• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৯, ২০২০, ০৮:০৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৯, ২০২০, ০৮:৩২ পিএম

হক ফারুক আহমেদ এর নির্বাচিত গল্প

হক ফারুক আহমেদ এর নির্বাচিত গল্প

ছো ▪ ট ▪ গ ▪ ল্প

নাডা

হ ক  ফা রু ক  আ হ মে দ

১.
বেশ কোমল স্বরে তালুকদার বলল, মজিদ কও তো এই মুহূর্তে আমার মনের ভেতরে কী আলাপ চলতেছে? যদি কইতে পারো তাইলে তোমার কোনো ক্ষতি করুম না। সম্মানে বাড়িতে চইলা যাবা। তোমারে কেউ আটকাইয়াও রাখবে না। আমি ধার্মিক মানুষ। সকলেই জানে, মিছা কথা কই না। সত্যিটা কইতে পারলে আমিই কব, হ্যাঁ ও সত্যি কইছে। আর যদি ঠিক কথাডা না কইতে পারো তাহলে কঠিন শাস্তি আছে। কী বলেন সকলে?

উঠোন ভর্তি রসূলপুর গ্রামের মানুষ একসঙ্গে বলে উঠল, তালুকদার সাব ঠিক কথাই কইছেন। আমাগো সবারও একই কতা।

মজিদকে দুই দিকে তালুকদারের দুই চামচা কালিম ও রহিমুদ্দিন বগলদাবা করে ধরে রেখেছে। জোরে একটা হাতঝারা দিয়ে মজিদ একটু উঁচু স্বরেই বলল, আমি কি চোর নাকি? কোনখানে তো ভাইগাও যাইতাছি না। জানতি চাইছেন, উত্তর দিতাছি। এইখানে তো এত নখরামির কিছু নাই। তালুকদার সাব আফনে এখন ভাবতাছেন— ওই মজিদ্দারে তোর পাছায় যদি কইস্যা দুইটা লাত্থি মারোন যাইত অহন; আরাম পাইতাম। আর তার একটু আগেই ভাবতাছিলেন— ক্যামনে কইরা লালু মিয়ার মাইয়্যাটারে বিছানায় নেওয়া যায়। কোন ফন্দি-ফিকিরে, ফুসলাইয়া, ফ্যাসাইয়া নাকি লোভ দেখাইয়া। আর তা না হইলে জোর কইরা...।

কালিম চিৎকার দিয়ে বলল, ওই মজিদ্দা তোর এত সাহস ক্যামনে অইলো যে তুই তালুকদারের নামে এত বড় কথা কছ? তোর দিলে কি ভয়-ডর নাইরে?

রহিমুদ্দিন মৃদু স্বরে বলল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ কারে নিয়া কী কচ্ছে! মজিদের আসলে মাথাডাই গ্যাছে। ওরে ভালা ডাক্তার দেহান দরকার।

এইবার চেয়ারে বসে উশখুশ করতে থাকা তালুকদার বলতে শুরু করল। গলার স্বর এবার আরও কোমল। নরম নরম করে বলতে শুরু করে, মজিদ যা কচ্ছে তা ঠিক...।

জোয়ান বুড়া সবাই তার দিকে তাকিয়ে, কী কতা কন?

সবাইকে দু’হাত তুলে চুপ করিয়ে দিয়ে তালুকদার বলে ওঠে, তবে আংশিক। প্রথমে যেটা বলছে সেটা ঠিক। ওর পাছায় আমার লাথ্থি দিতে মন চাইতাছিল। কারণ, তার উপরে বড় শয়তান ভর করছে। তা নইলে কেউ কইতে পারে লালু মিয়ার কলেজগামী একটা নাদান মেয়েকে আমি... নাউজুবেল্লাহ। আমার চরিত্র খারাপ হইলে মানুষ আমারে বিচার-আচারে ডাকত? আমার কথা শুনত? কেউ কইতে পারব আমি জ্ঞানত কারো কোনো ক্ষেতি করছি। গ্রামের মুরব্বিরাসহ সকলে এহানে আছেন। এটা পরিষ্কার মজিদের মাথায় কোনো সমস্যা দেখা দিছে। এ জন্য তার চিকিৎসা দরকার। তার প্রথমটা এখনই শুরু হবে। বিএসসি মাস্টার, মৌলভী সাব, রেজিস্টারসহ দশজন মুরব্বি মজিদের দুই গালে দুইডা করে থাপ্পড় দিবেন। আমার দিল নরম, আজকে এটাই মজিদের শাস্তি।

