• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২১, ০৫:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৮, ২০২১, ০৫:৪০ পিএম

মুক্তগদ্য

ডিস্টোপিয়ার হাওয়ায় একাদের মনোলগ

ডিস্টোপিয়ার হাওয়ায় একাদের মনোলগ

আমি একদিন একা মানুষদের নিয়ে লিখব। কলকাতার সব একা মানুষদের নিয়ে লিখব একদিন, আমি। সত্তর দশকের একা মানুষ, আশির দশকের একা মানুষ, নব্বইয়ের দশকের একা মানুষ... আমার কাছ থেকে দেখা এ শহরের সমস্ত একা মানুষদের নিয়ে একদিন আমি লিখে ফেলব একটা লেখা। বানাব একটা ছবি। লিখব একটা গান... আমি একদিন একা মানুষদের কথা বলে ফেলব আপনাদের... যা যা এত দিন আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনেছি, তাঁদের পিছু ধাওয়া করতে করতে…

 

এই একা মানুষেরা কেউ থাকেন গড়িয়াহাট তো কেউ টালিগঞ্জ। কেউ থাকেন সাঁতরাগাছি তো কেউ সল্টলেক। কেউ থাকেন বার্লিন তো কেউ বনগাঁ। কারও খুব অভিমান, কেন তাঁদের ফোন করিনি। আবার, কারো কোনো অভিমানই নেই জাগতিক কোনো বিষয়ে। কেউ সারা দিন লাইব্রেরি-থিয়েটার-সিনেমায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন তো কেউ বাড়ি থেকেই আর বেরোন না। কেউ ছোট একটা চাকরি করে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা, তো কেউ ভাষা শেখেন পরিণত বয়সে। কেউবা নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন একদিন, ক্যারিয়ার করা হয়নি গুছিয়ে, এখন জীবন শেষ হওয়ার আগে রোজ একটা করে গাছ লাগান টবে…

 

আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি, কেন তাঁরা একা। সত্তরের অনেকেই যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাতেই জীবনটা চলে গেছে কখন। হিসাব রাখা হয়নি। একদিন পাশে তাকিয়ে দেখেছেন, কেউ নেই। ফাঁকা। একা। আবার আশির অনেকের কথায় বুঝেছি, তাঁদের ক্যারিয়ার ঠিক থাকলেও, অনেকেই ছিলেন মুখচোরা। তাঁদের ফেসবুক ছিল না। কাজেই সম্পর্ক হবে-হবে করলেও পাকেনি। বাসের পা-দানি ফসকে গেছে। হাতছুট হয়েছে ট্রেন… বিশ্বায়ন-পরবর্তী নব্বই আবার একাকিত্বর সংজ্ঞা বদলেছে… এ সময় থেকে একা মানেই কিন্তু বিষণ্ণ না। অনেক একা মানুষ দিব্য অনেক যৌন সম্পর্কে থাকতেই পারেন। এ ধারণা আগেও ছিল, কিন্তু এত প্রকট ছিল না। অন্তত সেই স্পেস সমাজে ছোট হলেও আগের থেকে বেশি তৈরি হয়েছে… কাজেই মজা করে আমরা ফুট কাটছি ছোটবেলায়, পাড়াতুতো জাহাজে চাকরি করা মান্তু কাকু তো এখন ফুল ফ্রি-ল্যান্স, কাকিমা গত মাসে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছেন…

 

আজ ফিরে তাকালে দেখি, প্রতি দু-বাড়ি অন্তর সেপারেশন আর ডিপ্রেশন আমার প্রজন্মে। বন্ধুত্ব নেই। ফাশিজম আছে। আছে দাবি-দাওয়া। ঘর থেকে বাইরে সর্বত্র। আজ আর কেউ লিটল ম্যাগাজিন করবে বলে একা কলেজ স্ট্রিটের মেসে থাকতে চায় না। দুই শ টাকা বেশি পেলেই ব্যঙ্গালুরু-বোম্বে কেটে সেল্ফি দেয়, তারা কত সুখী! কলকাতা কত খারাপ! আমাদের মেনে নিতেই হবে আজ, আন্তর্জাতিকতা আমরা হারিয়েছি। শিকড় আমরা হারিয়েছি। হারিয়েছি ইন্ডিভিজুয়াল স্পেস। চণ্ডীমণ্ডপ বানিয়েছি এ শহরকে। রাজনীতি বা অর্থের ট্র্যাপে আমরা ট্র্যাপড। আমরা নিজেদের চিনতে পারিনি। বা চিনতে ভয় পেয়েছি। পাছে, আমি জেনে যাই, আমি একা…

 

তাই হরেক ডিজিটাল অ্যাপে নিজেকে দিনমান সাজিয়ে তোলা… হোয়াটসাপে নিউ ইয়ার, শুভ বিজয়া জানিয়ে নেটওয়ার্কটা ঠিক রাখা, বর-বস-ফেসবুককে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর বানিয়ে ফেলা, ডিভোর্স বা করপোরেট চাকরি ছেড়ে দুই বছর ঘেটে থেকে নাগাড়ে ছড়ানো এবং তারপর আবার সেই এক জীবনে ফেরা, আপনি আমায় বিস্ময়ের ইমোজি পাঠালে, আপনাকে চোখ মারা সেল্ফি পাঠিয়ে দেওয়া, দিয়ে বোঝানো, আমি কিন্তু বস পলেটিক্যালি কারেক্ট আছি... কাজেই চাপ নেই… জাস্ট চাপ নেবেন না।

 

২.

ক্রমেই দেখছি ছোটদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। পরের প্রজন্ম। কেউ থিয়েটার করে তো কেউ লেখালেখি৷ দলে দলে তারা এসে ধরা দিচ্ছে। বলছে, ‘দাদা একটা লেখা দাও’, ‘দাদা, আমি তোমার যাদবপুরের জুনিয়র… সুমনকে নিয়ে একটা সংখ্যা করছি’, ‘দাদা, আমরা থিয়েটার করি, পুরোনো কলকাতা নিয়ে জানতে চাই। কার কার সঙ্গে কথা বলা যায়?’, ‘দাদা, সিনেমা বানাতে চাই…সাংবাদিকতা করতে চাই…গান তৈরি করি… কীভাবে এগোতে পারি?’ আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। চুপ করে তাদের কথা শুনি৷ তাদের মধ্যে খুঁজে পাই, দশ বছর আগে ফেলে আসা আমার একুশ বছর বয়স। রাস্তায় প্রথম প্রেমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ঝগড়া করতে করতে হেঁটে যাওয়া। হন্যে হয়ে চাকরি খোঁজা। মার খেতে খেতে খেতে খেতেও মাঝরাতে কবিতা লেখার রক্তারক্তি…

 

আমাদের আজ প্রেম নেই। ঢ্যামনামো আছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই কিছু একটা হয়ে উঠতে চেয়েছিল। তাই তারা আজ কেউ হারিয়ে গেছে বা কেউ যৌবনেই হয়ে গেছে লিজেন্ড। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। অথচ আমাদের সিগারেট খেতে খেতে কাউন্টার বদলের কথা ছিল। কথা ছিল, শীত সন্ধ্যায় দেদার মদ্যপানের পর ভেঙেচুরে দেওয়ার যা কিছু সভ্য সামাজিক বেলেল্লাপনা। আমরা কাল্ট হতে চাইনি। পেচ্ছাপ করতে চেয়েছিলাম সামাজিকতার ওপর। স্মার্ট হতে চেয়েছিলাম। কবিতা থেকে সিনেমার ফ্রেম ভাঙতে ভাঙতে আমরা হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম একদিন, কাউকে না জানিয়ে…

 

বদলে, আজ আমাদের অনেকেই ‘প্রতিষ্ঠিত’। সবাইকেই গোছাতে হবে। বয়স হয়েছে। আমার মত কেউ কেউ তাই সন্ধ্যা হলে ঠিক বুঝতে পারে না কোন দিকে হাঁটবে। একদিকে উলঙ্গ সেলিব্রিটি আর অন্যদিকে টাকা গোনা জোঁক। একদিকে মাথাকাটা সুন্দরী আর অন্যদিকে জাঙিয়া পরা স্পাইডারম্যান। অনেক বন্ধুরা অবশ্য ভালো নেই। কেউ গাঁজা খেয়ে চেতনা হারিয়েছে, কেউ বাড়ি বিক্রি বাঁচাতে মরিয়া। তারাও দেখা করে। কথা বলতে চায়। আমরা কথা বলি, কাজ ও প্রেমের সম্ভাবনা নিয়ে। তারপর আরও হতাশ লাগে। পুরোনো বই দোকান, পানশালা আর সিনেক্লাবে গিয়ে মুখ লুকোই। এখনো সেখানে কেউ কেউ ঈশ্বরের মতো দেখতে। আমাদের দিকে বাড়িয়ে দেয় বিরল ফুকো-দেরিদা-আন্তনিওনি… আমরা বেঁচে উঠি খানিক…

 

এরই মধ্যে পরের গলিগুলো থেকে বেরিয়ে আসে বাচ্চারা। কেউ লেখা চায়, কেউ চায় গান কেউ সিনেমা। তাঁদের চোখের মণি এখনো বিক্রি হয়নি। তাঁদের পাশে তাঁদের প্রেমিকারা। তাঁরা এখনো ছোট পত্রিকা করে বিশ্বাস থেকে। আমি তাঁদের হাত ছুঁয়ে সেই বিশ্বাস ভরে নিই বুকে। তাঁরা আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলে গত জন্মের রাস্তার দিকে। দেখি সেখানে এখনো গান হয়… প্রজাপতি ওড়ে… মানুষ ভালোবাসে এখনো সে রাস্তায়… চাঁদের আলোয় সেখানে ব্যাডমিন্টন খেলে মেয়েরা…আমাকে আমার পরের প্রজন্ম বলে, এখনো তোমাদের স্বপ্নগুলো শেষ হয়ে যায়নি দাদা। আমরা অত সহজে শেষ হতে দেব না। ভরসা রেখো…

 

৩.

গতকাল মৈনাক বিশ্বাসের একাকিত্ব নিয়ে কিছু কথা শুনছিলাম এক ওয়েবিনারে। সারা দুনিয়ার শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে, রাস্তা হাঁটা প্রমুখ ব্যবহারিক ক্রিয়ার সঙ্গেও, কীভাবে জড়িয়ে থাকে একাকিত্ব এবং তার সঙ্গে শিল্প, তা মৈনাকদা তাঁর ঢঙেই ব্যাখ্যা করছিলেন। বেনিয়ামিন বা বার্জারের লেখা থেকে বেলা টার হয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে জলসাঘর ছবি, গোটা বক্তব্যটা বহুদিন পর আমায় ধরে ফেলল। এ শহরেরই এক আন্তর্জাতিক স্কলার মৈনাকদা। নিজের ইন্ডিভিজুয়াল স্পেসে থাকেন। এবং সেই স্পেসই ফিরে ফিরে আসে তাঁর লেখায় ও শিল্পকাজে, আশ্চর্যভাবে। যে সময়ে সকলেই জাহির করছে, বিনয় যেখানে লুপ্ত, সে সময়েই মৈনাকদার কাজ আমাকে ইন্ডিভিজুয়াল হতে শেখাচ্ছে। এখনো।

 

আসলে, আমরা যারা সোশ্যালি ড্রপ-আউট, আট মাসের কোভিড বা ২৩-২৬ জানুয়ারির মোচ্ছবে বুঝে পাই না কোথায় যাব, যাঁদের কোনো রাজনৈতিক ব্যানার নেই, নেই সাংস্কৃতিক ফোরাম, যারা কাউন্টার কালচার আন্ডারগ্রাউন্ড এবং একক—তাঁদের বন্ধু ছাড়া তো কিছুই থাকার কথা না। নেইও। এ প্রসঙ্গে বারবার নবারুণের কথাই মনে পড়ে। নবারুণ শেষ দিন পর্যন্ত এ জায়গাটা থেকে সরতে চাননি। তারপর দেখি সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে বিজেপির রথ। সুবিশাল গেরুয়া ধোঁয়ার স্পেকট্যাকেল। বড় অসহায় লাগে তারপর…

 

আমাদের শহরের আরেক ইন্ডিভিজুয়াল শিল্পী সুমন মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি একটি নাটক অনুবাদ করেছেন তিনি। প্রকাশিত হতে চলেছে তাঁর একটি বইও। এসব লেখালেখি, বিশেষত নাটকটি ও লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে হল, আমাদের এই অন্ধকার ব্যাংক্রাপ্ট আদর্শের সময় এবং চাপ চাপ ভায়োলেন্সের কথাই। যেখানে কালচার আর বিয়েবাড়ি এক। সেখানে আমার মত একজন এককের ঢুকলেই অসুস্থ লাগে। বুঝতে পারি না, কী করব। বিকেলগুলো ঘোলাটে হয়ে আসে।

 

ঘোলাটে বিকেলে দেখা হয়ে যায় আরেক আশ্চর্য এই সময়ের ভাষ্যকার সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আমাকে অসুখ থেকে সারিয়ে তোলেন তিনি। বলেন, ব্যোদলেয়র থেকে জীবনানন্দ সকলেই তো এককের মুদ্রা। ভিড়ের মধ্যে একা হওয়ার লাবণ্য খুঁজতে শেখান তিনি। বলেন ঋত্বিক ঘটকের কথা। আমি আবার বেজে উঠি। স্যারের হাত ধরে আমি রাস্তা পার করিয়ে দিই। স্যার বলেন, আন্দ্রেঁ জিদের কথা, অনন্য রায়ের কথা। আমি আমার বেজন্মা সময়ের ব্ল্যাকহোলে তলিয়ে যেতে যেতেও ভেসে উঠি…অদূরে দেখতে পাই হাতে ‘অযান্ত্রিক’ পত্রিকা হাতে দাঁড়ানো দীপঙ্করদাকে, ‘জারি বোবাযুদ্ধ’ হাতে লালাদাকে… আমি জোর পাই, সবকিছু এখনো শেষ হয়ে যায়নি… আবিশ্বজুড়ে এখনো রয়েছেন কিছু চিন্তক, হারারি-টেরেন্স ম্যাকেনা। আমার অ্যালন মাস্ক আর স্নোডেনের কথা মনে পড়ে। বুঝতে পারি, আগামীর প্রগতি যদি কোথাও হয়, তবে তা হবে প্রযুক্তি ও শিকড়ের অ্যাডভান্সমেন্টে… মাঝারিরা আরো আরো আরো লুপ্ত হবে…ক্রমশ...বা হবে, সংরক্ষিত এলাকা…চণ্ডীমণ্ডপ…

 

হাঁটতে থাকি। একা। সন্ধ্যা নামে আমার শহরে। মনে পড়ে আমার দ্বিতীয় বইয়ের নাম ‘ভালোবাসাগুলো সেলিব্রিটি হয়ে গেছে’। পাশে হাঁটেন কবি শুভজিত গুপ্ত। আমরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে যাই, দেখি সার্দান এভিনিউ লাগোয়া পাশে একটা বাড়ি। নামফলকে লেখা, নীহাররঞ্জন রায়, ‘বাঙালির ইতিহাস’ লিখেছিলেন নীহারবাবু… আমাদের সঙ্গে আজ সন্ধ্যায় তাঁর দেখা হয়ে যায় সহসা…