• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০১৯, ০৬:৩২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২৬, ২০১৯, ০৬:৩৪ পিএম

রবিউল হুসাইন চারদিক পূর্ণ করে মিলিয়ে গেলেন শুন্যতায়

রবিউল হুসাইন চারদিক পূর্ণ করে মিলিয়ে গেলেন শুন্যতায়

কোনোকিছুই কোনোকিছু নয়

নিভৃতি আনে মধুরিমা বিপন্ন মনোভূমিতে
একটু অবহেলা অকূল সাগরে ডুবে যায়
দূরে আকাশ ঝুলে আছে শূন্যতার প্রামেত্ম
তবুও দৃশ্যমান অতলের কালে বিষণ্ণতা বিদায়

মেঘগুলো জলে ভরে গেলে মানুষ কী বলে
এখন বৃষ্টি পড়বে না কি মরুভূমি সাগর হবে
অতঃপর বজ্রপাতে ছিন্নভিন্ন হয় প্রিয় বিহবলে
আর কী হবে মানুষের মঙ্গলবিভা থিতু বৈভবে

কোনোকিছুই কোনোকিছু নয় খানিক ইঙ্গিতময়
যদিও সম্পূর্ণতা সবসময় পরিবর্তনের প্রস্ত্ততি
পরিস্থিতি নিবিড় চাষের বিনম্র আলিঙ্গনে ঘন হয়
সাধারণত অসাধারণত্ব কোনোদিন পায় না স্বীকৃতি

দুঃখ নিরানন্দ সর্বদা অদৃশ্যতার অবগুণ্ঠনে লুপ্ত
হাসি আনন্দ সুখ সব উদ্ভাসিত বৈপরীত্যে সুপ্ত।

তার এ কবিতার চরনগুলোতে একটা নিরানন্দ একটু বেদনা ভর করে আছেই। দুঃখবাদীতা তার কবিতায় ছিলো খুব করেই ছিলো। তার কবিতা গল্প প্রবন্ধ স্মৃতিচারনের মধ্যেই ভর করে থাকেতো এই দুঃখবাদিতা। কথা বলতে বলতে মুগ্ধতায় কখনো জল ছল ছল করে উঠতো। কবিতার নন্দনতত্ত্ব নিয়ে তিনি বলতে খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। তার কাছে গেলে এতো দ্রুত দীর্ঘ সময় কেটে যেতো তা বলার নয়। স্যাড জেনারেশন নামে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তা ছোটখাট নয়। তার সময়ের সব গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের নিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি তার আন্দোলন। তার কবিতায় জীবনের ছাপ আছে, আছে তার স্যাড আন্দোলনের ছাপও। তিনি কবিতা অন্তঃপ্রান হলেও শুধু কবিতার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। একাধারে তিনি স্থপতি, কবি, শিল্প-সমালোচক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী। পেশা স্থাপত্যশিল্প হলেও সম্পৃক্ততা ছিল বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস মিলিয়ে দুই ডজনেরও বেশি বই রয়েছে তার। স্থপতি, কবি, শিল্প-সমালোচক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে তার সরব পথচলা ও সাফল্য ছিলো ঈর্ষণীয়।
তার মতে, ‘কবিতা- মানুষের প্রতিধ্বনি, মানুষ ও কবিতার প্রতিভূ। কবিতা স্বপ্ন, সংগ্রাম, ভালোবাসা, জীবন ও বাস্তবতার ভাষ্যরূপ দেয়। বিভিন্নভাবে মানুষ ও দেশকে বিভক্ত করা হয়, তার বিপরীতে কবিতা সবাইকে শান্তি ও কল্যাণে এবং শ্রেয়বোধে উজ্জীবিত করে। 
ষাটের দশকে ছাত্র থাকাকালেই তার বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস মিলিয়ে দুই ডজনের বেশি বই রয়েছে তার। তবে বড় কথা হলো আমেরেকিার বিট জেনারেশন, কলকাতার হাংর জেনারেশনের মতো বাংলাদেশেও তৈরী হয়েছিল স্যাড জেনারেশন। রবিউল হুসাইন সে আন্দোলনের পুরোধাদের একজন ছিলেন। তারা ‘না’ নামে একটি কাগজও বের করেছিলেন। সে প্রসঙ্গে রবিউল হুসাইনের একটি লেখার উদ্ধৃতি দিচ্ছি-স্যাড জেনারেশনের ‘না’    

    ‘১৯৬৪-৬৫ সাল তখন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি স্থাপত্য বিভাগে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সনাতন আবহাওয়াতে স্থাপত্য বিভাগ এক খোলা-বাতাসের জানালার সন্ধান দেয়। মেয়েদের প্রথম ছাত্রী হিসেবে আসা এবং সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অনুরণন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প-সংস্কৃতির এক প্রচ্ছন্ন ছাপ পড়তে থাকে স্থাপত্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা। পয়লা বৈশাখ উদযাপন, দেয়াল পত্রিকা বের করা, ছাত্রাবাসের বিভিন্ন পত্রিকা, নতুন আঙ্গিক এবং লেখালেখিতে নতুন ভাবনা-চিন্তা এ সময়েই প্রকাশিত হতে থাকে। ঢাকার সাহিত্য আবহাওয়াতে তখন খুদে পত্রিকার খুব ধুম। বিলেতের রাগী আর আমেরিকার বীট গোষ্ঠীর লেখালেখি আর ওদিকে সাত্রের অস্তিত্ববাদী গল্প-উপন্যাস এবং এর সঙ্গে কামু-কাফকার অন্ধকার-মগ্ন শিল্প-সাক্ষাৎ আমাদের হয়েছে। ককতো-রায়-বেয়ারীম্যানের চলচ্চিত্র এবং লুইকানের স্থাপত্য সব চাক্ষুষ দেখছি। রাজনীতিতে ভাষা-আন্দোলন থেকে জাতীয়তাবাদী মানসিকতার রূপরেখা ও তার বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া চলছে দ্বিজাতিতত্ত্বের সৃষ্টি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতায়।

