• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২১, ০৪:১০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৫, ২০২১, ০৪:১০ পিএম

এপারের চোখে ওপারের অর্ধশতক যাত্রা

এপারের চোখে ওপারের অর্ধশতক যাত্রা

যাত্রাপথ কম নয়। অর্ধশতকের যাত্রাপথ। একটি দেশের স্বাধীনতার। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটাই গোলমেলে। প্রাপ্তির সময়ের অনুভূতি একরকম, আর পঞ্চাশ বছর পরে তার ব্যবচ্ছেদ করতে বসলে অন্য রকম অনুভূতি হয়। ১৯৯৭ সালে ভারতে এমন হয়েছিল। কত যুক্তি-প্রতিযুক্তি উঠে এসেছিল বিভিন্ন মানুষের কলমে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ কিন্তু ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। সে অর্থে প্রথম স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পঞ্চাশ বছর তাদেরও ছিল ১৯৯৭। কিন্তু ১৯৪৭-এ পাওয়া স্বাধীনতায় বিজয় গৌরব ছিল না। যা ছিল তা ক্ষমতার হস্তান্তর ও বাঁটোয়ারা। তা বলে সেই স্বাধীনতা পেতে অবিভক্ত ভারতের মানুষ শহীদ হননি? নির্যাতন ভোগ করেননি? সবই হয়েছে। কিন্তু সে স্বাধীনতা দিয়েছে দেশভাগ। পাঞ্জাবে ও বাংলায় বাস্তু-উচ্ছেদ। জনবিনিময় সঠিকভাবে হয়েছে পাঞ্জাবে। তাই বর্তমান ভারতীয় পাঞ্জাবে মুসলমানের বাস ১.৯৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখের বাস ২ শতাংশ। কিন্তু গোলমাল হলো বাংলায়। পাঞ্জাবের জনবিনিময় সম্পন্ন হতেই হলো নেহরু-লিয়াকত চুক্তি। যার ফলে সঠিক জনবিনিময় হলো না। তাই আজ বাংলাদেশের হিন্দুদের সংখ্যা ১০ শতাংশ ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের বাস ২৭ শতাংশ। এ জন্য মাঝেমধ্যে ঠোকাঠুকি লাগে দুই বাংলায়। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের উন্নতি হয়নি এবং ওপারে সনাতন ধর্মীয়রা উৎখাত হওয়ার আতঙ্কে বাস করেন। বিশ্বের যেকোনো দেশে সংখ্যালঘুদের যে কয়েকটি সমস্যায় ভুগতে হয় তার প্রথম হলো নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করা। এই অনুভূতি পুরোপুরি বিদ্যমান দুই দেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে, কোথাও কম কোথাও বেশি, আজ ভারতের স্বাধীনতার ৭৪ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও। জিজ্ঞাসা করতেই পারেন আনন্দযজ্ঞের আবাহন ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশের মাধ্যমে শুরু করলাম কেন? কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে যে প্রত্যাশা ভারতের বাঙালিদের ছিল এবং ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের বাঙালিদের যে প্রত্যাশা ছিল, তা আজও স্বাদহীনতায় ভুগছে। তার কারণ ধর্মীয় বিভেদসঞ্জাত অবিশ্বাস।

