করে ১৫ মিনিটের তথ্যচিত্র ‘হু ইস হু ইন এশিয়া’।

হুমায়ূন আহমেদ প্রথম উপন্যাসে যেমন পাঠকের মনের গভীরে একটি সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্থান করে নিতে পেরেছিলেন, তেমনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটকগুলোতেও অবিশ্বাস্য রকমের আলোড়ন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ধারাবাহিক নাটকগুলোর সব চরিত্রই মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে খুব চেনা। প্রতিটি ধারাবাহিক শুরুর আগেই পরিবারের সবাই টিভি সেটের সামনে বসে অপেক্ষা করেছে গভীর আগ্রহে। সারা শহর যেন থেমে থাকত ওই সময়টুকুর জন্য। তারা শুধু নাটক দেখত না, নাটকের চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজেদের এক করে ফেলত। কখনও প্রচণ্ড হাস্যরসাত্মক, কখনও বাঁধভাঙা আবেগ, কখনও ট্র্যাজেডি— এসব দেখতে দেখতে দর্শক মিশে যেত নাটকের চরিত্রগুলোর সঙ্গে। এমনকি ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকের টুনির অসুস্থতা নিয়েও দর্শক-শ্রোতারা এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েন যে নাট্যকার হুমায়ূন যাতে শিশুটিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে না দেন, সে অনুরোধ করেন। ‘কেউ কোথাও নেই’ নাটকের প্রধান চরিত্র বাকের ভাই। এই শহরের কোনও এক রাস্তার মাস্তান টাইপের যুবক বাকের ভাই, যে সব সময় হাতের আঙুলের ভেতর চাবির রিং ঘুরায় আর চায়ের দোকানে পুরনো হিন্দি গান শোনে, ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দোপাট্টা’— এসব চরিত্রের সঙ্গে দর্শক এমনভাবে মিশে যেত যে মিশে গিয়ে আর সেখান থেকে বের হতে পারত না। ফলে নাট্যকার হুমায়ূন যখন শিশু টুনিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন বা বাকের ভাইকে মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে ফাঁসির দড়ির দিকে এগিয়ে দেন, তখন সাধারণ দর্শক আর নিজেদের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তারা নাট্যকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য রাস্তায় মিছিল বের করে। এই হচ্ছে নাট্যকার হুমায়ূনের ক্ষমতা।

বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত অভিনেতা, বাকশিল্পী ও সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি। হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে বলেন আসাদুজ্জামান নূর বলেন, তিনি আমাদের মধ্যবিত্তজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার গল্প তুলে ধরেছেন দৈনন্দিন ভাষায়। দৈনন্দিন বলে সে ভাষা কিন্তু ফেল না নয়। মানুষের আবেগ-অভিমান, হতাশা-বঞ্চনা, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা উঠে এসেছে সে ভাষায় নিখুঁতভাবে। এখানেই তিনি আর দশজন থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলেছেন। সরল ভাষারও যে কী সম্মোহনী শক্তি! কাহিনির পাশাপাশি তার রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য চরিত্র নির্মাণ। তার গল্প-উপন্যাস-নাটকের চরিত্রগুলোর প্রায় সবাই যেন আমাদের খুব পরিচিত মানুষ। প্রতিদিনের চেনা মানুষগুলোকেই তিনি আমাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দেন। ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটি ঠিক তেমনি। আমার কাছে এটা একটা অবিস্মরণীয় চরিত্র।

হুমায়ূনের রসবোধ ছিল প্রবল

হুমায়ূনের রসবোধ অবিসংবাদিত। উপন্যাস কি গল্প, সিনেমা কি নাটকে। অট্টহাসি নয়; কিন্তু হাসির রেশ বহুক্ষণ পাঠক কি দর্শককে আক্রান্ত করে রাখা কম শক্তির কাজ নয়। গল্প বলার ধরন, বিষয়ের বৈচিত্র্য, বর্ণনায় পরিমিতিবোধ, নাটকীয় চমক সৃষ্টি, ভিন্নধর্মী চরিত্র নির্মাণ, প্রাঞ্জল ভাষা প্রয়োগ হুমায়ূন আহমেদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সংলাপ রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ও কালজয়ী।

প্রতিবছর তার রচনার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তার রচনার পাঠক প্রায় সর্বস্তরের পাঠক। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একটা বড় অংশজুড়ে। একসময় পশ্চিমবঙ্গের গল্প-উপন্যাসই এ দেশের পাঠকদের প্রধান পাঠ্য ছিল। কিন্তু সময় পাল্টে গেছে। পাল্টে দিয়েছেন এই হুমায়ূন আহমেদই। 

তার জন্মকথা অন্যান্য প্রসঙ্গ

১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। ডাক নাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা ছিলেন গৃহিনী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার ছোটভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।

তিনি ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ও ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৮২ সালে যুক্তরাস্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ৯০ দশকের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন।

১৯৭৩ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন খানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে। তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশা আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে ডিভোর্সের মাধ্যমে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির দুই ছেলে- নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন।

কে বলে আজ তুমি নাই

গাজীপুরের পিরুজালীতে নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলেন সবুজ ছায়াঘেরা নিসর্গ ‘নুহাশপল্লী’। সেখানেই চিরঘুমে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। 

ছবি ● সংগৃহীত

এসএমএম

আরও পড়ুন