প্রথাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের ধারে কাছে না গিয়ে ঠিক সেই সময় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু কাজী সাহিদ হাসান ফরিদ, তাজু চৌধুরী, সায়ীদ মোস্তাফা কামাল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মাহবুব হোসেন খান ঠিক করলাম যে একটি নতুন ধরনের পত্রিকা বের করবো, নাম হবে ‘না’।
প্রথম সংখ্যায় কবি রফিক আজাদও ছিলেন, তখন ‘স্বাক্ষর’ পত্রিকায় কবিকুল লিখে চলেছেন। প্রথম সংখ্যা ‘না’-তে আমাদের আরেক বন্ধু ইনামুল কবীর ব্রক্ষ্মা লিখেছিলেন। এখন তিনি অকালপ্রয়াত। প্রথম সংখ্যাটি ছিল সাধারণ মানের, বিশেষ করে আঙ্গিকের ক্ষেত্রে এবং বিষয়ে। তবে প্রথম থেকেই মেকী প্রেমের আহাজারি আমরা বাদ দিতে চেষ্টা করি জেনেশুনেই এবং এক ধরনের নির্লিপ্ততা প্রাপ্ত হই। আর তাই অন্যান্য অনেক পত্রিকার সঙ্গে আমাদের ‘না’-এর এই দিকটির পার্থক্য উল্লেখযোগ্য ছিল, হয়তো এ কারণেই একটু আলাদা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছিল।’(স্যাড জেনারেশনের ‘না’ -রবিউল হুসাইন, খোলা কাগজ-১৮ জানুয়ারি.২০১৯)


তারপরও একথা বলতেই হয় স্থপতি রবিউলের ঝোঁক ছিল ইটের কাজের দিকে। তার নকশায় বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ কাউন্সিল (বিএআরসি) ভবনটি ছিল তার প্রিয় একটি কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তি ও স্বাধীনতা তোরণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট, ভাসানি হল, বঙ্গবন্ধু হল, শেখ হাসিনা হল, খালেদা জিয়া হল, ওয়াজেদ মিয়া সায়েন্স কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়াম ও একাডেমিক ভবন কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে রবিউল হুসাইনের নকশায়। রবিউল হুসাইন সাহিত্য ও স্থাপত্য সবদিক পরিপূর্ণ করে রেখেছিলেন তার কাজ দিয়ে। বাঙালির হাজার বছরের অর্জন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রাণ থেকে প্রানে ছড়িয়েঢ দিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে তুলওেত তার অবদান বিশাল। েএতকাজ চারদিকে রেখে গেছেন তিনি,যার মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

ঝিনাইদহের শৈলকূপার সন্তান রবিউল হুসাইনের জন্ম ১৯৪৩ সালে। কুষ্টিয়ায় মেট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে তিনি ভর্তি হন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির (বর্তমান বুয়েট) আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টিতে।ভাষা ও সাহিত্যে অবদান রাখায় ২০১৮ সালে একুশে পদক পান কবি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, স্থপতি রবিউল হুসাইন। 
১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারিতে ঝিনাইদহের শৈলকুপার রতিডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রবিউল হুসাইন। কুষ্টিয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে তিনি ভর্তি হন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির (বর্তমান বুয়েট) আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টিতে। ছাত্রজীবনেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস মিলিয়ে দুই ডজনের বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। ১৯৬৮ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং স্থপতি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।


রবিউল হুসাইনের নকশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তি ও স্বাধীনতা তোরণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ফটক, ভাসানী হল, বঙ্গবন্ধু হল, শেখ হাসিনা হল, খালেদা জিয়া হল, ওয়াজেদ মিয়া সায়েন্স কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম ও একাডেমিক ভবন কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে।
বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য রবিউল শিশু-কিশোর সংগঠন কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।

রবিউল হুসাইনের লেখা উল্লেখযোগ্য বই হলো ‘কী আছে এই অন্ধকারের গভীরে’, ‘আরও উনত্রিশটি চাঁদ’, ‘স্থিরবিন্দুর মোহন সংকট’, ‘কর্পূরের ডানাঅলা পাখি’, ‘আমগ্ন কাটাকুটি খেলা’, ‘বিষুবরেখা’, ‘দুর্দান্ত’, ‘অমনিবাস’, ‘কবিতাপুঞ্জ’, ‘স্বপ্নের সাহসী মানুষেরা’, ‘যে নদী রাত্রির’, ‘এইসব নীল অপমান’, ‘অপ্রয়োজনীয় প্রবন্ধ’, ‘দুরন্ত কিশোর’, ‘বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘গল্পগাথা’, ‘ছড়িয়ে দিলাম ছড়াগুলি’ ইত্যাদি।