ঠিক আছে ঠিক, আছে বলে সবাই তালি দিল। কেউ আর কোনো কথা বলল না। মুরব্বিরাও হুমুক তালিমে এগোল।

এ সময় মজিদ চিৎকার করতে বলতে লাগল, এইডা অন্যায়, একজন নির্দোষরে বিনা অপরাধে শাস্তি দেওয়া যায় না। আমি গরীব হইতে পারি, কিন্তু আইন-কানুন কিছু জানি। আমিও দেইখা নিমু।

এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালিম ও রহিমুদ্দিন মজিদকে উদ্দেশ্য করে বলে, চুপ থাক হারামজাদা। এবার কিন্তু আমরাও কইষ্যা দুইটা দিমু গালে। ওরা দুইজন মজিদকে এবার আরও শক্ত করে ধরল। তালুকদারের বাছাই করা দশজন মুরব্বি একের পর এক এসে মজিদের দুই গালে দুটো করে তাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সবাই খুব মনোযোগ সহকারে সেটা দেখছে। দেখে মনে হয় বড়পর্দায় কোনো সিনেমা চলছে।

মজিদকে শাস্তি দেওয়ার পর্ব শেষ হতেই তালুকদার বলে, মজিদ সোজা হইয়া যাও। এইসব ভণ্ডামি ছাড়ো। কইরে বাজার থেইক্কা যে মিষ্টি আনছোস হেগুলা সবাইরে খাইতে দে। এতদিন পর গ্রামে একটা সুন্দর সালিশ হইল। মজিদরেও একটা মিষ্টি খাওয়াইছ।

সবাই মিষ্টি খেয়ে তালি দিতে দিতে যার যার বাড়ি চলে গেল। মজিদ রাগে, দুঃখে তালুকদারের বাড়ির উঠোনে এক কোণায় কিছুক্ষণ বসে রইল। কাঁদতে গিয়েও চোখ থেকে পানি নিচে পড়ল না; গাল মুছতে মুছতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে উঠোন ত্যাগ করল। 

২.
গত কয়েকদিনে রসূলপুর গ্রামের গরীব দিনমজুর মজিদকে নিয়ে বেশ হৈ চৈ। কারণ মজিদ কিছুদিন ধরে মানুষের মনের কথা বলে দিতে পারছে। শুধু তাই নয়, যাকে নিয়ে বলছে অদূর ভবিষ্যতে তাকে ঘিরে বা তার আশেপাশে কি ঘটবে সেটাও বলে দিচ্ছে সে। যার কোনো কেনোটা হুবহু ঘটে যাচ্ছে। এই তো গেল বৃহস্পতিবার মোড়ের এক চায়ের দোকানে শব্দ করে চা খেতে খেতেই আজম ব্যাপারীকে বলছিল, কী মিয়া গাঁজার ব্যবসা কইরা তো গ্রামের উঠতি পোলাপাইটিরে নষ্ট করতাছ। মনে মনে ভাবতাছ ইয়াবা নিয়া আসবা। বেশি বাইড়ো না মিয়া, ডান্ডা খাইয়া কিন্তু ঠান্ডা হইয়া যাইবা। এসব শুনে আজম ব্যাপারী মজিদকে মারতে উঠেছিল। আশেপাশের লোকজন ঠেকায়। পরে গালি দিতে দিতে দোকান থেকে বেরিয়ে যায় সে। ঠিকই তার সপ্তাহখানেক পর ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে ধরা খায় আজম ব্যাপারী। অনেকে বলেছে, বেদম পিটুনি পড়ছে। এখনও জামিন নিতে পারেনি।

তার কয়েকদিন আগে শামু মিয়াকে দেখে বলেছিল, এত চিন্তার কিছু নাই। যে যাবার সে যাবে। শামু মিয়া তখন কথাটা খুব একটা আমলে নেয়নি। ঠিকই দুই দিন পর শামু মিয়ার বউ এক জোয়ান ছেলের সঙ্গে ভাগে। পরকীয়া। শামু মিয়া পরে জানায়, এই ছেলের সঙ্গে বউকে নাকি একবার হাতেনাতে সে ধরেওছিল। কিন্তু লজ্জায় কাউকে কিছু বলেনি। কিন্তু এই খবর মজিদ আগেই জানল কীভাবে?

