• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৫, ২০২০, ০৪:০৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৫, ২০২০, ০৪:০৭ পিএম

বিপ্লবের কবি নাজিম হিকমত

বিপ্লবের কবি নাজিম হিকমত

কবিতা নিয়ে যে কোন আলোচনায়,আড্ডায়, আবৃত্তি,কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার কবিদের মতো যে ক'জন বিদেশী কবির নাম সমানভাবে উচ্চারিত হয় নাজিম হিকমত তাদের  অন্যতম। বিশেষ করে তার ‘জেল খানার চিঠি’ আমাদের যেকোন আন্দোলন সংগ্রামে নতুন করে শক্তি জোগায়।আর এই কবিকে অনুবাদ করে বই আকারে প্রকাশ করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আর এক প্রগতিশীল কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

নাজিম হিকমতের জন্ম ১৯০২ সালের ১৫ জানুয়ারি গ্রিসের সেলোনিকা অঞ্চলে। সেলোনিকা গ্রিসের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর। তৎকালীন সময় ওই অঞ্চল তুর্কী সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। বাবা হিকমত বে ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা। তার পড়াশুনা শুরু হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে। ১৯১৮ সালে তিনি ইস্তাম্বুলে অবস্থিত তুর্কিশ নেভাল একাডেমি থেকে স্নাতক অর্জন করেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার শর্ত অনুজায়ী তিনি নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯১৯ সালে হিকমত স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন এবং ১৯২০ সালে নেভাল সার্ভিস থেকে অব্যাহতি নেন। ১৯২১ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। তার বন্ধু ভালা নুরেট্টিন, ইউসুফ জিয়া অরার্থক এবং ফারুক নাফিজ সহ আনাতোলিয়া অঞ্চলের ইনেবুলুতে যায়।
ওই অঞ্চল তখন তুরস্কের জাতীয় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এ আন্দোলন ১৯১৯ সালের ১৯ মে থেকে ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত চলে। পরবর্তীতে হিকমত ও তার বন্ধুরা তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় তুরস্কের কিংবদন্তী নেতা মুস্তফা কামাল পাশার (কামাল আতাতুর্ক) সাথে সাক্ষাত করেন। কামাল পাশার অনুরোধে  লেখা তার কবিতা আন্দোলনরত মানুষের কাছে খুব প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়। কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি কমিউনিস্ট আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন।

১৯২২ সালে তিনি মস্কো গমন করেন। এখানে নতুন করে পড়ালেখা শুরু করেন। কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অব দ্যা টইলার্স অব দ্যা ইস্ট ( Communist University of the Toilers of the East) –এ অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ২১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়। । এখানে বিভিন্ন উপনিবেশিক কমিউনিস্ট কর্মীদের পড়াশুনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এখানে হিকমতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিখ্যাত কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি এবং থিয়েটার বিশারদ ভেসেভুলুড মেয়ের হোল্ডের সাথে পরিচয় হয়, যা পরবর্তীতে তাঁর শিল্প চর্চায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মতাদর্শ তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে অনেক সমৃদ্ধ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর জীবন ও কবিতায় ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কমিউনিস্টসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের পর তাঁর কবিতা আরো তীক্ষ্ণ এবং শানিত হয়ে ওঠে। ১৯২৪ সালে তুরস্ক স্বাধীনতা লাভের পর হিকমত তুরস্কে ফিরে আসেন এবং একটি বামপন্থী পত্রিকায় যোগ দেন ।

বাম মতাদর্শে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি পালিয়ে মস্কো চলে যান। এই সময় তিনি প্রচুর কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯২৮ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করায় দেশে ফিরে আসেন। ততদিনে তুরস্কে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। ঐ সময় গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাকে নজরদারিতে রাখতো। এত কিছু করেও হিকমত কে দাবিয়ে রাখা যায়নি। শোষিত, নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা। ফলে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের কাছে তিনি মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে ওঠেন। ১৯২৮ সাল থেকে পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে পাঁচ বছর তাকে কারাগারে বন্দি থাকতে হয়। তাঁর জনপ্রিয় অধিকাংশ কবিতা জেলখানায় বসে লেখা। জেল জুলুম তাঁকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। এই সময় তিনি নয়টি কবিতার বই লেখেন।

১৯৩৮ সালে তাঁকে দীর্ঘসময়ের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। এবারের অভিযোগ গুরুতর। শাসকশ্রেণির মতে তাঁর কবিতা সামরিক বাহিনীতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে । সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হচ্ছে তাঁর কবিতা মিলিটারি ক্যাডেটরা পড়ছে এবং বিপ্লবী চেতনার উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। বিচারে তাঁর ২৮ বছর জেল হয়।
১৯৪৯ সালে চিলির আরেক বিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদা, আমেরিকার গণসংগীত শিল্পী পল রবসন এবং ফরাসি দার্শনিক ও নাট্যকার জাঁ পল সার্ত্রের নেতৃত্বে নাজিম হিকমেতের মুক্তির দাবিতে আন্তর্জাতিক কমিটি গঠিত হয়। ১৯৫০ সালে নাজিম হিকমত পাবলো নেরুদার সাথে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তুরস্কে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলে হিকমত মুক্তি লাভ করেন।কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলরা তার পিছু ছাড়ছিলনা। তাঁকে দু’বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। তিনি রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।এই সময় তুরস্কের সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করেন।

১৯৬৩ সালে ৩জুন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মস্কোতে মৃত্যু বরন করেন। মৃত্যুর পরো তুরস্কের জনগনের মধ্যে তার প্রভাব এতোটুকু কমেনি বরং দিন দিন তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ৫০ বছর পর তুরস্কের সরকার তাঁর নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ২০০০ সালে পাঁচলাখ মানুষ নাজিম হিকমতের দেহাবশেষ তুরস্কে ফিরিয়ে আনার দাবি জানায়। মেহনতী মানুষের সংগ্রাম দেশে দেশে যত ছড়িয়ে পড়ছে নাজিম হিকমত হয়ে উঠছে তাদের কবি। তার কবিতা হয়ে উঠছে মুক্তিকামী গণসংগ্রামীদের মুক্তিসংগ্রামের ইস্তেহার।