• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১, ০৫:১৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১, ০৫:৪৭ পিএম

চলচ্চিত্রনাট্যের স্বরূপ

চলচ্চিত্রনাট্যের স্বরূপ

ভূমিকা

চলচ্চিত্র নির্মাণ ও পরিচালনার প্রাথমিক এবং নকশা (ব্লু প্রিন্ট) হচ্ছে চিত্রনাট্য বা চলচ্চিত্রনাট্য। এটি সাহিত্য প্রজাতিরই একটি শাখা বিশেষ। তবে এটি প্রযুক্তিনির্ভর প্রায়োগিক কলা।

চলচ্চিত্রনাট্য রচিত হয় নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু বা কাহিনি অবলম্বন করে। চলচ্চিত্র ভাষার মাধ্যমে এর আঙ্গিক বা কাঠামো রচিত হয়। পরে রচিত চিত্রনাট্য অনুসরণ করে প্রযোজনা, নির্মাণ, পরিচালনা, অভিনয়, শুটিং, ডাবিং, শব্দ, সংগীত ও সম্পাদনাকর্ম পরিচালিত হয়। বক্ষমান প্রবন্ধে খুব সহজভাবে চলচ্চিত্রনাট্যের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

 

সংজ্ঞা

বিভিন্ন সূত্র থেকে চিত্রনাট্য বা চলচ্চিত্রনাট্যের সংজ্ঞা পাওয়া যায়। ঈশ্বর চক্রবর্তীর মতে, ‘চলচ্চিত্র রচনা বা নির্মাণের আগে বিস্তারিত অনুপম পরিকল্পনের লিখিত রূপকে বলা হয় চিত্রনাট্য।’ সত্যজিৎ রায়ের মতে, ‘চিত্রনাট্য হলো ছবির কাঠামো। ইমেজ ও ধ্বনির দ্বারা পর্দায় যা ব্যক্ত হবে, এ হলো তার লিখিত ইঙ্গিত। এই কাঠামোকে অবলম্বন করেই চলচ্চিত্রের কলাকুশলীরা পরিচালকের নির্দেশে সমবেতভাবে কাজ করে সাবয়ব সজীব করে তোলে।’

চলচ্চিত্রনাট্য সম্পর্কে এ রকম আরো বহুজনের অভিমত রয়েছে। আসলে চিত্রনাট্য বা চলচ্চিত্রনাট্য হচ্ছে চলচ্চিত্র নির্মাণের লিখিত পান্ডুলিপি। সব দিক বিবেচনা করে চিত্রনাট্যের একটি কার্যকর সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে: চলচ্চিত্র নির্মাণ বা পরিচালনার জন্য বিষয়বস্তু বা কাহিনি অবলম্বন করে ক্যামেরার মাধ্যমে স্থান, কাল, পাত্র, আচরণ, পরিবেশ, সময়, শব্দ ও চিত্রকে ব্যঞ্জনাময় করে তোলার জন্য নির্দেশনা বা বর্ণনামূলক লিখিত বিবরণীই হচ্ছে চলচ্চিত্রনাট্য।

 

চিত্রনাট্য’ নাকি ‘চলচ্চিত্রনাট্য’

ইংরেজিতে যাকে ‘ফিল্মস্ক্রিপ্ট’ বা ‘স্ক্রিনপ্লে’ বলা হয়, বাংলায় তাকে সাধারণত চিত্রনাট্য বলা হয়। তবে কেউ কেউ ‘চলচ্চিত্রনাট্য’ এবং ‘চলচ্চিত্র লিপি’ও বলে থাকে। বাংলা ভাষায় ‘চিত্রনাট্য শব্দটি সম্ভবত ব্যবহৃত হয়ে থাকে চলচ্চিত্রের সঙ্গে নাটক বা নাট্যের একটি সম্পর্ক আছে বলে। যেমন নাটকের মতো চলচ্চিত্রেও অভিনয়, ঘটনা, চরিত্র, সংলাপ থাকে। ঈশ্বর চক্রবর্তীর মতে, ‘চিত্রনাট্য মূলত চিত্রের মধ্যে নাট্য, চিত্রের সাহায্যে নাট্য।’

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলা ভাষায় সেই নির্বাক যুগ থেকেই ‘চিত্রনাট্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশ্বাবসু রায় চৌধুরী সেই ১৩৩৬  বঙ্গাব্দে (১৯২৯) ‘চিত্রনাট্য লিখন পদ্ধতি’ শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেন  ‘চিত্রকথা’ পত্রিকায়। গজেন্দ্রকুমার মিত্র ১৩৪০ বঙ্গাব্দে (১৯৩৩) ‘বাতায়ন’ পত্রিকায় ‘চিত্রনাট্য’ শব্দটি ব্যবহার করেন ‘চিত্রনাট্য রচনা’ শিরোনামের প্রবন্ধে। সত্যজিৎ রায়ও ‘চিত্রনাট্য’ শব্দটিই ব্যবহার করেন ‘পথের পাঁচালী’সহ বিভিন্ন স্থানে। তবে ব্যতিক্রম পাওয়া যায় চিদানন্দ দাশ গুপ্তের লেখায়। তিনি ১৩৯০ বঙ্গাব্দে (১৯৮৩) ‘চলচ্চিত্রনাট্য’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। আলমগীর কবির ‘চিত্রনাট্য’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তাঁর বিভিন্ন রচনা ও চলচ্চিত্রে। তাঁর একটি গ্রন্থের শিরোনাম ‘চিত্রনাট্যত্রয়ী...’

আমি নিজেও ‘চিত্রনাট্য’ এবং ‘চলচ্চিত্রনাট্য’ শব্দ ব্যবহার করেছি দুটো গ্রন্থে। একটি ‘চিত্রনাট্যকলা’ (২০০৭) এবং অন্যটি ‘চলচ্চিত্রনাট্য তত্ত্ব ও রচনা নিদর্শন’ (২০১৩)। আমার মনে হয়, ‘চলচ্চিত্র’ যখন বিষয় তখন এর লিখিত রূপ বা কাঠামো ‘চলচ্চিত্রনাট্য’ই হওয়া উচিত। কেউ কেউ অবশ্য ‘চিত্রলিপি’ বা চিত্রনাটক’ও বলে থাকেন। যা-ই হোক, আমরা বক্ষমান প্রবন্ধে ‘চিত্রনাট্য’ এবং ‘চলচ্চিত্রনাট্য’—দুটো শব্দই ব্যবহার করব যথাস্থানে।

 

চিত্রনাট্যকারের যোগ্যতা ও গুণাবলি

চিত্রনাট্য বা চলচ্চিত্রনাট্য যিনি রচনা করেন বা লেখেন তাকেই চিত্রনাট্যকার বলা হয়। প্রতিটি চলচ্চিত্রের টাইটেল বা বিবরণীতে প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পী, কলাকুশলীদের সঙ্গে চিত্রনাট্যকারের নামও উল্লেখ থাকে। একজন সফল চিত্রনাট্যকার হতে হলে তার মধ্যে নিম্নবর্ণিত যোগ্যতা ও গুণাবলি থাকা প্রয়োজন:

১। একজন চিত্রনাট্যকারের কমপক্ষে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজন।

২। তার চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, সাহিত্য, নাটক, সংগীত, আবৃত্তি, অঙ্কন, নৃত্য, অভিনয় ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন।

৩। চলচ্চিত্রের ইতিহাস, চলচ্চিত্র বোধ, চলচ্চিত্র মাধ্যমের বিভিন্ন দিক, প্রযোজনা, নির্মাণ কৌশল, শব্দ ও সংগীতের ব্যবহার, সাজসজ্জা, সম্পাদনা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।

৪। ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল তথা চলচ্চিত্র ভাষা সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞান থাকতে হবে।

৫। ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভূগোল ও পরিবেশ আইন, মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।

৫। বিখ্যাত চিত্রনাট্যকারের রচিত চিত্রনাট্যসমূহ পাঠ এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্র অবলোকন করতে হবে।

৬। পরিমিতিবোধ থাকতে হবে।

 

