• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০১৯, ০৯:৫০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১৫, ২০১৯, ১০:১৮ এএম

প্রথম দিনে সুরের দরিয়ায় হাজারো মানুষ

প্রথম দিনে সুরের দরিয়ায় হাজারো মানুষ
উদ্বোধনী দিনে প্রথম পরিবেশনা ছিল প্রেমা ও তার দল ভাবনার লোকজ বৃন্দ নৃত্য -ছবি : জাগরণ

ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব ২০১৯

....................

লোকসঙ্গীত— বাঙালির প্রাণের স্পন্দন। কী ভাটিয়ালি, কী ভাওয়াইয়া, জারি, সারি আর বাউল গানের সুরে মাতোয়ারা হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এসব গান বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায় সব সময়, সবখানেই। এই গানের সঙ্গে মিশে আছে চিরকালের বাঙালির অপার মুগ্ধতা। দেশ-বিদেশের নানা ঘরানার লোকগীতি নিয়ে রাজধানীর ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) শুরু হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব ২০১৯।

দেশজ ঐতিহ্য লোকসঙ্গীত বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার শুভপ্রয়াস হিসেবে পঞ্চমবারের মতো তিন দিনের এই আন্তর্জাতিক লোক সঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করেছে মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টস।

দিনের আলো ফুরিয়ে এলে নামে সন্ধ্যা। আর সেই সন্ধ্যায় জমতে থাকে গল্প। তেমনি হাজারও গল্পে সূচনা হয় সন্ধ্যায়। আর্মি স্টেডিয়ামে দেখা মিলল অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্যের। হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার আগমনে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সরগরম হয়ে উঠে আর্মি স্টেডিয়াম। দেশের সঙ্গীতের সুরতরঙ্গে সবাই যেন নিজেকে সমর্পিত করেছে সুরের দরিয়ায়। আনন্দের অনুরণন ও গভীরতার ছোঁয়ায় উদ্দীপ্ত পার্থিব জগতের ভেতর থেকেও আবির্ভূত হয় অপার্থিব আনন্দ।

শীতের বার্তাবহ হেমন্তের প্রথম দিনে সন্ধ্যায় লোকসঙ্গীতের এই আসরের সূচনা হয়। উৎসবের উদ্বোধনী পর্ব উপভোগ করতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই রাজধানীর নানা প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করে সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ। নির্ধারিত সময়ের আগেই সারিবদ্ধভাবে স্টেডিয়ামের বিভিন্ন ফটক দিয়ে কঠোর নিরাপত্তা তল্লাশির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে থাকে সঙ্গীতপ্রেমীরা। হেমন্তের প্রথম বিকেলে হালকা ঠাণ্ডা আর ঝলমলে পরিবেশে ঢাকার আকাশকে সুর-মূর্ছনায় ভাসাতে এসেছেন সবাই।

বিশাল এ সঙ্গীত আসরে এবার অংশ নিচ্ছে স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, জর্জিয়া ও মালির দুই শতাধিক লোকসঙ্গীত শিল্পী।

মেরিল নিবেদিত এ আয়োজনে সহযোগিতা রয়েছে ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড।

প্রথম দিনের আয়োজনের সূচনা হয় প্রেমা ও ভাবনা নৃত্যদলের পরিবেশনায় লোকজ নৃত্যের মধ্য দিয়ে। ‘আমরা রব না রব না গো’ গানের সঙ্গে পুতুল নাচ পরিবেশন করেন। তারপর ছিল আরও কয়েক বৃন্দ নৃত্য। 

উৎসবের প্রথম দিনের দ্বিতীয় পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসে জর্জিয়ার লোক ব্যান্ডদল শেভেনেবুরেবি। রোমান ও বাইজানটান মিশেলে বেশ কিছু লোকগীতি পরিবেশন করে ঢাকার দর্শকশ্রোতাদের মাতান তারা। 