এখানেই শেষ নয়। মজিদ যে শুধু খারাপ খবর দিচ্ছিল তা নয়। ভালো ভালো অনেক কথাও সে মুখ দেখে চেহারা দেখে বলে ফেলছিল। সেদিন রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা হয় নয়নের। খুব ভালো ছেলে, ভালো রেজাল্ট করেও বেকার। নয়নের সঙ্গে সদিন আরও ছিল ওর বন্ধু সাজেদ। মজিদ চলতি পথে নয়নকে কাছে ডেকে বলেছিল, তোমার এইবারের পরীক্ষাটা বেশ ভালো হইছে বাবা। এত টেনশনের কিছু নাই। তুমি ভালো ছেলে, তোমার বাবা-মায়ের দুঃখের দিন শেষ। তোমার চাকরিটা এবার হইব। ঠিকই ভাইবা পরীক্ষায়ও উতরে গিয়ে নয়ন পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে ভালো চাকুরি পেল। আর এভাবেই মজিদের কথা গ্রামের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে গেল। কারণ, এখানে খবর বাতাসের আগে দৌড়ায়। অবশ্য এতে মজিদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে তা বলা যাবে না। সে সবাইকে দেখে কথা বলে না। কারো কারোটা এমনিতেই বলে ফেলে। আর কারোটা অনেক জোরাজুরির পরও বলে না। ইচ্ছে করলেই ভবিষ্যদ্বাণী দিতে পারে— এমনটা বলে একটা আস্তানা খুলে বসতে পারত। দিনমজুর মজিদ থেকে বনে যেতে পারত ‘বাবা মজিদ পাগলা’ বা ‘মজিদ ভবিষ্যৎ বাণীদাতা’ এমন কিছু। এভাবে খুলে বসতে পারত ব্যবসা। কিন্তু এসবের কিছুই মজিদ করেনি। সে এখনও পরের জমিতে দিনমজুরি করে। কিন্তু তার পরেও তাকে নিয়ে গ্রামের অনেকেই ভয়ে ভয়ে থাকে। কখন কোন কথা বলে ফেলে, কী চিন্তা করতে গিয়ে কোন গোমর ফাঁস হয়ে যায়— এ নিয়ে কারো কারো রাতের ঘুম হারাম।

তালুকদার আর মজিদের বয়সের পার্থক্য খুব বেশি নয়। দু’জনই চল্লিশোর্ধ। তালুকদার মজিদের চেয়ে বছর কয়েকের বড় হবে। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পার্থক্য তা হল তালুকদার ধনী আর মজিদ গরীব। হঠাৎ মজিদের এইরকম আশ্চর্য ক্ষমতায় সবচেয়ে বেশি চিন্তিত তালুকদার। তার পেটের অনেক খবরই মজিদের জানা আছে। নানা চুরি-চামারি, দুর্নীতির পাশাপাশি তালুকদারের বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সে নারীলিপ্সু। আর এই ব্যাপারে তার টার্গেট হল গ্রামের গরীব ঘরের মেয়েরা। নানা ফন্দি-ফিকির ছলনার বেড়াজালে ফেলে সে তরুণী মেয়েদের সর্বনাশ করে। তারপর মুখ বন্ধ করতে চলে আরেক ধরনের ফন্দি-ফিকির। গরীব ঘরের বলে তরুণীদের অনেকে কিছু বলতে চেয়েও বলে না। অনেক সময় আবার টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখে। আর এইসব কুকর্মে তাকে সর্বদা সহযোগিতা দেয় কালিম ও রহিমুদ্দিন। মজিদ এ রকম অনেক ঘটনাই জানে; গ্রামের আরও অনেকেও জানে। কিন্তু তালুকদার প্রতাপশালী বলে কেউ কিছু বলে না। নীরবে সব হজম করে। এদের মধ্যে মজিদ আবার একটু আলাদা। সে বেশ কয়কবার তালুকাদারের এসব কুকর্মের প্রতিবাদ করেছে, থানায় জানিয়েছে। যদিও তার কোনো কিছুই কাজে দেয়নি। তালুকদারের সাম্প্রতিক কুকর্মের সবচেয়ে বড় সাক্ষী মজিদ।

