• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৪, ২০২১, ১০:৫০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ৪, ২০২১, ০৩:১১ পিএম

শ্রদ্ধাঞ্জলি

এবং রাবেয়া খাতুন

এবং রাবেয়া খাতুন

বছরের শুরুতেই রাবেয়া খাতুনের চলে যাওয়ার খবরটা আসতেই মনে পড়ল তাঁর উপন্যাস 'বাগানের নাম মালনিছড়া'-র কথা। তাঁর এই উপন্যাস অবলম্বনে চিত্রায়িত নাটক টিভিতে দেখেছিলাম। বহু পরে সিলেট গিয়ে দেখেছি মালনিছড়া; অনুভব করতে চেয়েছি লেখকের সৃজিত ভুবন আর বাস্তবের জায়গাজমির সাযুজ্য-বৈযুজ্য। এটা রাবেয়া খাতুনের সাফল্য বলব, কারণ লেখকের সৃষ্টির অতলতার কারণেই আমরা বিশেষ করে মনে রাখি আরকে নারায়ণের 'মালগুড়ি', নগিব নাহফুজের 'কায়রো' বা শামসুর রাহমানের 'ঢাকা'।

রাবেয়া খাতুনের কথাসাহিত্যিক ভুবনে স্থান এক সাংকেতিক নির্ণায়ক; তা সে 'রাজারবাগ শালিমারবাগ'-এর মতো স্থলভাগ হোক কিংবা 'মধুমতি'-র মতো জলভাগই হোক। উপন্যাস আর গল্পে তিনি তাঁর চেনা পরিপার্শ্ব নিয়ে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন; ল্যান্ডস্কেপ থেকে মানুষী মনোজগতের অপরিচিত পরগনায় মাঠকর্ম চালিয়ে 'কথাসাহিত্য' ফলিয়ে তোলার চেষ্টা করেননি তিনি। পঞ্চাশের প্রজন্মের তিনি সেই বিরল লেখক যিনি নারী বলে পরিবেশের 'প্রতিকূলতা'র দোহাই দিয়ে নিজের সাধনা ও সৃজনে থেমে যাওয়া বা বাড়তি সুযোগ পাওয়া-কোনোটাকেই মোক্ষ করেননি। তবে এটা দূর্ভাগ্যজনক যে, একটা বয়সে এসে তিনি  একটি বিশেষ 'প্রতাপ'-এর ঘেরাটোপে নিরুপায়ভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়েন বলে, তরুণ প্রজন্মের পাঠক-সমালোচকের প্রত্যাশিত মনোযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে মনে করি। লেখকের জন্য এটা একটা বিশাল ট্র্যাজেডি। বিশেষত, রাবেয়া খাতুনের মতো সেই লেখকের জন্য, যাকে তাঁর স্বনামধন্য স্বামী ফজলুল হকের পরিচয়ে পরিচিত হতে হয়নি কখনও। নিজের সাহিত্যিক অবস্থান তিনি নিজে নির্মাণ করেছেন। তাঁর স্মৃতিকথায়  ফিরে ফিরে এসেছে জহির রায়হান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, মির্জা আবদুল হাই বা আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা- সহযাত্রী যাদের সঙ্গে সমানতালে যিনি তারুণ্যের প্রথম প্রভাত থেকেই পত্রিকায় লিখেছেন, পত্রিকায় চাকুরি করেছেন, সাহিত্য আসরে অংশ নিয়েছেন; দুস্তর শিল্পপথে একলা চলার সাহস ও সামর্থ্য অর্জন করেছেন। 


রাবেয়া খাতুন কথাসাহিত্যের মতোই আমাদের ভ্রমণসাহিত্যের নতুন দ্বারোদঘাটক। সোয়াত থেকে আমিরাত- কোথায় না গিয়েছেন তিনি, কত অঞ্চল নিয়েই না লিখেছেন তিনি! ইউরোপ-আমেরিকা নিয়ে ভ্রমণগদ্য তো বেশুমার কিন্তু মধ্য বা দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর সফরনামা রচনায় রাবেয়া খাতুন এক পথিকৃৎ নাম। শিশুকিশোর সাহিত্যেও তিনি এক স্মরণীয় নাম।

স্মৃতি তাঁর জীবনের বড় সম্পদ কিন্তু পঁচাশি পেরিয়েও তিনি স্মৃতিভারে নুয়ে পড়া মানুষ ছিলেন না। স্মৃতিকে সত্তাসূর্যের জীয়ন্ত ডানায় রূপ দিয়েছেন। একাত্তরের নয়মাসের অসামান্য বিবরণগাথা প্রণয়নের পাশাপাশি কর্মব্যাপদেশে পাবনা মানসিক হাসপাতালকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা লিখতেও ভোলেননি। বাংলা একাডেমি নিয়ে এক স্মৃতিচারণায় একাত্তরের শহিদ কবি মেহেরুননেসাকে তিনি উদ্ভাসিত করেছেন তাঁর অক্ষরের জ্যোতিতে। 


রাবেয়া খাতুনের এন্তার উপন্যাস-গল্প চলচ্চিত্রায়িত বা নাট্যায়িত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। দু'একবার দেখাসাক্ষাৎ হওয়া বা আলাপের স্মৃতিতে কখনই এই বিষয়ে তাঁকে বিশেষ উৎসাহিত দেখিনি বরং পাঠক তাঁর মুদ্রিত বইপত্র পড়ে কিনা-এই নিয়ে কৌতূহলী ছিলেন বলে মনে হয়েছে। লেখকের বাসনা তো এমনটাই হওয়ার কথা।


রাবেয়া খাতুনকে আমাদের প্রজন্মের অনেকেই তাঁর জন্মদিনের আলোঝলমল অনুষ্ঠানে বা ফজলুল হক স্মরণসভায় মঞ্চাসীন দেখেছি, কিন্তু গত অনেক বছর কোনো  অনুষ্ঠানেই তিনি কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন না। তবে সেই নীরবতা থেকেই তাঁর ঔজ্জ্বল্য আঁচ করা যেতো। হয়তো বলতে চাইতেন, ' তোমরা শুনতে চাও আমার কথা? তাহলে কষ্ট করে অন্তত একটা বই পড়ো আমার।'

আরও পড়ুন