ব্যান্ড শেভেনেবুরেবির পরিবেশনা

জর্জিয়ান লোক গান গেয়ে অল্প সময়ের দর্শক-শ্রোতার মনোযোগ কেড়েছিলেন ব্যান্ড শেভেনেবুরেবি। ২০০১ সালে এই ব্যান্ড যখন গঠিত হয়, তখন থেকে এর প্রতিটি সদস্য লোক গানকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। শুধু গান গাওয়া নয়, বিভিন্ন ধরনের লোক বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে ভিন্নধর্মী সঙ্গীতায়োজনও শেভেনেবুরেবির বৈশিষ্ট্য। এর সদস্যরা জর্জিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোক গান সংগ্রহের কাজেও নিয়োজিত আছে। এর কারণ একটাই, জর্জিয়ান লোক সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চায় তারা। সে লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করেযাচ্ছেন ব্যান্ড সদস্যরা। জর্জিয়ান লোকসঙ্গীত কতটা সমৃদ্ধ এবং কত সহজে শ্রোতার মনোযোগ কেড়ে নিতে পারে তারও অনেকে উদাহরণ রেখে গেছে শেভেনেবুরেবি। লোক গানের এই দলটি এরই মধ্যে ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বড় বড় কনসার্টে অংশ নিয়েছেন। সেইসঙ্গে জয় করেছেন অগণিত শ্রোতার হৃদয়।

ব্যান্ড শেভেনেবুরেবির পরিবেশনা

ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবে প্রথমবার অংশ নিয়েই দর্শক-শ্রোতা মাতায় শেভেনেবুরেবি।

এরপর ছিল উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা। লোকসঙ্গীতের এ মহাযজ্ঞের উদ্বোধন করেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। এর আগে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রকৃতিগতভাবেই বাংলার লোকসঙ্গীত যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী। বর্তমান সময়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে লোকসঙ্গীত পেয়েছে নতুন মাত্রা। এ আয়োজনের মাধ্যমে দেশের সংস্কৃতি আরও বিকশিত হবে।

তথ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের মানুষ, প্রকৃতি, পৃথিবী, শেকড়ের রস- এসবই আমাদের লোকসঙ্গীতের উপকরণ। লোকসঙ্গীতের এ উৎসবে তারুণ্যের স্রোত আমাকে অভিভূত করেছে।

অঞ্জন চৌধুরী বলেন, আমাদের লোকসঙ্গীত আমাদের ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্যকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্বও আমাদের।

উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের শাহ আলম সরকার ও তার দল।তিনি একে একে পরিবেশন করেন ‘দয়াল নবী গো’, ‘আমি যারে ভালোবাসি’, ‘ও কালা বাঁশি’, ‘আমি তো মরে যাব’সহ বেশকিছু লোকগান। 

ঢাকার দর্শক-শ্রোতা মাতান ভারতের প্রখ্যাত ভাংড়া শিল্পী দালের মেহেন্দী -ছবি : জাগরণ

এরপরই মঞ্চে আসেন পাঞ্জাবি ভাংড়ার বিখ্যাত শিল্পী দালের মেহেন্দী। মঞ্চে আসেন তুমুল জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘বাহুবলির’ টাইটেল সং নিয়ে। এর পর বাংলায় বলে  ওঠেন ‘কেমন আছে বাংলাদেশ। এর পর শুরু তার গানের ভেলায় ভেসে বেড়ানো। গাইলেন তার বিখ্যাত গান  ‘নারে নারে নারে’। এরপর গেয়ে শোনান ‘হায়ো রাব্বা হায়ো রাব্বা’, ‘সারে দিল মে ছুরিয়া চালাইয়্যা’, ‘বোল তারা রা রা’, তুনাক তুনাক তুন’, সাজন মে, হো জায়ে বাল্লে বাল্লেসহ বেশকিছু জনপ্রিয় গান।

উৎসবের দ্বিতীয় শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) শুরুতেই মঞ্চে উঠবেন রিয়েলিটি শো বাউলিয়ানার আলোচিত তরুণ কণ্ঠশিল্পী কামরুজ্জামান রাব্বি ও শফিকুল ইসলাম। তাদের দ্বৈত পরিবেশনার এদিনের আয়োজন সূচনা হবে। দেশের বড় বড় মঞ্চে লোকগান গেয়ে এরই মধ্যে তারা দর্শক-শ্রোতার মন জয় করে নিয়েছেন।

তাদের পরেই মঞ্চে উঠবেন বাংলাদেশের বাউল কাজল দেওয়ান ও তার দল। মাতাল কবি আবদুর রাজ্জাকের এই শিষ্য এ পর্যন্ত তিন শতাধিক লোকসঙ্গীতের অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। একইসঙ্গে বাউল ও পালাগান গেয়ে পেয়েছেন অগণিত শ্রোতার ভালোবাসা।

পাকিস্তানি শিল্পী হিনা নাসরুল্লাহ

কাজল দেয়ানের পর মঞ্চে উঠবেন পাকিস্তানের সুফি ঘরানার নন্দিত কণ্ঠশিল্পী হিনা নাসরুল্লাহ। উর্দু, সিন্ধি ও সারাইকি ভাষার সুফি গান গেয়ে এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের প্রশংসা কুঁড়িয়েছেন তিনি। ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবে প্রথম পারফর্ম করতে ঢাকা সফরে এসেছেন হিনা। সুফি ঘরানার বেশ জনপ্রিয় গান শোনাবেন তিনি। তার পরিবেশনা শেষ হলে মঞ্চে উঠবেন বাউল ও সুফি গানের কণ্ঠশিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন। যিনি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাউল গান গেয়ে অগণিত দর্শক-শ্রোতার মনোযোগ কেড়েছেন। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে তিনি বাউল গান নিয়ে নিরলস গবেষণা চালিয়ে গেছেন, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে এরই মধ্যে তিনি ৪৫ হাজারেরও বেশি বাউল গান সংগ্রহ করেছেন। সেখান থেকে নির্বাচিত কিছু গান থাকবে তার পরিবেশনায়।

দ্বিতীয় দিনের শেষ পরিবেশনা থাকছে মালির লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী বলা হয় হাবিব কইটকে। ব্যান্ড বামাদার সঙ্গে এটাই হবে ঢাকার মঞ্চে তার প্রথম পরিবেশনা।

তৃতীয় ও শেষ দিন শনিবার (১৬ নভেম্বর) আয়োজনে প্রথমে মঞ্চে উঠবেন কাওয়ালি গানের সাড়া জাগানো কণ্ঠশিল্পী মালেক দেওয়ান। তিনি বিশ্বাস করেন, কাওয়ালি গানের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী। সেই বিশ্বাস নিয়েই টুনু কাওয়ালের এই শিষ্য উৎসবের শেষ দিন কাওয়ালির পাশাপাশি পরিবেশন করবেন মাইজভাণ্ডারি গান।

মালেক দেওয়ানের পর মঞ্চে উঠবে রাশিয়ার করেলিয়া অঞ্চলের আলোচিত ব্যান্ড সাত্তুমা। নিউ ফোক ঘরানার এই ব্যান্ডটি এরই মধ্যে রাশিয়া ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, এস্তোনিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সঙ্গীত পরিবেশন করে দর্শক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। প্রথম ঢাকার মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য তারা নির্বাচন করেছেন নিজ দেশের জনপ্রিয় লোকগানগুলো।

সাত্তুমার পর মঞ্চে উঠবেন দেশের লোকগানের নন্দিত কণ্ঠশিল্পী চন্দনা মজুমদার। মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন ছাড়াও চলচ্চিত্রে নিয়মিত গান করেন তিনি। ২০০৯ সালে শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। লালন শাহ, হাছন রাজা, রাধা রমণ, শাহ আবদুল করিমসহ বিভিন্ন গীতিকবির গান গেয়ে জয় করেছেন অগণিত সঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়। এর আগেও লোকসঙ্গীত উৎসবে গান গেয়ে দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।

চন্দনা মজুমদারের পর উৎসবের সমাপ্তি টানতে মঞ্চে উঠবে উপমহাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড জুনুন। পাকিস্তানি এই ব্যান্ড এর আগেও একাধিকবার বাংলাদেশ সফরে এসেছে। এবারের সফরটি তাদের কাছে অন্যরকম। কেননা এ দলটি এবার সুফির সঙ্গে রক ফিউশনের পরিবেশনা তুলে ধরবে ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীতের মঞ্চে। আরও কিছু ভিন্নধর্মী সুফি গানের পরিবেশনা তুলে ধরতেই তাদের এবারের ঢাকা সফর।

বিনামূল্যে এ উৎসবে যোগ দেয়ার জন্য ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করেছেন শ্রোতারা। উৎসবের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুকে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোকফেস্ট পেজে ও ওয়েবসাইটে (dhakainternationalfolkfest.com)। ফেসবুকের পেজে এবং উৎসবের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে পুরো অনুষ্ঠান লাইভ দেখা যাচ্ছে।

এসএমএম/একেএস

আরও পড়ুন