রিকশাচালক লালু মিয়ার অষ্টাদশী মেয়ে তামান্না ওদের বাড়ির পুকুরঘাটে গোসল করছিল। অনতিদূরে পুকুরঘাটের পাশ ঘেষেই একটা রাস্তা চলে গেছে বাঁধের দিকে। সাধারণত এদিকটাতে মানুষের আসা-যাওয়া খুব একটা নেই। ওইদিন তামান্না গোসল করার সময়েই ওইপথ দিয়ে যাচ্ছিল তালুকদার। হঠাৎই তার চোখ পড়ে তামান্নার গোসল করার দিকে। তাৎক্ষণিক সে পকেট থেকে নতুন কেনা অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোনটার ভিডিও অপশন অন করে চলে যায় বাঁশঝাড়ের দিকে। চুপিচুপি তামান্নার গোসল করার দৃশ্যের অনেকটাই ভিডিও করে সে। মজিদ সেদিন কাছাকাছি একটা ক্ষেতেই দিনমজুর খাটছিল। দুপুরের খাবার খেতে যাওয়ার পথে তালুকদারের এসব কা-কারখানা দেখে ফেলে। মজিদ তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টা বুঝতে পেরে তালুকদারকে উদ্দেশ্য করে বলে, কামডা কিন্তু বালা হইতাছে না তালুকদার সাব।
— কামলা মজিদ, যেই কামে যাইতাছোস হেই কামে যা। ডিস্টার্ব করিছ না। 
— বয়স তো অইছে, এগুলা ছাড়েন। মাইয়্যাটা আফনের মাইয়্যার বয়সী। 
— ওই হারামজাদা, জ্ঞান দিতে আসবি না। আমি এত সুন্দর একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য ভিডিও করতাছিলাম! তুই বাঁধা দেছ কোন হিসাবে রে?
— প্রাকৃতিক দৃশ্য না, আরেকটা মেয়ের সর্বনাশের ফন্দি-ফিকির করতাছ তা আমার বুঝা হইয়া গেছে। হাতে বাটালি আছে কইলাম। ওইটা এহনই মুইছা দাও। নইলে বাটালির বাড়ি তোমার গায়ে পড়ব।
— তোর এত বড় সাহস তুই আমারে মারবি। এত বড় অইছে তোর কলিজা।
— কলিজার দেখছছ কী ওই নাডা! ওইডা মোছ নইলে দিলাম বাটালের কোব।
— আমারে তুই নাডা কছ? কোব দিবি? খাড়া আমি এর শেষ দেইখা ছাড়ুম।
— শেষ পরে দেহিছ। আগে ওইডা মোছ মোবাইল থেইকা। আইজ তোর একদিন কি আমার একদিন।

এই কথা বলেই তালুকদারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে মজিদ। অবস্থা বেগতিক দেখে উল্টো পথ ধরে ক্ষেতের আইল ধরে এক দৌড় দেয় তালুকদার। বাটালি হাতে পিছু ধাওয়া করতে থাকে মজিদ। তালুকদার লুঙ্গি কোচ দিয়ে এমন দৌড় দেয় যে মজিদ পেরে উঠে না। শেষ পর্যন্ত বাটালিটা ছুঁড়ে মারে তালুকদারের দিকে। সেটা সজোরে গিয়ে আঘাত হানে তালুকদারের কোমরে। তালুকদার ও মাগো ও মাগো বলতে বলতে পালায়।

৩.
তালুকদারের বৈঠকখানায় স্কুলের বিএসসি মাস্টার, মৌলভী সাহেব, কালিম, রহিমুদ্দিনসহ তার কুকর্মের সঙ্গী অনেকেইে হাজির। বৈঠকের শুরুতেই তালুকদার বলে ওঠে— ‘তোমগো চোখে কি কিছু ধরা পড়তাছে না? মজিদের এই অত্যাচার চলতে থাকলি তো গ্রামে আমরা আর কিছু কইরা খাইতে পারমু না। মানুষের দীল থেইকা আমগো উপর যে ভয় ডর যা ছিল তা তো যাইবই তার সঙ্গে সঙ্গে ইজ্জতও যাইব। কী বিএসসি কতা কও না কেন?
বিএসসি মাস্টার উত্তর দেয়, ‘মজিদের বিচার তো করলেন। এইবার নিশ্চয়ই থাইমা যাইব। আর আফনে স্কুলের নামে, এই নামে সেই নামে তো আর কম দখল দিলেন না। এইবার একটু রইয়া সইয়া করেন তাইলেই তো অয়।’
বিএসসি’র কথায় উত্তেজিত তালুকদার বলে, না মজিদ থামব না। ওর কঠিন শাস্তি দরকার। ওই বিএসসি, আমি যে দখল দিছি তার ভাগ তুমিও তো পাইছ। ওই দখলের জমিতে কোচিং সেন্টার দিয়া তো এখনও তোমার সব চলে, ভুইলা গেছ ?