চিত্রনাট্যের বিষয়বস্তু বা কাহিনি নির্বাচন

চলচ্চিত্র নির্মিত হয়ে থাকে যেকোনো বিষয়বস্তু বা কাহিনি অবলম্বন করে। চলচ্চিত্র আবিষ্কার ও বিকাশ পর্বে কোনো লিখিত চিত্রনাট্য না থাকলেও নির্মাতা বা পরিচালকরা বিষয়বস্তু নির্বাচন করে শুটিং করে চলচ্চিত্র বানাতেন।

চলচ্চিত্রের মূল উপাদান হচ্ছে বিষয়বস্তু বা কাহিনি, যাকে কেন্দ্র করে চিত্রনাট্য বা চলচ্চিত্রনাট্য রচিত হয় এবং চিত্রনাট্য অবলম্বন করে শুটিং, ডাবিং, সম্পাদনাপূর্বক একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। কাজেই বিষয়বস্তু বা কাহিনি নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। চিত্রনাট্যের জন্য যেকোনো ধরনের কাহিনি বা বিষয় নির্বাচন  করা যায়। যেমন:

১। সাহিত্য (উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাটক)।

২। ইতিহাস, যুদ্ধ।

৩। লোকগাথা, উপকথা, রূপকথা, কিংবদন্তি।

৪। ধর্মীয় পুরাণ।

৫। জীবনী

৬। স্বরচিত যেকোনো কাহিনি।

বিষয়বস্তু বা কাহিনি চিত্রনাট্যকার নিজেই নির্বাচন করতে পারেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই নির্বাচনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে পুঁজি বিনিয়োকারী সংস্থা বা ব্যক্তি (প্রযোজক)। প্রযোজক কাহিনি নির্বাচন করে অভিজ্ঞ চিত্রনাট্যকারকে দায়িত্ব দেন চিত্রনাট্য লেখার জন্য। তারই ইচ্ছে বা নির্দেশে চিত্রনাট্যের পাত্রপাত্রীর প্রেম, মিলন, বিরহ, নাচ, গান বা ঘটনায় মারপিট, ষড়যন্ত্র, খুন, রহস্য ও অন্যান্য উপাদান সংযোজিত হয়।

বড় বড় চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানে ‘স্টোরিবোর্ড’ থাকে। এই বোর্ডে থাকে চলচ্চিত্র ও অন্যান্য বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা। তারা নির্মিতব্য চলচ্চিত্র রচনা, কাহিনি ও এর মধ্যে কী কী উপাদান থাকবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেন চিত্রনাট্য লেখককে।

চলচ্চিত্রনাট্যের আঙ্গিক

একটি ভবন নির্মাণ করতে হলে যেমন প্ল্যান বা ডিজাইনের প্রয়োজন হয়, তেমনি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যও প্রয়োজন চলচ্চিত্রনাট্য বা এর পান্ডুলিপি। মানুষের শরীর যেমন অস্থিমজ্জা, মাংস, রক্ত, মাথা, চোখ, নাক, কান, হাত, পা, আঙুল চামড়া, হৃৎপিণ্ড ইত্যাদি সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে তেমনি চলচ্চিত্রের আঙ্গিক বা কাঠামো গঠিত হয়ে থাকে কাহিনি বা বিষয়বস্তু, সিকোয়েন্স, শট, সংলাপ, অভিনয় ইত্যাদির সমন্বয়ে।

সাধারণত চলচ্চিত্রনাট্যের তিনটি অংশ থাকে। যথা:

১। কাহিনি বা বিষয়বস্তুর সারাংশ (তথ্য, উপাদান, উপকরণ, ইত্যাদি)

২। সিকোরেন্স বা দৃশ্য পর্যায়ের প্রয়োগিক বিবরণী (প্রযুক্তিগত কৌশল দিক লক্ষ রেখে মূল কাহিনির বিস্তার) এবং ৩। শুটিং, স্ক্রিপ্ট বা চলচ্চিত্রে গ্রহণলিপি (শট বিভাজন দৃশ্য গ্রহণের বিস্তারিত নির্দেশ)। উল্লিখিত তিনটি অংশের বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:

১। সারাংশ: চলচ্চিত্রনাট্যের প্রথম অংশে থাকে চলচ্চিত্রের কাহিনি বা বিষয়বস্তুর সারাংশ বা সংক্ষিপ্ত বর্ণনারূপ। এতে থাকে কাহিনি বা ঘটনার সংক্ষিপ্ত আখ্যান বা বিবরণ, ভৌগোলিক অবস্থান, পাত্রপাত্রীর পরিচয় ও সম্পর্ক, আচার-আচরণ এবং বিষয়বস্তু বা কাহিনির উপসংহার।

২। সিকোয়েন্স বা দৃশ্য পর্যায়ের প্রায়োগিক বিবরণ: এতে থাকে সিকোয়েন্স, স্থান, সময়, পাত্রপাত্রী, শট নং, পাত্রপাত্রীর আচরণ, সংলাপ, আবহ বা পরিবেশ, বর্ণনা, শব্দ ও সংগীতের উল্লেখ। ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের নির্দেশ। কখনো কখনো থাকে স্কেচও।

৩। শুটিং স্ক্রিপ্ট বা চিত্রগ্রহণ লিপি: শট নম্বরসহ দৃশ্যগ্রহণের জন্যে এতে থাকে বিস্তারিত উল্লেখ। বিশেষ করে ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ থেকে কীভাবে দৃশ্যগ্রহণ করা হবে। যেমন: ক্লোজ শট মিড শট, লং শট, টপ শট ইত্যাদি বর্ণনা লেখা থাকে। সেই সঙ্গে পাত্রপাত্রীর আচরণ, সংলাপ (অ্যাকশন), পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সংগীত ও শব্দের উল্লেখ থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে শ্যুটিং স্পটে গিয়ে তাৎক্ষণিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে লিখিত বিবরণের স্থানে নতুন দৃশ্যও সংযোজন হতে পারে।

 

চলচ্চিত্রনাট্য রচনার ছক (খসড়া)

চলচ্চিত্রের নাম:

১। সিকোয়েন্স নং:

২। শট নং ও বর্ণনা:

ক. স্থান: শহর/গ্রাম/নদী/পাহাড়/রাস্তা/মাঠ/ঘাট।

খ. অবস্থান: বাড়ি/ঘর/বাগান/জঙ্গল/ দোকান/ রেস্তোরাঁ।

৩। সময়: দিন/রাত্রি/সকাল/দুপুর/ বিকেল/সন্ধ্যা/মধ্যরাত/ ভোররাত।

৪। আসবাব: চেয়ার/টেবিল/আলমারি/গাছ/হাঁড়িপাতিল।

৫। পোশাক-পরিচ্ছদ:

৬। পাত্রপাত্রী: নারী/পুরুষ/তরুণ/শিশু।

৭। পেশা:

৮। ক্যামেরার অবস্থান:

৯। দৃশ্যায়ন শুরু ( ফেডইন)

১০। দৃশ্যবস্তুর নড়াচড়া/অভিনয়।

১১। শব্দ: সংলাপ/সংগীত/আবহ সংগীত/আবহশব্দ

১২। দৃশ্যায়ন শেষ: (ফেডআউট/কাট)

১৩। স্কেচ বা ছবির মাধ্যমে লোকেশন ও পাত্রপাত্রীর অবস্থান দেখানো যেতে পারে।

 

এরপর যেকোনো চিত্রনাট্যের বই থেকে উদাহরণ দেখে নিলেই হবে। আশা করি ওপরের লেখাটি থেকে যারা নবীন, তারা উপকৃত হবেন।

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১. সত্যেন চট্টোপাধ্যায় ও সন্তু বসু, চলচ্চিত্রের চালচিত্র, কলকাতা, ২০০০

২. ধীমান দাশগুপ্ত, চিত্রনাট্য রচনা ও বিশ্লেষণ, কলকাতা, ১৯৯৩

৩. ধীমান দাশগুপ্ত, চলচ্চিত্রের অভিধান, কলকাতা, ১৯৯৪

৪. ক্ষেত্রগুপ্ত, সত্যজিতের চিত্রনাট্য কলকাতা, ২০০৫

৫. অনুপম হায়াৎ, চিত্রনাট্যকলা, ঢাকা ২০০৭

৬. অনুপম হায়াৎ, চলচ্চিত্রনাট্য তত্ত্ব ও রচনা নির্দেশন, ঢাকা ২০১৩