• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২১, ০৪:৩৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২১, ২০২১, ০৪:৪১ পিএম

জহির রায়হান: কৈফিয়তের দায়ভার

জহির রায়হান: কৈফিয়তের দায়ভার

‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো’—‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসে কবির এই ঘোষণা চলচ্চিত্রে এসে শতগুণ, হাজার গুণ, এমনকি লক্ষ লক্ষগুণে বিবর্ধিত। কবির দাবি এবং প্রত্যাশা বাস্তবে পরিণত হয়েছে বাহান্নো থেকে ঊনসত্তরে এসে। আর একাত্তরে সেটি পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। এই দুই পর্যায়ের নির্মাতা একজনই। কিন্তু পরিবর্তন ঘটেছে মাধ্যমের। ছাপার অক্ষরের লেখা এবার রূপ নিয়েছে সেলুলয়েডের ফিতায়। ঔপন্যাসিক জহির রায়হান এবার উপন্যাসের পাশাপাশি মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছেন সিনেমাকে। কেন এই মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটল, বা লিখিত রূপের চাইতে চলচ্চিত্রের রূপ বেশি শক্তিশালী কি না, বা উপন্যাস থেকে জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে পদার্পণ কোনো অগ্রযাত্রা কি না— এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।

আমরা শুধু জহির রায়হানকে অভিনন্দন জানাতে পারি সেই বিরল অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হিসাবে, যে অন্তর্দৃষ্টির কারণে একজন লেখক বা শিল্পী তার নিজ  জাতির জীবনে ঘটতে যাওয়া পরিবর্তনসমূহের আগে থেকেই আঁচ করতে পারেন। যেমনটি আমরা দেখেছি ফরাসি বিপ্লবের আগের ভলতেয়ারকে, বা রুশ বিপ্লবের আগে তুর্গেনেভকে ও তলস্তয়কে, চীন বিপ্লবের আগে লু সুনকে। কিন্তু আমাদের বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন যে কোনো একক ঘটনা নয়, বা কোনো আন্দোলনের শেষ নয় বরং শুরু, এই ভাষা আন্দোলন যে বাঙালিকে টেনে নিয়ে যাবে স্বাধীকারের সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের অভিমুখে, এমনটি উপলব্ধির ক্ষমতা সেই সময়ে বেশি মানুষের ছিল না। তার ফলেই বারবার ঘটনাপ্রবাহের সামনে আমাদের রাজনীতিবিদ-ভাবুক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়তে দেখেছি। এমনকি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা নিয়েও আমাদের দেশচালকদের ‘কোন দিকে যাই’ পরিস্থিতির কথা আমাদের স্মরণে রয়েছে। সেই ক্ষোভের চিহ্নই দলিল হিসাবে রূপায়িত হয়ে রয়েছে আহমদ ছফার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ গ্রন্থে। আহমদ ছফার সেই গ্রন্থের একটি ত্রুটি এখন বোঝা যাচ্ছে। সেখানে অন্তত ফুটনোটে ব্যতিক্রম হিসাবে জহির রায়হানের নামটি উল্লেখ করা উচিত ছিল। অন্তত ‘আরেক ফাল্গুন’ এং ‘জীবন থেকে নেয়া’ অনিবার্যভাবেই সেই উল্লেখের দাবিদার হিসাবে আমাদের সামনে উপস্থিত।

জহির রায়হানের চাইতে উঁচুদরের ঔপন্যাসিক আমাদের দেশেই রয়েছেন অন্তত বেশ কয়েকজন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাসসিদ্ধির তুলনায় জহির রায়হান নিঃসন্দেহে অকিঞ্চিৎকর। আবার চলচ্চিত্রকার হিসাবেও তিনি প্রবাদপ্রতিম ঋত্বিক-সত্যজিৎ-মৃণাল সেনদের প্রতিতুলনীয় নিশ্চয়ই নন। জহির রায়হানের গল্প-উপন্যাস নিয়ে কোনো বড় সাহিত্যিক পর্যালোচনা হয়নি। কোনো বড় লেখক তাঁর রচনা নিয়ে মনোযোগী কোনো আলোচনা করেছেন বলে মনে হয় না। তাঁর সিনেমা, বিশেষ করে, ‘জীবন থেকে নেয়া’ সম্পর্কে ঋত্বিক ঘটক কিছুটা পিঠ চাপড়ানির সুরে বলেছিলেন— ‘ও সম্বন্ধে এক কথায় বলা যায় যে তখনকার অবস্থায় এমন একটা ছবি এখানে বসে করা, এর জন্য বুকের পাটা দরকার। ছবির কনটেন্ট-এর দিক থেকে বলছি। ফর্ম বা স্ট্রাকচারাল— এ সমস্ত নিয়ে আমি আলোচনাই করছি না। তখনকার যে অবস্থা ছিল তার মধ্যে একটি ছেলে এরকম বোল্ড কাজ করতে পারে, ভাবতে পারে, সেটা অভিনন্দনযোগ্য।’[ দেখুন: ঋত্বিকমঙ্গল, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৬৮]।

আসলে পর্যালোচিত হওয়ার পর্যায়ে আসার আগেই জহির রায়হান হারিয়ে গেছেন। তাঁকে আমরা হারিয়েছি এমন এক সময়, যখন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁর মাধ্যম বেছে নিয়েছেন সুনির্দিষ্টভাবে, বুঝে গেছেন সেই মাধ্যমের কারুকার্য-সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতাও। সেইসাথে এটাও জেনে গেছেন যে কীভাবে সেই সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজতে হবে, এবং কীভাবে সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে সেই মাধ্যমটির।

জহির রায়হান উপন্যাসে সিদ্ধি অর্জনের পূর্বেই হাত বাড়ালেন সিনেমার দিকে। কেন তাঁর পথবদল, তার কোনো সুস্পষ্ট উত্তর তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। হতে পারে, তিনি সাহিত্যের মননকে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসতে চাইছিলেন চলচ্চিত্রের স্বার্থে। কারণ, আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের কলাকুশলীরা সাহিত্যের বা শিল্পের অন্য শাখাগুলি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেন। আমাদের চলচ্চিত্রের দুর্দশার কারণ হিসাবে অনেকে এই প্রবণতাকে উল্লেখ করতে ভালোবাসেন। এটি যদি একটি কারণ হয়ে থাকে, তাহলে জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে পদার্পণের আরেকটি কারণ অবশ্যই মাধ্যম হিসাবে চলচ্চিত্রের শক্তির দিকটি আঁচ করতে পারা। সংবিত্তি বা কমিউনিকেশনের দিক থেকে বিবেচনা করলে চলচ্চিত্র অবশ্যই ব্যাপকতর শক্তির অধিকারী। আমরা তো ঋত্বিক ঘটককেই বলতে শুনেছি— ‘মশাই আমি সিনেমার লোক নই। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় গল্প লিখতাম। প্রচুর গল্প লিখেছি। শনিবারের চিঠি সহ অনেক পত্রিকায় লিখেছি। কিন্তু না, যা চেয়েছিলাম তা হলো না। চেয়েছিলাম মানুষগুলোকে সচেতন করতে। বুঝতে পারলাম এর মাধ্যমে হবে না। সময় লাগবে অনেক। তাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম নাটক নিয়ে লোকগুলিকে তাৎক্ষণিক খেপিয়ে তোলার জন্যে। আইপিটিএ হলো। এর সেক্রেটারি হলাম। নাটক নিয়ে মেতে উঠলাম। কিন্তু পরে মনে হলো এর চাইতেও শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে চলচ্চিত্র। এবারে ছবি বানাতে লেগে গেলাম। আমার কথা আছে, বক্তব্য রয়েছে, তা আমাকে বলতে হবে। চলচ্চিত্র হলো মিডিয়ম অব এক্সপ্রেশন। এবং শক্তিশালী মিডিয়ম। অন্যদের মতো আমি তাই সিনেমার লোক নই মশাই। কাল যদি এর চাইতে শক্তিশালী মাধ্যম আসে, তাহলে আমি সিনেমাকে লাথি মেরে সেখানে চলে যাব।’ কিন্তু জহির রায়হানকে চলচ্চিত্র নিয়ে এমন উচ্চকিত হতে শোনা যায়নি কখনো। সম্ভবত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে চলচ্চিত্র নামক শক্তিশালী মাধ্যমটিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার জন্য যে ধরনের টেকনিক্যাল জ্ঞান এবং মেধার প্রয়োজন হয়, তা গড়ে উঠতে এই বঙ্গের মানুষের অনেকদিন সময় লাগবে। তিনি এটাও সম্ভবত পরিষ্কারভাবেই বুঝতেন যে পূর্ববঙ্গবাসীকে সিনেমার ভাষা বোঝানোর একেবারে প্রস্তুতিপর্বে রয়েছেন এদেশের নির্মাতারা। তাই তাঁকে উচ্চকিত হওয়ার বদলে কাজে নিমগ্ন অবস্থাতেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল বেশি। সেই নিষ্ঠা তাঁকে কতদূর নিয়ে যেতে পারত, তার কোনো অনুমান এখন আর সম্ভব নয়। সেই অনুমানের কষ্টকল্পনারও কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ ইতোমধ্যেই মুনাফাদুর্বৃত্তদের হাতে পড়ে আমাদের দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের যে মুমূর্ষু  দশা উপস্থিত, তা থেকে এই শিল্প ও গণমাধ্যমটিকে ফের বাঁচিয়ে তোলার কোনো পথ খোলা রয়েছে বলে মনে করে না সবচেয়ে আশাবাদী মানুষটিও। তার ফলে স্বভাবতই উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে জহির রায়হানের ভাবমূর্তিটাই।

এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে জহির রায়হানের চিন্তার গণ্ডি ছিল মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক। জহির রায়হানের উপন্যাস যেমন মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক, তাঁর চলচ্চিত্রও একই ভাবে মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক। আসলে তাঁর উদ্দেশ্যও ছিল মধ্যবিত্তের সঙ্গেই যোগাযোগ স্থাপন করা। সকল শিল্পমাধ্যম দিয়ে তিনি কমিউনিকেট করতে চাইছিলেন তৎকালীন মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেই। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পূর্বকাল থেকে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী এদেশে গড়ে উঠছিল, তারা নিজেদের ভাষা-ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে ছিল দোদুল্যমান অবস্থানে। আর কে না জানে যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রধান চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য হচ্ছে দোদুল্যমানতা। আবার একই সাথে এত পরস্পর বিপরীত বৈশিষ্ট্য ধারণ এবং বহন করতে পারে কেবল মধ্যবিত্তশ্রেণীই। একদিকে যেমন রক্ষণশীলতা, অন্যদিকে তেমনই দুর্মর কৌতূহলে প্রাচীরের আড়াল থেকে বাহিরের দিকে উঁকি দেবার প্রবণতাও ধারণ করে মধ্যবিত্ত। নিজের অবস্থান উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিটি মধ্যবিত্ত লিপ্ত থাকে প্রাণান্তকর প্রয়াসে। কিন্তু বড় ঝুঁকি নেবার সাহস না থাকায় তারা সচরাচর বেছে নেয় সরকারি প্রসাদপুষ্ট পদ ও পদবীলাভের পথ। ফলে একধরনের আনুগত্য তারা সবসময় মানসিকভাবে বহন করে ক্ষমতাসীনদের প্রতি। ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনাচারে চূড়ান্ত রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও পদ এবং পদবীর জন্য এরা করতে পারে না এমন কোনো নোংরা কাজ নেই। যেহেতু সবসময়  একে অন্যের সাথে একধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকতে হয় বলে এদের নিজেদের মধ্যে কোনো শ্রেণীগত সমন্বয় সম্ভব হয় না। বরং প্রত্যেকেই চূড়ান্তভাবে আত্মসর্বস্ব। কিন্তু আবার এই মধ্যবিত্তকেই যদি আবেগ এবং যুক্তির দিক থেকে নাড়া দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে এদের মধ্যে আবার শ্রেণীচ্যূতির হার দেখা যায় অন্য যে কোনো শ্রেণীর তুলনায় অনেক বেশি। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে যা দেখা যায়নি, তা দেখা গেছে আমাদের দেশে পাকিস্তানপর্ব থেকে গত শতকের নব্বই দশক পর্যন্ত ছাত্রদের ক্ষেত্রে। সাতচল্লিশ থেকে নব্বই পর্যন্ত এই বাঙালি ছাত্রসমাজ দেশ ও জাতির জন্য যে ভূমিকা পালন করেছে, তার তুলনা অন্য কোনো দেশ-জাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ এই ছাত্রসমাজ এসেছে হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে, অথবা মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার আশা নিয়ে। কাজেই অন্য অনেক বিপ্লবী দৃষ্টির মানুষের মতো জহির রায়হানেরও যদি মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তখন তাকে দোষারোপ করা মানে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতকে বুঝতে না পারা।

আজ যদি নিজের কৈফিয়ত দানের সুযোগ থাকত, তাহলে জহির রায়হান হয়তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই বলতেন— ‘ভদ্র পরিবারে জন্মে পেয়েছি তদনুরূপ হৃদয় আর মন, অথচ ভদ্র জীবনের কৃত্রিমতা, যান্ত্রিক ভাবপ্রবণতা ইত্যাদি অনেক কিছুর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে বিদ্রোহ মাথা তুলেছে আমারই মধ্যে। আমি নিজে ভাবপ্রবণ, অথচ ভাবপ্রবণতার নানা অভিব্যক্তিকে ন্যাকামি বলে চিনে ঘৃণা করতে আরম্ভ করেছি। ভদ্রজীবনকে ভালোবাসি, ভদ্র আপনজনদেরই আপন হতে চাই, বন্ধুত্ব করি ভদ্রঘরের ছেলেদের সঙ্গেই, এই জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নকে নিজস্ব করে রাখি, অথচ এই জীবনের সংকীর্ণতা, কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতা, প্রকাশ্য ও মুখোশ-পরা হীনতা, স্বার্থপরতা মনটাকে বিষিয়ে তুলেছে।... এই জীবন আমার আপন অথচ এই জীবন থেকেই মাঝে মাঝে পালিয়ে ছোটলোক চাষাভুষোদের মধ্যে গিয়ে যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচি। আবার ওই ছোটলোকদের অমার্জিত রিক্ত জীবনের রুক্ষ্ম কঠোর নগ্ন-বাস্তবতার চাপে অস্থির হয়ে নিজের জীবনে ফিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।’

কিন্তু আমরা যে জহির রায়হানকে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিধির বাইরে রেখে দিয়েছি, তার কারণ হিসাবে কোন কৈফিয়ত আমরা দেব স্বাধীনতার এবং তাঁর অন্তর্ধানের ৪৯ বছর পরে?