মৌলভী সাহেব বলে, আল্লায় তো আপনেরে কম দেয় নাই। দুইখান বিবি আর পোলাপাইনও আছে। সুদের কারবার, গম, চাউল মাইরা টেহাও বানাইছেন। খায়েস এহন একটু কমাইলেই তো অয়। সময় তো চইলা যাইতাছে না।

মৌলভীর দিকে চোখ পাকিয়ে তালুকদার বলে, ওই টেকায় যে মসজিদ পাশে আফনেরে একটা ঘর বানাই দিছি। বড় বড় কতা কইয়েন না। আমার মাঝার কাডাটা এহনও চিনচিন কইরা ব্যথা করতাছে। তোমগো এসব কথা হুনলে তো মনে অয় ঘায়ের মধ্যে নুনেন ছিডা মারতাছ। আমি ওরে রাহুম না। দুনিয়া থেইক্কা বিদায় দিয়া দিমু। অয় বাঁইচ্চা থাকলে আমার কোনো খায়েসই আর পূরণ অইব না। ওরে মাইরা আমি তামান্নার লগে একটু বাকবাকুম খেলুম।  

মৌলভী ও মাস্টার দুজনই— আপনের যা করার করেন। এর আগেও আফনের লাইগা বহুত থানা পুলিশ করতে অইছে। আকাম করেন আফনে দৌড়াইতে অয় আমগো। এইসব খুনাখুনির মধ্যে আমরা নাই। গেলাম।

মৌলভী আর মাস্টারসহ আরও দু’-একজন বেরিয়ে গেলে বাকিদের নিয়ে তালুকদার আবার বসে। ওই কালিম, ওই রহিমুদ্দিন তরা আছোস আমার লগে? পিস্তল আর গুলি দুইটাই রেডি আছে। হাটবারের দিন মজিদ সদাই করতে বাজারে আসে। রাইতের বেলা বাড়িত যায়। তবে আগামী হাটবার আর বাড়িত যাইব না। উপরে যাইব, ‘উপরে’ বলেই হাসতে থাকে তালুকদার। 

কলিম ও রহিমুদ্দিন হাসি থামলে বলে, কিন্তু তালুকদার সাব একটা তো সমস্যা হইয়া গেল। মজিদ তো এহন মাইনষ্যেরে দেইখাই অনেকে কতা কইয়া ফালায়। আমাগো মনের ভেতরেও তো হেরে খুন করার কথাটা আইব। অর লগেও দেহা অইব। মজিদ যদি বুইঝা ফেলাব আমরা ওরে খুন করব। আপনেরে দেখলেও তো বুইঝা ফালাইতে পারে। 

তালুকদার বলে, আরে রাখ। এইসব অইলো সব ভণ্ডামি। বুঝলেই কী, আর না বুঝলেই কী? অয় কী পলাইতে পারব? অরে মাইরাই আমি ক্ষান্ত অমু।

হাটবারের দিন মজিদ বাজার শেষ করে বাড়ি ফেরার পথ ধরল। তার পিছু নিল কালিম ও রহিমুদ্দিন। তাদের সঙ্গে পিস্তল। এক শ’ হাত পেছনে তালুকদার তাদের অনুসরণ করছে। সুনিপুণভাবে কাজটা সম্পন্ন করার জন্য সে-ও কাপড়ে মুখ লুকিয়ে এগিয়ে যায়। ঝোপঝাড় পেরিয়ে শ্মশানের কাছাকাছি আসতেই পূর্ণিমার আলোর মধ্যেও কেমন একটা আঁধার ধরা পড়ল। তারপর একটা গুলির শব্দ। বাঁচাও বলে চিৎকার। তারপর আরও কয়েকটা গুলির শব্দ।

৪.
থানা হাজতের সামনে তালুকদারের লাশ। গ্রামবাসী ও উৎসুক জনতার ভিড়। কালিম ও রহিমুদ্দিনের হাতে হাতকড়া। চারিদিকে শোরগোল; হারামজাদা অনেক জ্বালাইছে, আমাগোরে কষ্ট দিছে কিছু কইতারি নাই— এমন নানা বাক্য শোনা যাচ্ছে। 

