• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০১৯, ০৯:০৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ১৫, ২০১৯, ০৯:০৬ পিএম

ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব

সুরের মূর্ছনায় শুধুই মুগ্ধতা

সুরের মূর্ছনায় শুধুই মুগ্ধতা
সঙ্গীত পরিবেশন করছেন কাজল দেওয়ান - ছবি : জাগরণ

এক জীবনে নিজেকে চেনার চেষ্টা চলে অবিরাম। নিজেকে সন্ধান করার জন্য যেতে হয় গভীর থেকে গভীরে। শেকড়কে চিনতে হাঁটতে হয় দীর্ঘ পথ। তবুও মেলে না হিসাব। এ সংগ্রাম মানুষের নিরন্তর। লোকগানের সুরের ঝর্ণাধারা মানুষকে দেয় সেই অনন্তলোকের সন্ধান। যেখানে জীবনের প্রেম আর পূর্ণতা অনুপম দ্যোতনার সৃষ্টি করে। লোকসঙ্গীত এই উপমহাদেশে এবং বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত। লোকজ সুরের অনন্য উর্বর ভূমি এ দেশের পাললিক জনপদ। এই মাটির সুর-সাধকরা কথার পিঠে কথা সাজিয়ে লিখে গেছেন বহু গান। যার আবেদন আজও সমকালীন। লোকসঙ্গীতের সেসব সুধাই বিশ্বময় বিলিয়ে দিতে মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টসের যৌথ আয়োজনে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে চলছে লোকসঙ্গীতের সবচেয়ে বড় আসর ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব’। 

শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) উৎসবের দ্বিতীয় দিন বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের পাশাপাশি দর্শক-শ্রোতাদের সম্মোহিত করতে শিল্পীদের তালিকায় আছেন পাকিস্তান ও মালি শিল্পীরাও।

এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দর্শক-শ্রোতা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। শনিবার (১৬ নভেম্বর) বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে এবারের উৎসবের।

হালকা শীতে লোকসঙ্গীতের এ আসরের দ্বিতীয় দিন অসাধারণ সব পরিবেশনায় মুগ্ধ ছিলেন দর্শক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে শুরু করে শিল্পী, শিক্ষক, আমলা, সাংবাদিক, শিল্পপতি সমাজের প্রায় সব শ্রেণির সঙ্গীতপিপাসুরাই উপভোগ করছেন নানা ঘরানার লোকসঙ্গীত।

উৎসবের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) শুরুতেই মঞ্চে আসেন রিয়েলিটি শো বাউলিয়ানার আলোচিত তরুণ কণ্ঠশিল্পী কামরুজ্জামান রাব্বি ও শফিকুল ইসলাম। তাদের দ্বৈত পরিবেশনায় এদিনের আয়োজন সূচনা হয়।

কৈশোরেই লোকগানের পরিবেশনা দিয়ে শ্রোতার মনোযোগ কেড়েছেন শফিকুল ইসলাম। ২০১৬ সালে সান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাউলিয়ানা’য় প্রথম রানারআপ হয়ে আলোচনায় আসেন শফিকুল। এই ক্ষুদে শিল্পী বাউল ও বিচ্ছেদী গানের পাশাপাশি অন্যান্য ঘরানার গানেও দারুণ পারদর্শী। ময়মনসিংহের সন্তান শফিকুল এখন বড় বড় সব মঞ্চে লোকগান দিয়ে মাতিয়ে রাখছেন সারাদেশ।

অল্প বয়সেই দোতারা বাদন আর লোকগানের পরিবেশনা দিয়ে শ্রোতাদের মাঝে নিজস্ব পরিচিতি গড়ে নিয়েছেন কামরুজ্জামান রাব্বি। চাচা আবদুল জলিলের কাছ থেকে দোতারা বাজানো শিখেছেন। গান শিখেছেন রাজশাহীতে ওস্তাদ নিজামুল ইসলাম খানের কাছে। ২০১৬ সালে বাউল গানের রিয়েলিটি শো ‘বাউলিয়ানা’র মঞ্চে সর্বপ্রথম নজর কাড়েন রাব্বি। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

দেশের বড় বড় মঞ্চে লোকগান গেয়ে এরইমধ্যে কামরুজ্জামান রাব্বি ও শফিকুল ইসলাম দর্শক-শ্রোতার মন জয় করে নিয়েছেন। এবার তারই ঝলক দেখা গেলো ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় দিনের প্রথম পরিবেশনায়।

শুরুতে গান পরিবেশন করেন শফিকুল ইসলাম। গেয়ে শোনান  ‘মন মজাইলা ওরে বাউল গান’, ‘তুমি কই গেলা কই রইলা আমারে ছাড়িয়া’ ও ‘কী সুন্দর এক গানের পাখি/ মন নিয়ে সে খেলা করে’।

সঙ্গীত পরিবেশন করছেন কামরুজ্জামান রাব্বি       - ছবি : জাগরণ

কামরুজ্জামান রাব্বি গাইলেন ‘আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’, ‘ভাব আছে যার গায়/ দেখলে তারে চেনা যায়’, ‘তোমার সনে কিসের পিরিত’, ‘আমি তো বালা না/ বালা লইয়া থাইকো’ ও ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।

তাদের পরেই মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের বাউল কাজল দেওয়ান ও তার দল। ঢাকার কেরানীগঞ্জের সন্তান কাজল দেওয়ানের সঙ্গীতে হাতেখড়ি শৈশবে। তার বাবা প্রখ্যাত বাউল মাতাল কবি আবদুর রাজ্জাক দেওয়ান, যার হাত ধরে নিজেকে বাউল গানের সুরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছেন কাজল দেওয়ান। পালাগান ও লোকসঙ্গীতকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিতে এ পর্যন্ত তিন শতাধিক অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন তিনি। তারই কিছু গান পরিবেশন করেন তিনি। শুরুতেই গাইলেন ‘আমার মন পাগলা/ দিন ফুরাইলে ভাইঙ্গা যাবে এই রঙের মেলা’। এর পর গাইলেন ‘পিরিতের বাজার ভালো’, ‘আমি তোর পিরিতের দেওয়ানা’, ‘আরে জীবন ও জীবন রে’, ‘আজ আমার মন ভালা না’সহ মন ছুঁয়ে দেয়া একগুচ্ছ গান।

কাজল দেওয়ানের পর মঞ্চে ওঠেন মালিয়ান লোকসঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী হাবিব কোটেই ও তার দল বাম্বাদা। যিনি নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ‘মুসো কো’ শিরোনামে প্রথম গানের অ্যালবাম দিয়ে বিশ্বব্যাপী সঙ্গীতপ্রেমীদের মনোযোগ কাড়েন। সেই কিংবদন্তি শিল্পী ঢাকার দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে উষ্ণতা ছড়ালেন সেদেশের লোকসঙ্গীত পরিবেশন করে। ভাষা ভিন্ন হলেও সুর ছিল উপভোগ করার মতো। তাই মরা কার্তিকের শেষ সন্ধ্যাটি হয়ে উঠেছিল অন্যরকম সুরছন্দময়।

বিশ্বের একেকটি অঞ্চলে এক এক ধারার লোকসঙ্গীতে সমৃদ্ধ। সেই দিক থেকে আফ্রিকা কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। ধু ধু সাহারাও এখানে জন্ম দিয়েছে অন্যরকম এক মেলোডির।  মালির শিল্পী হাবিব কোটেই ও তার দল বাম্বাদার তা-ই মনে করিয়ে দিয়েছেন শুক্রবারের সান্ধ্যকালীন আয়োজনে। আফ্রিকান পপ যা সংক্ষেপে আফ্রো-পপ নামে পরিচিত তার নিচে মিশে গেছে কোটেইয়ের গিটারের ব্লুজ ও ফ্ল্যামেনকো। গানের ভাষা ভিন্ন হলেও মেলোডিগুলো খুব কাছের, খুব পরিচিত। আর সেটা বুঁদ হয়ে উপভোগ করলো আর্মি স্টেডিয়ামে উপস্থিত অর্ধলাখ নানা বয়সী শ্রেণি-পেশার মানুষ।

পাকিস্তানের সুফি ঘরানার নন্দিত কণ্ঠশিল্পী হিনা নাসরুল্লাহ। উর্দু, সিন্ধি ও সারাইকি ভাষার সুফি গান গেয়ে এরইমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবে প্রথম পারফর্ম করতে ঢাকা সফরে এসেছেন হিনা। সুফি ঘরানার বেশ জনপ্রিয় গান নিয়ে তিনি মঞ্চে আসবেন দ্বিতীয় দিনের শেষ পরিবেশনা নিয়ে রাত সাড়ে ১০টায়।

সমাপনী পরিবেশনা
শনিবার (১৬ নভেম্বর) শেষ হবে তিন দিনের এই লোকগীতির উৎসব। সমাপনী আয়োজনের প্রথমে মঞ্চে উঠবেন কাওয়ালি গানের সাড়া জাগানো কণ্ঠশিল্পী মালেক দেওয়ান। তিনি বিশ্বাস করেন, কাওয়ালি গানের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী। সেই বিশ্বাস নিয়েই টুনু কাওয়ালের এই শিষ্য উৎসবের শেষ দিন কাওয়ালির পাশাপাশি পরিবেশন করবেন মাইজভাণ্ডারি গান।

মালেক দেওয়ানের পর মঞ্চে উঠবে রাশিয়ার করেলিয়া অঞ্চলের আলোচিত ব্যান্ড সাত্তুমা। নিউ ফোক ঘরানার এই ব্যান্ডটি এরইমধ্যে রাশিয়া ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, এস্তোনিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সঙ্গীত পরিবেশন করে দর্শকপ্রশংসা কুড়িয়েছেন। প্রথম ঢাকার মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য তারা নির্বাচন করেছেন নিজ দেশের জনপ্রিয় লোকগানগুলো।

সাত্তুমার পর মঞ্চে উঠবেন দেশের লোকগানের নন্দিত কণ্ঠশিল্পী চন্দনা মজুমদার। মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন ছাড়াও চলচ্চিত্রে নিয়মিত গান করেন তিনি। ২০০৯ সালে শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। লালন শাহ, হাছন রাজা, রাধা রমণ, শাহ আবদুল করিমসহ বিভিন্ন গীতিকবির গান গেয়ে জয় করেছেন অগণিত সঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়। এর আগেও লোকসঙ্গীত উৎসবে গান গেয়ে দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।

চন্দনা মজুমদারের পর উৎসবের সমাপ্তি টানতে মঞ্চে উঠবে উপমহাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড জুনুন। পাকিস্তানি এই ব্যান্ড এর আগেও একাধিকবার বাংলাদেশ সফরে এসেছে। এবারের সফরটি তাদের কাছে অন্যরকম। কেননা এ দলটি এবার সুফির সঙ্গে রক ফিউশনের পরিবেশনা তুলে ধরবে ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীতের মঞ্চে। আরও কিছু ভিন্নধর্মী সুফি গানের পরিবেশনা তুলে ধরতেই তাদের এবারের ঢাকা সফর।

লাইভ দেখুন ইউটিউবে
বিনামূল্যে এ উৎসবে যোগ দেয়ার জন্য ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করেছেন শ্রোতারা। উৎসবের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুকে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোকফেস্ট পেজে ও ওয়েবসাইটে (dhakainternationalfolkfest.com)। ফেসবুকের পেজে এবং উৎসবের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে পুরো অনুষ্ঠান লাইভ দেখা যাচ্ছে।

উৎসর্গ
সুবীর নন্দী, বারী সিদ্দিকী, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, ফকির আবদুর রব শাহ এবং আইয়ুব বাচ্চু- বাংলা গানের এই ছয় মহারথীর ওপর নির্মিত একটি ভিডিওচিত্র দেখানো হয় এদিনও। এই গুণী শিল্পীদের উৎসর্গ করা হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের পঞ্চম আসর। 

এসএমএম/ এফসি

আরও পড়ুন