• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২১, ০৬:৫৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৯, ২০২১, ০৬:৫৬ পিএম

বাংলাদেশের সাহিত্য পুরস্কার

বিতর্ক ও গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি

বিতর্ক ও গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি

বিশেষ ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কারের প্রচলন বহু আগে থেকেই। রাজা-বাদশাহরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে পুরস্কৃত করতেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও এ রীতি প্রচলিত ছিল। তখনকার কবি-শিল্পীদের বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হতো। এমনকি রাজার গলার মহামূল্যবান মালাও কবি-শিল্পীর গলায় পরিয়ে দেওয়া হতো। অনেকে ‘রাজকবি’হওয়ার সৌভাগ্যও অর্জন করেছেন।

তারই ধারাবাহিকতায় সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন পুরস্কার বা সম্মাননা চালু হয়েছে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এসব পুরস্কার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় বিভিন্ন শাখায় ভাগ করা হয়। আমার আজকের আলোচনার বিষয় যেহেতু সাহিত্য পুরস্কার; তাই আমি সাহিত্যাঙ্গনের কথাই বলবো। রাষ্ট্রীয়ভাবে সাহিত্যচর্চাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠানটি কালক্রমে বেশকিছু পুরস্কার প্রবর্তন করেছে। এর পাশাপাশি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা ব্যক্তি উদ্যোগেও কিছু পুরস্কার প্রদান করা হয়।

আমরা জানি, বাংলা একাডেমি পুরস্কার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার। যা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি ১৯৬০ সাল থেকে দিয়ে আসছে। মূলত একজন লেখকের সমগ্র সাহিত্যকর্মের ওপর ভিত্তি করেই এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকেও ‘ভাষা ও সাহিত্য’ ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য একটি শাখা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন কবি-লেখকদের সাহিত্যকর্মকে পুরস্কৃত করে থাকে। আসুন তবে একনজরেদেখে আসি বাংলাদেশে কী কী পুরস্কারের প্রচলন রয়েছে-

১. বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার

২. একুশে পদক (ভাষা ও সাহিত্য)

৩. স্বাধীনতা পুরস্কার (ভাষা ও সাহিত্য)

৪. আলাওল সাহিত্য পুরস্কার

৫. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার

৬. সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার

৭. কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার

৮. রবীন্দ্র পুরস্কার

৯. সাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ প্রবন্ধ পুরস্কার

১০. মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার

১১. কবি জসিমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার

১২. মেহের কবীর বিজ্ঞানসাহিত্য পুরস্কার

১৩. হালীমা শরফুদ্দীন বিজ্ঞান পুরস্কার

১৪. অগ্রণী ব্যাংক শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার

১৫. আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার

১৬. ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার

১৭. জেমকন সাহিত্য পুরস্কার

১৮. কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার

১৯. প্রথম আলো বর্ষসেরা বই

২০. আদমজী সাহিত্য পুরস্কার

২১. এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার

২২. সিটি ব্যাংক-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার

২৩. অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার

২৪. ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার

২৫. মুক্তধারা একুশে সাহিত্য পুরস্কার

২৬. লেখিকাসংঘ স্বর্ণপদক

২৭. অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার

২৮. লেখকশিবির পুরস্কার।

তবে এরমধ্যে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার, মুক্তধারা একুশে সাহিত্য পুরস্কার, লেখিকাসংঘ স্বর্ণপদক, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি অতীতে সাহিত্যিকদের জন্য ছিল আকাক্সিক্ষত পুরস্কার।

বলতে গেলে এসবই তাদের গতিতে বা ধারাবাহিকতায় চলছে। তারা তাদের মনোনীত গুণীজনদের পুরস্কার দিয়ে আসছেন। ফলে প্রতিবছরই এ পুরস্কার ঘোষণার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। মূলত যারা সাহিত্যচর্চা করেন; তাদের আগ্রহই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আর এ কারণেই সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার পরপরই তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যান তারা। একদল পুরস্কারের পক্ষে, অন্যদল পুরস্কারের বিপক্ষে। আর একদল কোনো পক্ষেই নেই। তাদের চিন্তা-ভাবনা হচ্ছেÑএকজন পেলেই হলো। কে পেলেন, কে পেলেন নাÑতাতে তার কী আসে যায়?

কখনো কখনো এসব আলোচনা-সমালোচনা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। ফলে অনেক সময় পুরস্কার ঘোষণা দিয়েও ফিরিয়ে নিতে হয়। এমন ঘটনাও আমাদের দেশে একাধিকবার ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে আয়োজকদেরই দায়ি করে থাকেন সাহিত্যবোদ্ধারা। তারা মনে করেন, পুরস্কার ঘোষণা দেওয়ার আগে অন্তত যাচাই-বাছাই করে দেওয়া উচিত। তাহলে আর এ ধরেনের বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না।

সব কাজেই তো মানুষ প্রশংসা চায়, স্বীকৃতি চায়, উৎসাহ চায়, অনুপ্রেরণা চায়। এ চাওয়াটা তার অধিকার। কেননা স্বীকৃতি না থাকলে কাজের প্রতি দরদ থাকে না। আর সৃজনশীল কাজে এসব বিষয় সবচেয়ে বেশি জরুরি। অথচ সেই প্রশংসা, স্বীকৃতির বদলে যদি নিন্দা জোটে; তাহলে তা ওই ব্যক্তির জন্য অবর্ণনীয় বেদনার। তাদের গ্রহণযোগ্যতা বা মূল্যায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

তবে এটাও সত্য যে, যেখানে পাড়া-মহল্লার সামান্য পুরস্কার বিতরণ নিয়ে হাতাহাতি, লাঠালাঠি হতে পারে; সেখানে এমন বড় ধরনের স্বীকৃতি বা পুরস্কার নিয়ে সমালোচনা হবেই। হওয়ারও কথা। কারণ অনেকেরই অনেক রকম প্রত্যাশা থাকে। এছাড়া আয়োজক বা পুরস্কারদাতাদের বাছাই বা নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়েও নানা রকম অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক সময় কম যোগ্যরাও বিভিন্ন পুরস্কার পেয়ে থাকেন। ফলে পুরস্কার বঞ্চিতরা বিদ্রোহ করে বসেন। বাংলা একাডেমি এখন পর্যন্ত বড় ধরনের সমালোচনার মুখোমুখি হয়নি। তবে, দলীয় প্রভাব হয়তো কিছুটা থেকে যায়। কেননা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চেতনা-আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। সেসব কথা না হয় বাদই থাকলো।

প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারের বাইরে তাকালে ভিন্ন চিত্রও দেখা যায়। কখনো কখনো টাকার বিনিময়ে পুরস্কার পাওয়ার অভিযোগও শোনা যায়। আয়োজকদের বেশিরভাগ না-কি লেখকের টাকায় পুরস্কার দিয়ে থাকেন। এমনকি স্বজনপ্রীতি বা তোষামোদ তো স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে আয়োজিত অনেক পুরস্কারের ক্ষেত্রে ‘আপনি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন’ বলে অনুষ্ঠানের ঠিক আগে আগে বলা হয়, পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আপনার আর্থিক সহযোগিতা কামনা করছি। এমনও শোনা যায় যে, বিত্তশালীরা বিভিন্ন সংগঠনকে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে নিজের নামে পুরস্কার প্রদানে প্ররোচিত করেন। অনেকে আবার এসব ক্ষেত্রে সফলও হন। তার বসার ঘরের শোপিসে সারি সারি ক্রেস্ট দেখে আপনার চোখ কপালে উঠতেই পারে। আবার বিভিন্ন প্রকাশনীর পাণ্ডুলিপি পুরস্কার লেখকদের মুরগি বানানোর হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

তাই তো যেকোনো পুরস্কার ঘোষণার পরপরই পুরস্কারপ্রাপ্তকে প্রথমেই কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিতে হয়-

১.   কোনো টাকা দিতে হয়েছে কি?

২.   পুরস্কার প্রদান কমিটিতে পরিচিত কে আছেন?

৩.   কার সুপারিশে এ পুরস্কার পেলেন?

ফলে পুরস্কার পাওয়ার পর বিড়ম্বনার যেন কমতি নেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ‘অমুকের চেয়ে আমি ভালো লেখক। আমি কেন পেলাম না’- এ জাতীয় স্ট্যাটাসে ভরে যায় কবি-লেখকদের টাইমলাইন। একেবারে নবীন লেখকও সমালোচনা করে বসেন প্রবীণ কারো পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে। দেখে মনে হবে, এটাই যেন ট্রেন্ড রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে আমি বিশ্বাস করি, পুরস্কার যিনি পাচ্ছেন; তার নিঃসন্দেহে যোগ্যতা আছে। আপনি মানুন আর না-ই মানুন। আমি বলবো, হয় তিনি লেখক হিসেবে যোগ্য। না হয় তিনি তদবীরে যোগ্য। দুটির যেকোনো একটির জোরেই হয়তো তিনি পুরস্কারটি পেয়েছেন। আপনার-আমার হয়তো এ দুটির কোনোটাই নেই। অথবা আপনি খুব ভালো লেখেন, তা হয়তো সবার জানার কথা নয়। কিংবা যারা পুরস্কার প্রদান কমিটিতে আছেন, তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। তাহলে আপনাকে ডেকে কেন পুরস্কার দিতে যাবেন? তবে যোগ্যরা পেলে সবারই ভালো লাগে। আয়োজকরাও স্বস্তি পান। কোনো সমালোচনা তাদের শুনতে হয় না। আবার একেবারেও যোগ্যরা যে পান না; তাও তো নয়। আপনার চোখে যিনি যোগ্য নন, অন্যের চোখে তো তিনি যোগ্য হতে পারেন। আপনার একার মাপকাঠিতে তো যোগ্যতা বিবেচনা করা যৌক্তিক নয়।

তাহলে কি বলবো, সমালোচনা আমাদের মজ্জাগত? না-কি পরিকল্পিত? সমালোচনা করে কি জাতে উঠতে হয়? মনে রাখতে হবে, অহেতুক সমালোচনা আপানার ব্যক্তিত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। কেননা আমাদের দেশে অনেক কবি-লেখক আছেন। সবাইকে কি পুরস্কার দেওয়া সম্ভব? বা সবাইকে কি একই সময়ে বা দিনে পুরস্কৃত করা হয়? পুরস্কার পাননি এমন অনেক কবি-লেখকও পাঠকের কাছে বহুল পরিচিত। আবার পুরস্কার পেয়েও পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারেননি- এমনও লেখক-কবি অগণিত আছেন। সব মিলিয়ে বলতে গেলে পুরস্কার একটি সম্মান। এটি না পেলেও যে আপনি অপমানিত হচ্ছেনÑতা কিন্তু নয়। তাহলে কেন এই কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি? সেই কাদা কি আমাদের শরীরেই এসে লাগে না?

আমরা চাইবো, লেখক-কবিরা সম্মানিত হোক। সেই সঙ্গে সম্মানিত হোক পুরস্কারও। সবাই মিলে সম্মানিত হলে বাংলা সাহিত্যও সম্মানিত হবে। দিনশেষে আমরা তো সাহিত্যকেই অবমূল্যায়ন করছি। তাই আয়োজক এবং পুরস্কার প্রত্যাশীদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, আপনি যার যোগ্য নন; সেটা প্রত্যাশা করে যোগ্যদের অবমূল্যায়ন করবেন না। মনে রাখতে হবে, কাউকে অবমূল্যায়ন করতে গেলে একসময় নিজেকেই অবমূল্যায়িত হতে হয়। আমাদের প্রত্যাশা হোক ইতিবাচক সমালোচনা। যা আমাদের সাহিত্যকে বহুদূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যের সম্মান দীর্ঘজীবী হোকÑএ প্রত্যাশাই রইলো।