মাস্টার ও মৌলভী সাহেব থানা হাজতের ভেতরে। ঘটনা কীভাবে ঘটল জানতে চাইলে ওসি সাহেব বললেন, কয়েকদিন আগে আপনাদের গ্রামের দিনমজুর মজিদ এসে বলল স্যার, হাটবারের দিন একটু বাজারে আইসেন। ওইদিন একটা বাজে কিছু ঘটতে পারে। খুনাখুনিও হইতে পারে। 
আমি বললাম, কী বলো? তুমি কী করে বুঝলে খুনোখুনি হতে পারে?
মজিদ জানাল, জানি না স্যার মন কইতাছে। 

ওসি সাহেব বলতে থাকেন, আমরা অনেকটা উৎসুক হয়েই গেলাম বাজারে। অনেকদিন ওইদিকে যাওয়া হয় না। রাতে ফেরার পথে শ্মশানঘাটের কাছাকাছি এলে একটা গুলির শব্দ শোনা গেল। মুহূর্তে ফোর্সসহ সেদিকে যেতে দেখলাম মজিদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। ওরা ভাবে গুলিটা বুকে লেগেছে, ওদের কাজও হয়ে গেছে। দৌড়ে তিনজন দূরে পালিয়ে যাচ্ছিল। থামতে বললে উপরের দিকে একটা গুলি ছুঁড়ল। আমরা আবার থামতে বললেও ওরা থামছিল না। পরে আমরা বাধ্য হয়ে গুলি করি। গুলি গিয়ে লাগে একটু পেছনে থাকা একজনের গায়ে। দৌড়ে সামনে গিয়ে দেখি আপনাদের তালুকদার। মজিদকে মারার চেষ্টায় যে পিস্তল ব্যবহার হয়েছিল সেটাসহ ধরা খায় এই কালিম আর রহিমুদ্দিন। এদিকে, মজিদকে উদ্ধার করে দেখা যায় গুলি ওর হাতে লেগেছে; ও বেঁচে আছে...। 

মৌলভী ও মাস্টার, একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বলল— ‘কী আশ্চর্য ব্যাপার! মজিদকে মারতে গিয়ে নাডাটাই (তালুকদার) নিজেই লাশ হল!
— কিছু বললেন?
— না ওসি সাহেব, মজিদ এখন কোথায়?
ওসি বললেন— আমরা ওকে সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওর হাতের চিকিৎসা চলছে।

একদিন পর মাস্টার, মৌলভীসহ আরও কয়েকজন সদর হাসাপাতালে গেল। মজিদের হাত থেকে ইতোমধ্যেই গুলি বের করা হয়েছে। তবে আরও বেশ কিছুদিন চিকিৎসা নিতে হবে। তারা মজিদের সঙ্গে দেখা করল। ওকে জিজ্ঞেস করল— ‘আচ্ছা মজিদ কও তো, তুমি আসলে ক্যামনে কইতে পারতাছ যে কী ঘটবে? তুমি কি কোনো আধ্যত্মিক ক্ষমতা পাইছ?
মজিদ কোনো উত্তর দেয় না।

ইতোমধ্যে ডাক্তার সাহেব এসে কথা সব শুনে ফেলেন। তিনি রসূলপুর থেকে আসা সবাইকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলতে শুরু করলেন, আমি সব ঘটনা শুনেছি। এটা এখন পুলিশ কেইস। আপনারা ওকে জ্বালাতন না করলেই ভালো। আর আপনারা মনে মনে যেসব ভাবছেন সেসব কিছুই নয়। মজিদ আপনার-আমার মতোই আছে। তবে ইংরেজিতে একটা কথা বলে ‘প্রিমোনিশন’। কারো কারো মনের ভেতরে এমন একটা শক্তিশালী অনুভব হয় যে এই ঘটনাটা ঘটবেই। আর সেটা সাধারণত খারাপ কোনো ঘটনা। তখন আশেপাশের অনেক কিছুকে মিলিয়ে ওই ঘটনাটা ঘটবার কথা সে বলে থাকে। অনেকক্ষেত্রে ঘটনা ঘটেও যায়। মজিদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তবে এটার কোনো বৈজ্ঞানিক বা ডাক্তারি ভাষার সঠিক ব্যাখা নেই...। 

লোকজন অবিশ্বাস নিয়ে একে-অপরের দিকে তাকাতে থাকে। কেউ কেউ বির-বির করে বলেই ফেলে, ডাক্তারগের খেয়ে-দেয়ে তো কাজ নেই, সব জায়গায় একটা মনগড়া ব্যাখ্যা দিতিই হবে। যত্তসব...!

চিত্রকর্ম ● ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

 কবি, গল্পকার ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন