• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০১৯, ০৭:১২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২০, ২০১৯, ০৭:১৪ পিএম

এ সপ্তাহের গল্প

কইতরির কিচ্ছা 

কইতরির কিচ্ছা 

কইতরির এমুন ছটফট লাগে ক্যা আজকা? রাইত বাড়াতাছে কিন্তুক চোক্ষে ঘোমের নাম গন্ধ নাইক্কা। এমুন তো লাগেনা কোনোদিন, খোদায় জানে কিয়ের আলামত? কেরাসিনকাটের চৌকিটা কচর কচর করে এদিক ওদিক ফিরলেই। কোলের মইধ্যে আরামে ঘোমায় অর দুধের শিশু মানিক। বেশি আওয়াজ হইলে বাচ্চাটায় জাইগা যাইতে পারে হের লেগা এক কাইত হইয়া থাকে কইতরি।

কি সব যে আবোল তাবোল চিন্তা আহে মাথার ভিত্তে ইস্ তওবা তওবা। মানিকের বাপে কামলা দিতে গেছে আজকা কয়দিন যায় আল্লায় দিলে কাইল বাদে পরশু শুক্কুরবার আইয়া পড়ব। এই ক্ষ্যাপে বলে ভালা রোজগার হইবো কইছে হেয়। ট্যাকা পয়সা ছাড়া কি জীবন চলে? পদে পদে ট্যাকা লাগে। গরীবের তো হগ্গল সমে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। থাক একটু অভাব অনটন তবু কইতরির মনে সুখ আছে, খোদায় অরে স্বামী সোহাগী করছে।

মানিকের বাপে কোনোসমে খালি আতে আহে না চুড়ি নাইলে ফিতা নাইলে সুগন্ধি ত্যাল আনবই, ট্যাকা কম থাকলে এক খিলি মিষ্টি সুপারী দেয়া পান লইবো অর লাইগা। আর তো জান ছাড়া ডাকবই না,  হগ্গল সমে কইব আমার কইতরিজান। মাইনষের সামনে কইলে শরম করে তয় আদর সোহাগ করনের সমে যহন জান কইয়া ডাক পারে সোভানাল্লাহ্ কইতরির বেবাগ শইল্লে কাপন ধরে য্যান, নিজেরে পাইত্তা দেয় কইতরি স্বামীরে খুশি করনের লাইগা। 

পর্ব: ২ 
এই রাইতে কইলজার ভিত্তে ধরাস ফরাস করে কইতরির ক্যান যে ? মজনু মিয়ায় বাইত্তে নাইক্কা হের লেগা নাকি কে কইবো?  হেয় বাইত্তে না থাকলে দুনিয়াটা আন্ধার লাগে। নাকি কইতরির মার লেগা এমুন লাগে? অর ভাইডায় আগে মার লগেই থাকতো অহন চিটাগং গেছেগা, বন্দরের পাশে পুরান জাহাজ ভাঙ্গনের কাম করে। কত কিছু কইরা তয় বাইচ্চা থাকন? এমুন কি যে সব চিন্তা আহে। 

হেই যে মাঘ মাইস্যা শীতে এক্কেরে বিয়ান বেলা মায়ের লগে পলাইয়া কইতরি আর অর ছুটো ভাই কমলে রুপপুর ছাইডা ঢাকা আইছিলো হেই কতা মনে অইলে শইল্লের পশম খাড়ায় যায় অহন তক। কি ছিদ্দতের জীবন আছিলো অগো খোদায় রক্ষা করছে। আসলে কি মায়ে সাহস না করলে এইটা বেসম্ভব ব্যাপার আছিলো। কইতরির মনে কয় অর মায়ের মিদ্যে খোদায় ভর করছিলো নাইলে ক্যামনে কি হইতো? 

চোখের পানি নাকের পানি এক হইয়া বালিশটা ভিইজ্জা যায় কইতরির, মায়ের এমুন ঋন কি আর চোখের জলে ধোওন যায় গো? এইবার মজনু মিয়ায় আইলে কয়দিন মার লগে গিয়া থাইক্কা আইবো কইতরি মনে মনে চিন্তা করে। বেশি দূরে তো আর না? অরা থাকে তেঁজগাও বস্তিতে আর মায়ে থাকে গুপীবাগের বস্তিতে। ইট্টু ইট্টু কইরা চোক্ষের দুই পাতা ভারি লাগে, কইতরি ঘোমায়া যায় নিজেও ট্যার পায় না।

পর্ব : ৩ 
এত কিছু ঘটনের পরেও রুপপুরের লেগা বহুত মায়া লাগে কইতরির, মনে কয় যদি একটা দৌড় দিয়া হেইনে যাইতে পারতো? সরকারি পেরাইমারি ইস্কুলের টিনের ছাদ দেওয়া ইটার দেওয়াল, শীতলক্ষ্যা নদী, চাপকল তলা, ছড়াইন্না উঠান,  সিদ্ধ ধানের গন্ধ, শীতের দিনে রইদে বইয়া মাটির চুলায় পোড়া আলু খাওন হেটি মনে আইলে চিক্কুর দিয়া কান্দন আহে অর। তবু নিজেগো জানের মায়ায় এই মায়া মায়া গন্ধ ভরা জীবনটারে পিছে ফালায়া আইতে হইছে । 

জন্মানের পর থেকা যহন তেনে কইতরির জ্ঞান বুদ্দি হইছে খালি দেখছে মারামারি পারাপারি। এমুন একটা সন্দ্যারাইত বাদ যায় নাইক্কা যেদিন অর মায়ে কান্দে নাই। রোজ রোজ দেইখ্খা কইতরি আর কমলে জানতো কান্দনটা অগো মায়ের লেগা হাগা মোতার মতন নিত্যকার বিষয়। হেই নষ্ট জীবনটার লেগা আফসোস লাগেনা। ভিটা মাটির একটা টান আছে না হেইটা মইধ্যে মইধ্যে চারা দেয় চিন্তার ভিত্তে।

অগো গান্জুট্টি বাপের আছিলো জুয়া খেলার নিশা, গান্জা টাইন্না জুয়া খেইল্লা রোজ হারতো আর বাইত আইয়া মায়েরে দিতো ধাম্মুর ধুম্মুর মাইর। কিয়ের লেগা মায়ে বাজার সদাই আনতে কইত কি না কইত, ছুতা পাইলেই মাটিত ফালায়া খাড়ার উপরে লাথ্থাইত। লগ দিয়া আছিলো অগো দাদীর ঘর হেয় একটা টু শব্দনি করত, য্যান সবতে বোবা আর বয়রা। নিত্যদিনের এই জ্বালা দেখতে দেখতে কইতরি আর কমলে ডাঙ্গর হইতাছিলো আর অগো মোখের দিকে চাইয়া মায় সব হজম করতাছিলো।

পর্ব: ৪ 
এগারোয় পা দেওনের লগে লগে আতকা কইতরির মাসিকের খবর হয় আর ক্যামনে ক্যামনে জানি গায়ে গতরেও বাড়তে থাকে মাইয়ায়, কমলে তহন খালি আট বচ্ছর। কেটায় জানতো কি গজব নামবো অগো উপরে? জীবনটা এক আচানক বিষয়, ক্ষনে ক্ষনে রাস্তা বদলের মতোন জীবনডা বদলায় আর গবীরের লেগা আরো বেশি কইরা বদলায় মনে কয়। সবই কি নসিবের দোষ? 

এক আষাঢ় মাইস্যা রাইতে এমুন তুফান নামছে আর কওনের মতন না, এমনে দিনে মা আর বাবায় কমলরে লইয়া চৌকিত ঘোমায় আর কইতরি রান্ধন ঘরে পাটি পাইত্তা ঘোমায় আর হেই রাইতে ডরে ধরেছে নাকি মা বাবার ঘরেই মাটিত শুইয়া থাকে কইতরি। মাঝরাইতে ট্যার পায় শ্বাস বন্দ হইয়া যায় য্যান। অর মোখে কাপড় গুইজ্জা দুইহাত বাইন্ধা আপনা বাপে কি কাম করলো অর লগে এইটা? নিজের চোক্ষেরে বিশ্বাস করতে পারতাছিলো না কইতরি, কাম সাইরা সইটকা পড়ল বাপে। গ্যাঁ গ্যাঁ করতে করতে কইতরি ছটফটায় মাটিত আর রক্তে শইল ভিইজ্যা যায়। 

আধা ল্যাংটা কইতরির গোংগানির আওয়াজে মায় ধরফরায়া ওটে, কি রে কি অইছে জিগাইতে জিগাইতে মায় ট্যার পায় কি সর্বনাইশ্যা ব্যাপার ঘইট্যা গেছে। এই পরথম কইতরি মায়েরে এক রত্তিও কানতে দ্যাহে নাইক্কা। মায়ের ম্যান্দা মারা ডরপুক মোখটারে পাথ্থরের মতোন শক্ত লাগে দ্যাখতে। দুই চোখ দিয়া য্যান আগুন জ্বলতে থাকে মায়ের, কেউরে কিচ্ছু কয়না, খালি কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা সিদ্ধ গরম পানি দিয়া কইতরিরে গোসল করায়া দেয় আর কয় ডরাবি না মায় থাকতে আর কোনো ক্ষতি তর হইবো না।


পর্ব :৫ 

মুরগীমায়ে যেমুন পাখনার তলে বাচ্চাটিরে আগলায়া থোয় হেমুন কইরা অগো মায়ে আগলায়া রাখলো অরা সাবালক হওন পর্যন্ত। হেই গজবের ঘটনার পরেরদিন বিয়ানবেলা যহন কাক পক্ষী ডাকন শুরু করে নাই মায়ে অগো লইয়া পলায়া যায় কেউ টেরও পায় না। মার চাচাতো ভাই ফজলুমামার হাতে পায়ে ধইরা ট্যাকার যোগান করে ফিরত দেওনের শর্তে। এই যে অরা বাসে কইরা ঢাকা আইলো আর পিছন ফিরা যায় নাই কোনো কালে। ক্যান যাইবো অই নরকে? 

আসলে কি মাইয়া আর পোলা হগ্গল শিশুবাচ্চারে বহুত নজরে নজরে রাখন লাগে। মানুষজাতের ভিত্তে চিল কি হকুনের থাইক্যা বেশি দয়ামায়া ছাড়া জানোয়ার আছে, সুযোগ পাইলেই ছোবল মারে। আর ব্যাটাজাতের তো কোনো ইষ্টিশন নাই খালি ছ্যাদা হইলেই চলে। তয় আবার  ভালা মানুষও আছে নাইলে দুনিয়াটা অচল হইয়া যাইতো কবে। এই যে গান্ধা জীবনের কাহিনী মইধ্যে মইধ্যে খোয়াবে দ্যাহে কইতরি অর বোকের বামদিকে ধুপ্পুর ধুপ্পুর করে আর কান্দন থামতে চায় না।

ঢাকায় ফজলুমামার চিন পরিচয়ে গুপীবাগ বস্তিতে অরা একটা বেড়ার ডেরায় থাকনের জাগা পায়। কিছু একটা কামকাইজ করনের লেগা মায় অই বস্তির দুয়ারে  দুয়ারে যায়। বহুত হুজ্জতের পর একটা হোডলের মশলা বাটনের কাম পায়। কমলে টোকাই দলের লগে ঘুইরা ঘুইরা জিনিস টোকায় আর কইতরি ঘরে থাইক্যা রান্ধন খাওনের ব্যবস্থাটা করে। একদিন কমলে খবর আনে এনজিও না কি হেরা ইস্কুল দিছে হেইনে গেলে খাওনও দেয়, পড়তেও দেয়। যাগো ইস্কুলে যাওনের সুযোগ নাই হেগো লেগা।


পর্ব :৬ 

টেরেডাস হোমস্ নাম এমুন এক বিদেশি এনজিও ঢাকার কয়েকটা জাগাত হেগো শাখা আছে, আরামবাগে কইতরি আর কমল দোনোজনেই যাওন শুরু করে। এক ট্যাকা জমা দিয়া তয় দোফর টাইমে ভাত খায় অরা, হের পরে চলে ল্যাখা পড়া গান বাজনা আর অগো লেগা থাকে কাউনছেলিং ওফিছার আফরোজা আফা, চম্পাদিদি অগো নার্স হেয় ছয় মাস বাদে একবার হগলতের স্বাস্হ্য পরীক্ষা করে।

কাইনছেলিং এ বেবাকটিরে নিজেগো কষ্ট, গান্ধা জীবনের কতা কওন লাগে। হেইর পরে আফায় নানান কতা দিয়া অগো বুজায়। একদিন যহন কইতরি নিজের কতা কইতে কইতে কাইন্দা জারে জার এমুন সমে মজনু অর হাত ধইরা বইয়া রইল কইতরি ট্যার পাইছিলো এই মানুষটার লগে অর জীবন গিট্টু খাইবো। হেইদিন মজনু কইছিলো অর বাপে ফালায়া যাওনের পর মায় আবার হাঙ্গা করে আর সতালি বাপে অরে নিতে চায় নাইক্কা, মায় পাষান দিলে কইয়া দেয় বাপরে নিজের রাস্তা নিজে দ্যাখগা আমি তরে রাখতে পারমু না। বয়স তহন মজনুর ছয় বচ্ছর হের পর থেকা মজনুর রাস্তাটাই আপনজন। 

তয় আফরোজা আফায় অগো কতো কিছু কিচ্ছা হুনায় বাপেরা কাছে মাইয়ারা বুলে বিদেশেও নিরাপদ না এমুন অনেক নজির আছে। বহুত মায়া মমতা কইরা এনজিওর হেরা সবাইরে দেইখ্খা রাহে। যারা ভালা মতন থাকে হেগো আবার বেশি পড়নের সুযোগ দেয় নাইলে কারিগরী শিক্ষা দেয়। মজনু আর কইতরি দুইজনেই হেমুন সুযোগ পাইয়া তেজগাঁও সেন্টারে যায়। মজনু ইলেকট্রিক টেকনিশিয়ানের কাম শিখে আর কইতরি শিখে সেলাইয়ের কাম।


পর্ব: ৭ 
আরামবাগ আর তেজগাঁও মিলায়া পাঁচ বচ্ছর কইতরি আর মজনু হেই এনজিওত থাকলো। হেইর পর নিজেরাই বাইর হইয়া আইল, অরা বিয়া কইরা তেজগাঁও বস্তিতে বাড়ী ভাড়া লইলো। কইতরি সিলাইয়ের কাম কইরা ট্যাকা জমায় দুইটা সিলাই মেশিন কিনলো, মজনুয়ে ইলেকট্রিক মিস্তিরির কামে ভালা কামাই করন শুরু করল। অগো ঘরে একটা আঠারো ইন্চি রংগীন টিবি অইলো, আল্লায় রহম করলে কি কিছু ঠেকায়? বিয়ার চাইর বচ্ছরের মিধ্যে মানিকে জন্ম লয়। 

অগো জীবনটা ভরা পুরা। কইতরির মায়, কমলে ভালাই  আছে, গুপীবাগ বস্তি থুইয়া অহন এট্টু ভালা জাগাত থাকে।  মায়ে একটা মেটার্নিটি ছেন্টারে আয়ার কাম করে। কইতরি খোদার কাছে দুইহাত তুইল্লা দোয়া করে য্যান বাকি জীবনটা এমুন সোন্দর যায়। আস্তে আস্তে টেইলারিংয়ের দোকান দেওনের ইচ্ছা আছে কইতরির, মজনুয়ে ক্ষ্যাপের কাম থুইয়া নিজের ইলেকট্রিক রিপিয়ারিং দোকান দিবো চিন্তা করে আর অরা মতে মতে ট্যাকা জমায় অরা।

গান্ধা জীবনের হেই গজইব্বা খোয়াব দেইখ্খা ধড়মডায়া উইঠ্ঠা বহে কইতরি হেই রাইতেই, সারা গতর পুইডা যায় নাকি এমুন পোড়া ঘেরান আহে কইত্তে? ঠাহর পায় কি পায় না চিক্কুর বাক্কুরে তামানটা বস্তি থরথরায়া কাঁপতে থাকে য্যান, জান লইয়া দৌড় পারে হগ্গলতে, এইবার কইতরির জ্ঞান আহে, বস্তির মিধ্যে আগুন লাগছে। পড়ি কি মরি কইরা মানিকরে বোকে লইয়া এক কাপড়ে বাইর হইয়া যায়, পইড়া থাকে সিলাই মেশিন, টিবি আর মাটির ব্যাংকে জমাইন্না অগো স্বপ্নের দোকান। আগুনের লকলইক্ক্যা জিব্বাটা গরীবের সব গিল্লা খায় কইতরি বোক থাবডায় আর চিক্কুর দেয় মাবুদ তুমি ক্যান খালি গরীবরেই মারো?