আমার বেশ মনে আছে বাংলাদেশের বিজয়ের দিনটি। আমার বয়স তখন নয়। যশোর রোডের কাছে বাড়ি। ভিড়ে ঠাসা রাস্তা৷ ঘিঞ্জি বসতি৷ দমদম ছাড়িয়ে বারাসাত হয়ে বনগাঁ তারপর সীমান্ত পেরিয়ে বেনাপোল ছুঁয়ে যশোর৷ এপারে বাংলা, ওপারে বাংলা তখন একাকার৷ এপারে চলে আসা ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জনগণের চোখে তখন জয়ের আনন্দাশ্রু৷ আর ওপারের মাটিতে চূড়ান্ত বিজয়ের বার্তা মিশেছে পদ্মা-গঙ্গা-মেঘনার জল৷ একাত্তরের উত্তাল ডিসেম্বর৷ সময় পার হচ্ছিল যেন ঝড়ের বেগে৷ সেদিন যেন সবকিছু পাল্টে গিয়েছে৷ মুহূর্তে মুহূর্তে আসছে খবর৷ সঙ্গে প্রবল চিৎকার জয় বাংলা-জয় বাংলা৷ দমদম ছাড়িয়ে কলকাতার ইতিউতি৷ আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশিরা ‘নিজের দেশ’ ফিরে পাওয়ার আবেগে মেতে উঠেছিলেন৷ তাঁদের সেই আনন্দে ভাগ নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা৷ তাঁদের অনেকেরই চোখের কোনায় তখন বিজয়ের আনন্দ টলটল করছে৷ কারও স্মৃতিতে টাটকা খুলনা, ময়মনসিংহ, কেউ ভাবছেন ফেলে আসা যশোর, কারও মনে সিলেট,বরিশাল, কেউ চাটগাঁর কথা ভেবে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন আনন্দ উৎসবে-বিজয় পালনে৷ রক্ত নদী পার করে তারা এসেছে, বলছে আমি হারাধন, আমি ইয়াসিন, আমি মকবুল… । ৭১ সালের ভয়াবহ সংঘর্ষের সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসে কঙ্কালসার মানুষের ভয়ার্ত মিছিল দেখে কেঁদেছিলেন এপারের আপনজন৷ যশোর রোডজুড়ে চলেছিল সেই মিছিল৷ তারপর যুদ্ধের পালা৷ জলে-জঙ্গলে বেগুনখেত গোয়ালঘরের কোনা থেকে এক অসম যুদ্ধ শুরু হল৷ সুশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করা তখন পূর্ব বাংলার বাঙালি গেরিলাদের কাছে চ্যালেঞ্জ৷ মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনার সাহায্যে এসেছিল চূড়ান্ত বিজয়৷ টানা নয় মাসের সেই লড়াইয়ের ফলে মৃতদেহের স্তূপে পরিণত হওয়া পূর্ব বাংলার বাতাসে ছড়িয়েছে মৃত্যুর পচা গন্ধ৷ 

কিন্তু তারপর? মানুষ যাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির স্বীকৃতি দিয়েছে তার দিকেই তাকিয়েছিল ওপার বাংলা। বিশ্ব বহু দেখেছে, কিন্তু কারও নামে ও আহ্বানে অগণিত মানুষ প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত, এই স্তরের নেতা বেশি দেখেনি। সাধারণ্যে মেশার ক্ষমতা, মানুষের জাতি ও ভাষাগত মূল্যবোধের শিকড়ে পৌঁছে তাদের স্বাধীনতার বোধে প্রবুদ্ধ করার শক্তি সব নেতার আয়ত্তাধীন নয়। বঙ্গবন্ধুর সেই অমিত শক্তি ছিল, নাহলে স্বাধীনতার ঘোষণালগ্নেই গ্রেপ্তার-হওয়া, স্বদেশ থেকে বহু দূরে কারারুদ্ধ এক জননেতার স্বপ্ন সার্থক করতে দেশবাসীর নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রণোদনা আসত না। ইন্দিরা গান্ধীর সর্বৈব সহায়তা ও সমর্থন, বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় সেনার প্রশিক্ষণদান ও কার্যকালে সম্মুখসমর, এই সবই স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের পথে মাইলফলক। একটি জাতির মর্মমূলে স্বাধীনতাস্পৃহা বিদ্ধ করে তাকে স্বাধীন ও বিজয়ী করবার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সাধনাকে তাবৎ বাঙালি নিয়ত স্মরণ করে আজও।

যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন, তবে মুক্ত দেশে স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধরে রাখা আরও কঠিন। মনে রাখতে হবে যে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু বলতেন, স্বাধীন বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি সকলের, প্রত্যেককে রক্ষা করাই প্রত্যেকের ধর্ম। তাঁর স্বপ্ন ছিল, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় আন্দোলন যে জাতির মজ্জায়, তার স্বাধীন সত্তা প্রোথিত থাকবে ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। সদ্য স্বাধীন দেশের জাতীয়তাবাদ-বিহ্বল থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ—তা হলো দেশের সংবিধানে ‘বাঙালি’ শব্দটি হয়ে উঠেছিল ধর্মোর্ধ্ব জাতীয়তাবাদের প্রতিশব্দ। সমাজে সকল ধর্ম- সম্প্রদায়ের অভ্যাস ও আচরণ থাকবে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, দেশকে একসূত্রে বাঁধবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি-আশ্রয়ী উদার বাঙালিত্ব। উদ্বেগের বিষয়, এই অসাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশে গত অর্ধশতকে কমবার লঙ্ঘিত হয়নি। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু-হত্যা তারই প্রমাণ, সেনাশাসনে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি মুছে ফেলা হয়েছিল। ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনে শব্দটি ফিরে এসেছে। কিন্তু দেশে সাম্প্রদায়িকতার ছড়িটি ঘুরাবার চেষ্টা এখনো অব্যাহত। মৌলবাদ যে সমাজ ও রাজনীতির পরিসরে রীতিমতো সক্রিয়, তার প্রমাণ সাম্প্রতিককালে একটি কট্টর গোষ্ঠীর দেশজুড়ে সমস্ত মূর্তি ও ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী বলে ভেনগে ফেলার নিদান। তিন বছর আগে ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ‘লেডি জাস্টিস’-এর মূর্তি সরাতে কট্টরপন্থীদের আন্দোলন হয়েছিল, সেই মূর্তি সরানোও হলো। ২০০৮ সালে ঢাকা বিমানবন্দর প্রাঙ্গণ থেকে লালন শাহের মূর্তিও তৎকালীন সরকার সরিয়ে দেয়। ‘মুজিব বর্ষে’ খোদ দেশের স্বাধীনতার রূপকারের মূর্তি ভাঙা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্নভঙ্গ কি না, তা ভাববার সময় এসেছে। 
বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচুর সাফল্যের অধিকারী। সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা থেকে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ, মাথাপিছু জাতীয় আয়ে ভারতকেও অতিক্রম করার সম্ভাবনা—বাংলাদেশের মুকুটে গৌরবপালক কম এনে দেননি। বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙবার স্পর্ধিত দুষ্কৃতির আবহেই নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতুর ইস্পাত-নির্মিত সব স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে, সেতু সম্পূর্ণ । এই প্রকল্পের বাস্তবায়নেও বিস্তর বাধা এসেছিল, এমনকি বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও আর্থিক দুর্নীতির দিকে ইঙ্গিত করে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিরূপ ছিল। শেখ হাসিনার সরকার ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ গড়েছে নিজ সামর্থ্যে। বাঙালির আত্মসম্পদ ও বিশ্বাসের এই সদ্ব্যবহার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, বললে ভুল হবে না।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির দলের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিশেষত বাংলাদেশের অনেক নেটিজেনদের তরফে। মোদিবিরোধীরাও বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা নিয়ে একই প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু সংবিধান-স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা যে নিঃশর্তভাবে এ দেশে রক্ষিত হচ্ছে, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। আপত্তি উঠছে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি নিয়ে। নির্বাচনী বাগাড়ম্বর নিয়ে উঠছে গেল-গেল রব। এমনকি কবীর সুমন রাজনৈতিক প্রণোদনায় বাংলাদেশের বাঙালির কাছে একই আপত্তি তুলে মোদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আবেদন রেখেছেন যদিও তিনি কিছুদিন আগে আর কখনো বাংলাদেশে যাবেন না বলেছিলেন সেখানকার মানুষদের দুর্ব্যবহারকারী আখ্যা দিয়ে।

কিন্তু বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে সুবর্ণজয়ন্তীর সূচনালগ্ন যাতে সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সহর্ষে উদযাপিত হয় কোনো প্রণোদনা ও তিক্ততা ছাড়া এবং সংখ্যালঘুরা নিজেদের এই যাত্রা থেকে নিজেদের সরিয়ে না রেখে এক রাস্তায় শামিল হয়, সেটাই দেখার প্রত্যাশায় আছে এপার বাংলা।

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ।