• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১০, ২০২১, ০২:৪২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১০, ২০২১, ০২:৪২ পিএম

মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ

সামাজিক সমস্যার ডায়াগনস্টিক সেন্টার

সামাজিক সমস্যার ডায়াগনস্টিক সেন্টার

The earliest political groups in south Asia can be characterised more as interest groups than as a political party. দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি প্রসঙ্গে এ বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই। রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে দলীয় কর্মীদের ব্যক্তিস্বার্থ এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিংবা একদল মানুষ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করবার নিমিত্তেই এখানে রাজনীতিতে প্রবেশ করে। পরিণতিও আমাদের কারও অজানা নয়। আমরা সবাই দেখি, কিন্তু দেখি না; শুনি কিন্তু অনুভূত হয় না, বলি কিন্তু অনুভব করতে পারি না। এমন একটা অস্থিতিশীল অবস্থাতে সাহিত্যও তেমন একটা বাঁক নেবে, সেটাই স্বাভাবিক। বিগত কয়েক দশকে তাই গল্পের প্যাটার্ন বা বলনভঙ্গি, আঙ্গিক বা কাহিনিতে, উপস্থাপনায় এসেছে নানা পরিবর্তন। সমাজ-রাজনীতি-ধর্ম-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি নিয়ে নানাভাবে গল্প লেখা হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের সঙ্গে মোজাফ্ফর হোসেনের মূল পার্থক্য হচ্ছে তাদের গল্পের মধ্যে সমাজ থাকে, প্রোথিত হয় কোনো অন্যায়, অনুপ্রবেশ ঘটে শোষণের-অত্যাচারের। আর মোজাফ্ফর হোসেনের থিমটাই সমাজ-রাজনীতি-বর্তমান; এগুলোকে আনার জন্যই তিনি গল্প ফাঁদেন, শৈল্পিক ইমেজের আত্তীকরণ করেন। মোজাফ্ফরের গল্পের ভেতরে সমাজ আসে না, সমাজের জন্য গল্প আসে, অন্তত গল্প পড়ে তাই মনে হয়।  যদিও লেখক নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘I don’t have any social commitment.’ কিন্তু পাঠক ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ গল্পগ্রন্থের একটি গল্পও যদি পড়েন নির্দ্বিধায় খুঁজে পাবেন সমাজকে মর্মমূলে রাখা লেখককে।

গল্পগুলো পড়ে নিজেকে কিছুক্ষণ উলঙ্গ, বিভ্রান্ত, অদ্ভুত মনে হবে। আশপাশের মাথাবিহীন মানুষগুলোকে অসহ্য মনে হলেও কিছু করার থাকবে না। পরাবাস্তব বা জাদুবাস্তবতার ব্যবহার করে অস্বাভাবিক জগতের যে স্বাভাবিক গল্প লেখক বলে গেছেন, তা পাঠকের কাছে অস্বস্তিকর মনে হলেও পরিবেশনার গুণে অবাস্তব মনে হবে না। গল্পগুলো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে গল্পকার এই যে ম্যাজিক রিয়ালিজমের মতো একটা বিষয়কে গ্রহণ করেছেন, তাতে শহীদুল জহিরের কথা প্রসঙ্গতই মনে হয়ে যায় : ‘জাদুবাস্তবতার ব্যাপারটা তো আমি মার্কেসের কাছ থেকে পেয়েছি। এবং এটা আমি গ্রহণ করেছি দুটো কারণে। প্রথমত, চিন্তার বা কল্পনার গ্রহণযোগ্যতার যে পরিধি, সেটা অনেক বিস্তৃত হতে পারে বলে আমি মনে করি। দ্বিতীয়ত, আসলে বর্ণনায় টাইমফ্রেমটাকে ভাঙতে চাচ্ছিলাম।’মোজাফ্ফর হোসেন প্রথমোক্ত ‘চিন্তার বা কল্পনার গ্রহণযোগ্যতার পরিধি বিস্তৃতির জন্যই যে এই কুহকের আশ্রয় নিয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নতুবা এভাবে মাথাহীন মানুষ অথচ বিশ্বাসযোগ্য চলাফেরা সম্ভব হতো না অবশ্যই। বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত না হয়েও এক আবাস্তব সমাজের গল্প বলে গেছেন নির্দ্বিধায়। জাদুবাস্তবতার আড়ালে বাস্তবেরই পুনর্নির্মাণ করেছেন। শুধু নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হননি, একেবারে চামড়া ছিলে লবণ লাগিয়ে শুকোতে দিয়েছেন। ফর্মের ব্যাপারে মোজাফ্ফর বলছেন, ‘আরও অনেক লেখকের মতো সচেতনভাবেই আমি গল্পের প্রচলিত নির্মিতি ভেঙে ফেলতে চেয়েছি। আমার গল্পগুলোকে জাদুবাস্তব-পরাবাস্তব-উত্তরাধুনিক যে যেভাবেই বুঝতে চেষ্টা করুক না কেন, আর পাঁচটা গল্পের মতোই গল্পমাত্র।’ লেখক যখন লেখেন তাতে নির্দিষ্ট করে কোনো ফর্ম আরোপিত করলে লেখার স্বতঃস্ফূর্ততা কমে যায়, মোজাফ্ফরের লেখা এ দায় থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত। লেখাকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন, ফর্মকে নয়। ঠিক স্যাটায়ার, একজাক্ট আয়রনি বা পারফেক্ট হিউমার বা উইট হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যা তিনি বলতে চেয়েছেন, দেখাতে চেয়েছেন, স্বচ্ছ আয়নার মতো স্পষ্টভাবে তা চিত্রিত করতে পেরেছেন। ব্যাকরণ যেমন আগে তৈরি হয় না, আগে আসে ভাষা। তারপর ভাষার ওপর ভর করে একটা আকার দেওয়া হয় ব্যাকরণের। তেমন লেখক একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে বা ইজমে লেখেন না, বরং লেখার পর প্যাটার্ন বা ইজম তৈরি হয়। এ ব্যাপারে মোজাফ্ফর দারুণভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। এ ক্ষেত্রে মোজাফ্ফরের সুদর্শনচক্র ডার্ক ফ্যান্টাসির সঙ্গে স্যাটায়ার আর আয়রনির আশ্চর্য কম্বিনেশন। বাংলা সাহিত্যে আবুল মনসুর আহমদের মধ্যে আয়রনি আর স্যাটায়ারের একটা বুদ্ধিদীপ্ত চমক ছিল। মোজাফ্ফর তা-ও যেন ভেঙে দিলেন। একই সঙ্গে রূপক, স্যাটায়ার ও আয়রনির ভিন্নরূপের ব্যবহারে গদ্যকে একটা আশ্চর্য শানিত রূপ দিয়েছেন। অনেকটা ডার্ক কমেডির মতো। অনেকগুলো উপকরণ মিশিয়ে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গদ্য তার প্রাণ হারায়, এক জটিল যৌগে পরিণত হয়ে তা অনেকাংশেই দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু গল্পকার তাঁর পরিমিতিবোধ, সংযত ও নৈর্ব্যক্তিকতার গুণে এই গ্রন্থে অনেকগুলো উপকরণ মিশিয়ে দারুণ এক ককটেল তৈরি করেছেন, যা তাঁর গদ্যকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছে। লেখক নিজেই বলছেন, ‘আমি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো রীতি অনুসরণ করি না। গল্প অনুযায়ী ভাষার প্রবাহকে আসতে দিই। অনেক সময় ভাষা নিজেই গল্পের কাঠামো হয়ে ওঠে।’ ফলে গল্পকার যে কাহিনির প্রয়োজনে বা পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই এই মিশ্র উপকরণ ব্যবহার করেছেন, এ কথা সত্য। সমাজের অসংগতিগুলোকে এমন ককটেলের বিস্ফোরণ ছাড়া প্রকাশ সম্ভবপর ছিল না হয়তো। 

তরুণ গল্পকারদের মধ্যে তাঁকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা করা যায় তাঁর চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মোজাফ্ফরের গল্প যারা পড়েন তারা ভালোভাবেই জানেন গল্পকারের মর্মে গাঁথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তা তিনি সচেতনভাবে করেন, নাকি সম্পূর্ণতই অবচেতনের কাছে ধরা দেন জানা যায় না। তবে তার কথাসাহিত্যের বৃক্ষের মূল প্রোথিত আছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ বা তৎপরবর্তী বাংলাদেশের তুলনামূলক আলোচনা মোজাফ্ফরের কলমে বারবার উঠে এসেছে। যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মহান স্বাধীনতা এনেছিল, উত্তর-প্রজন্ম আর উল্টো পিঠে চলা বর্তমান অবস্থান নিয়ে লেখকের যে ক্ষোভ তা ঘুরেফিরে বিভিন্ন ইঙ্গিতময়তায় ফিরে আসে তাঁর গল্পে-উপন্যাসে। প্রথম গল্প ‘একটি খুনের স্বীকারোক্তি’-তে বিচারহীনতার, জোর করে নিদোর্ষ ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করার, ক্ষমতার অপব্যবহার বা স্বাধীনতাবিরোধী অশক্তির পুনরুত্থানের বিষয়টি লেখক আয়রনির মাধ্যমে যথোপযুক্ত চিত্রায়ণ করেছেন। খগেনের মাধ্যমে লেখক কি কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন? সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি আত্মসাৎ, অত্যাচার, শোষণ, লুটপাট স্বাধীন দেশেও আমরা ঠেকাতে পারিনি। ‘ধর্মের ওপর আঘাত’ একটি বাক্যের দ্বারা যেন বৈধ করে নেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘুদের ওপর হওয়া সব অত্যাচার। গল্পগুলো পড়ে কোথায় যেন বনফুলের কথা মনে হয়ে যায়। সম্ভবত গল্পের শেষ চমকে আর ইঙ্গিময়তায়। বলাইচাঁদের গল্পে যেমন শেষে একটা চমকপ্রদতা থাকে, তেমন চমক ছিল প্রায় প্রতিটা গল্পের শেষেই। যেমন পুরো গল্পে যাকে খুনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে, বিশেষ করে এমন একটা খুনের, যেখানে বঁটি দিয়ে গলা কেটে খুন করা হয়েছে, সেখানে গল্প শেষে দেখা গেল আটককৃত খগেনের হাতই নেই কনুই পর্যন্ত! বনফুলের মতোই অপ্রত্যাশিত কশাঘাত করতে লেখক পারঙ্গম। দন্ত মাজুনি বিক্রেতা ক্যানভ্যাসারের গালে পড়া থাপ্পড়ে নকল দাঁত খুলে আসার মতোই খুনের আসামির কনুইহীনতা আমাদের চেতনায় জোরে কশাঘাত করে। বিচারহীনতার দেশে যখন তারা মিয়া, বাদলদের মতো নির্দোষ মানুষ দোষী না হয়েও সাজা খাটে, তখন খগেন চরিত্র তৈরি হওয়া তো স্বাভাবিক। এখানেই গল্পটি শেষ হতে পারত, কিন্তু মোজাফ্ফর তা হতে দেবেন কেন? কয়েক লাইনের মেদহীন বর্ণনায় উঠিয়ে নিয়ে এলেন মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল ক্যানভাসের বিষয়কেও। স্বাধীনতাবিরোধীদের ফিরে আসা, স্বাধীন মাটিতেই তাদের দাপিয়ে বেড়ানো তুলে নিয়ে এলেন অবলীলায় :
“লক আপে নেওয়ার সময় কনস্টেবল একবার জিজ্ঞেস করে, ‘হাত কাটছে কেমনে? চুরি-ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা খাইছিলা নাকি?’
খগেন কোনো উত্তর করে না। একবার মনে হল বলে, যুদ্ধে খগেনের হাত দুটো কেটে নিয়েছিল পাকিস্তানে সৈন্যরা। চেয়ারম্যান তখন যুবক, শক্ত করে খগেনের পা দুটো বেঁধে দিয়েছিল। বলতে গিয়ে মনে হল, সাজা যা হওয়ার তা তো হবেই!” 

‘স্পাই’ গল্পটিতেও ‘একটি খুনের স্বীকারোক্তি’র মতো একটা টানটান উত্তেজনা প্রথম থেকেই ছিল। একটা থ্রিলার, অ্যাডভেঞ্জারের ছোঁয়া আছে। কে এই লোকটি স্পাই না অন্য কিছু? পুরো গল্পে নানান কথার মাধ্যমে আমাদের অতীত-বর্তমান, সমাজ, মানসিকতা সব তুলে এনে শেষমেশ একেবারে বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিলেন। মোজাফ্ফরের এই এক প্যার্টান। থ্রিলিং একটা পরিবেশ তৈরি করে অল্প কথায় একেবারে টু দ্য পয়েন্টে আঘাত হানা। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর দেশের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি খুব পরিমিতভাবে শেষে বলে দিলেন :
“বউ আর মেয়িকে ঘরের মধ্যে আটকি রেখে পুড়ি মারলু পাকিস্তানিরা। দেশ স্বাধীন হলি একা মানুষটাকে পাগল বানি’ দেশছাড়া করলি তুমরা। একুন আবার স্পাই বুলি পুলিশের হাতে তুলি দিচ্ছ, আর কত অবিচার করবা মানুষটার উপর?”   

‘বঙ্গবন্ধুকে চিঠি’ গল্পটিও এই ধারার গল্প। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মুক্তিযোদ্ধারাই শুধু ফিরে আসেনি, সঙ্গে প্রবেশ করেছিল স্বাধীনতাবিরোধিরাও। তারা তাদের পরাজয়ের, অপমানের, মস্তিষ্কের কলুষতা নতুন করে ছড়াতে শুরু করেছিল এবং আমাদের উল্টো পথে হাঁটা তো সেদিনই শুরু হয়েছিল যেদিন ‘চাচা কাগজের ডান দিকে উপরে বড় বড় করে লেখেন : ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫!’ 

‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ নামক নাম গল্পটি ডার্ক ফ্যান্টাসির উৎকৃষ্ট উদাহরণ বা বীভৎস রসও বলা যায়। বা ঠিক কোনো ফর্মেই ফেলা যায় না, কিন্তু এই গ্রন্থের মাস্টারপিস। রাজশেখর বসুর মতো বা বলা যেতে পারে মার্কেসের মতো পরিবেশ তৈরিতে ডিটেইলিংয়ের ব্যবহার গল্পটিতে অনন্যতা এনেছে। পুরো পরিবেশ বর্ণনা করে প্রচ্ছন্ন উইটের ছোঁয়ায় একসঙ্গে কত তির যে ছুড়লেন :
“আমরা ‘মিট হিউম্যান মিট’-এ এলাম। হোটেলের মালিক একজন সাবেক মন্ত্রী। দেয়ালে বড় করে তার ছবি টাঙানো। ছবিটার নিচে টেবিলে আমরা বসেছি। এদিকে আলো ও মানুষের চাপ, দুটোই কম। গল্প করতে করতে সময় নিয়ে খাওয়া যাবে। মানুষের মাংস দ্রুত খেলে নাকি স্বাদ পাওয়া যায় না। মুখের ভেতর অনেকক্ষণ রেখে গিলতে হয়।”

এই গল্পে লেখক শুধু সময়, দেশ-জাতিতে থেমে থাকেননি, বরং তিনি হয়ে উঠেছেন আপাদমস্তক এক বিশ্বনাগরিক। তার স্যাটায়ারের হাত থেকে রেহাই পায়নি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ বা দায় এড়ানো মধ্যবিত্তরাও। যে লেখকের আগাগোড়া স্বপ্ন বিশ্বমানবের পথে শাশ্বত মানবের মিলনে, তাঁর গল্পে যে বৈশ্বিক হাহাকার উঠে আসবে, তাই স্বাভাবিক। পাঠক সেখানে দ্রুতই খুঁজে পাবেন রোহিঙ্গা আর বাঙালির মিশ্রণ অপ্রত্যাশিতভাবে কীভাবে লীন হয়ে যাচ্ছে, সিরিয়ার মানব পাচার, সৌদি-আমেরিকার রাজনৈতিক আগ্রাসন। জাতিসংঘের হাস্যকর নীরবতা বা পাপেট খেলা তাই গল্পে চোখ পাকিয়ে তাড়া করবে পাঠককে।  না চাইলেও ফিলিস্তিনি শিশুদের মাংসের আচারের তিক্ততা পাঠককে নিতে হবে। মোজাফফর জানেন তাঁর পাঠক কারা, তাই গল্পের শেষটাও করলেন বুদ্ধিদীপ্ত স্যাটায়ার, অ্যালিগরি, অ্যালিউশানের মাধ্যমে :
“চোখে পড়ে এক ভদ্রলোকের হাতে একটা ফাইলে লেখা, হিউম্যান রাইটস ইন স্লামস। মিট হিউম্যান মিট রেস্তোরাঁয় এভাবেই নাকি রোজ রোজ সমাজ বদলের তর্কে বসে বিত্তবান মানুষেরা, প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিয়ে মিটিং করে দেশি-বিদেশি সংগঠনগুলো। বিল দেওয়ার সময় ম্যানেজার হাসতে হাসতে আমাদের বলে, আবার আসবেন, স্যার! আমাদের মানুষের মাংসে কোন ভেজাল নেই।”

এই ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ আসলে কী? লেখকের স্বাপ্নিক জগৎকে যেমন ইউটোপিয়া বলা হয়, এই রেস্তোরাঁ একেবারেই তার বিপরীতার্থক। এটি লেখকের ইউটোপিয়ার জগতের বিপরীত জগৎ, যা চেয়েছিলেন আর যা পেয়েছেন, সে চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান। নিরোট কদর্য বাস্তবতা। এ ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ আমার সমসাময়িক মাতৃভূমি। যেখানে প্রকাশ্যেই শিশুদের মৃতদেহের সারি, চাহিদা যেখানে মেয়েদের কচি শরীরের। কিংবা রমরমা যেখানে মাথাহীন মানুষের চলাফেরা! এই মাথাহীন মানুষের চলাফেরা কি আমাদের একটুও অস্বাভাবিক লাগে? লাগে না। কারণ ব্যাপারটি আপাতপক্ষে অসম্ভব হলেও তা সত্য। এই মাথাহীন মানুষগুলোর চলাফেরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কথাই তো বলে। এখানে অবলীলায় তাই খুন হওয়া ব্যক্তিরা উঠে আসছে। সাংবাদিক বা চিকিৎসাহীনতায় মারা যাওয়া ব্যক্তি কেউ স্বীকার করছে না তারা মারা গেছে। কারণ, কোনো মিডিয়া তাদের কাভারেজ দিচ্ছে না, কোনো উপাদেয় কারণ ছাড়া কেউ মৃত্যুও গণনা করছে না, যেন এভাবেই মরে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। 

অন্যদিকে বিচারহীনতার চূড়ান্ত দ্বারে পৌঁছে ধর্ষণের নিউজ কেটে কেটে জমা করে উল্লাস করছে মহসিন দম্পতি! হরিণের মাংসের কারবার থেকে যে দম্পতি শুরু করছে আরও বড় অপরাধ, খাওয়া শুরু করেছে মানুষের মাংসও। হরিণের মাংস থেকে নতুন ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন পিৎজা বয় মিসিং! কিংবা আরেক দল এখানে মাথায় বসাচ্ছে স্বাধীনতার নামে চিন্তাকে কন্ট্রোল করার চিপ, যেন কেউ আর প্রতিবাদ করতেই না পারে, ভাবতেই না পারে। আবার দেশটির নাম রেখেছেন শ্লেষ করে ফ্রিল্যান্ড! পুনরুত্থান ঘটছে রহমানদের। তারা মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেখানেও একদল ব্যবসা করছে, ধর্ম ব্যবসায়ীরা ঢুকে যাচ্ছে সর্বত্র, ইস্যুকে অবলম্বন বানিয়ে কীভাবে ফায়দা লোটা হয়, তার নানা দিক উন্মোচিত হচ্ছে। এদিকে নিরাপত্তাহীনতায় কেউ মেন্টাল হয়ে যাচ্ছে, বেকার জীবনের বেদনাও উঠে আসার সুযোগ পাচ্ছে না বাজারে কাটতি না থাকায়, সাহিত্য জগতেও কলুষতা, চুরি, বাজারিভাব, অন্যের আবেগ, হতাশাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা, মৃত্যুর পর কাউকে হিরো বানিয়ে দেওয়া সব চলছে নির্দ্বিধায়। এদিকে পুনরায় খরগোশ-কচ্ছপরা প্রতিযোগিতায় নেমে গেছে, আর সিসিফাস শেষ পর্যন্ত হাসছে ঈশ্বরের হাসি। আবার বিড়াল পোস্টমর্টেমে ‘নিমগাছের’ মতো অ্যালিগরির ব্যবহারে সমাজকে কি কশাঘাতটাই না দিলেন মোজাফ্ফর। বিড়ালের সঙ্গে অভেদরূপী বিলুর মা আসলে কে? সাধারণ জনগণ নয়তো? যে তিলে তিলে সয়ে গিয়েছে। এককথায় জাদুবাস্তবতার অসাধারণ প্রয়োগ দেখিয়েছেন গল্পকার। আগে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে তারপর কার্যকরণসূত্রে বাস্তবের সঙ্গে অভেদরূপে একবিন্দুতে মিলিয়ে দেওয়া। ফলে এখানে অবলীলায় মাথাহীন মানুষের ঘুরে বেড়ানো কোনো অস্বাভাবিকতা তৈরি করে না। সামনেই হয়ে যাওয়া হত্যা-লুণ্ঠন, ধর্ষণ আমাদের এতটুকু বিচলিত করে না। মাথা নেই বলেই তো আমরা এতটুকু প্রতিবাদ করি না। 
“মাথা না থাকলে মানুষের চিৎকার দেওয়ার, দ্রোহ প্রকাশ করার ভাষা থাকে না।...সম্মুখে কিংবা পেছনে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী অথবা শিশু। ছেলেশিশু কিংবা মেয়েশিশু। কেউ দেখে না, কেউ শোনে না। কোনো দিক থেকে প্রতিবাদ আসে না।...তাদের যেহেতু মাথা নেই, পৃথিবীর কোন কিছুতেই আর মাথাব্যথা হওয়ার দায় থাকে না।”
‘শেষ মাথাটি কাটা পড়ার আগে’ গল্প পড়তে পড়তে মাথাসহ আমার মনেও তখন ভয় জাগ্রত হয়, আমার নিজের মাথাটির জন্য নয়, লেখকের মাথাটির জন্য। এই মাথাবিহীন দেশে থাকার দায়ে শেষে না গল্পকারের মাথাটি কাটা যায়, অফিশিয়ালি অথবা আন অফিশিয়ালি!

আয়রনির ধর্মই হচ্ছে বর্ণনার বাহ্যিক অর্থ আর লেখকের উদ্দিষ্ট অর্থের মধ্যে ফারাক। the satirist is nearly always a man who is abnormally sensitive to the gap between what might be and what is. একজন ব্যঙ্গকার মানুষকে তার জীবনের কুৎসিত দিকগুলো ও অন্তরালের ঘটনাবলি দেখাত চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন রাজনীতি ও সমাজের নানা ব্যক্তির মত ও পথ পাল্টাতে। মোটকথা মানুষের অসংগতি, মুখোশের আড়ালের মুখ ধরিয়ে দেওয়ার একটা মাধ্যম হচ্ছে আয়রনি। who is a man who takes it upon himself to correct and redicule the follies and voices of society and thus to bring contempt and derision upon aberrations from a desirable and civilized form. 

এ বইয়ের প্রতিটি গল্পে প্রয়োজন বুঝে আয়রনির সব কয়টি প্রকারভেদ সিচুয়েশনাল, ভার্বাল বা স্ট্রাকচারাল আয়রনির ব্যবহার করা হয়েছে। পরিবেশ বুঝে তার মাত্রা করা হয়েছে মৃদু, প্রচ্ছন্ন বা প্রকট। অ্যালিগরি বা অ্যালিউশনের ব্যবহার কীভাবে করলে আপনার সম্পর্কে বললেও আপনি বিন্দুমাত্রটি বুঝতে পারবেন না, বুঝলেও  রা পর্যন্ত করতে পারবেন না, তা মোজাফ্ফর হোসেনের কাছে শিক্ষণীয়। মোজাফ্ফর হোসেন কখনো সরাসরি পরিণতির কথা বলেন না আবার বলেনও। আসলে বলেন, কিন্তু নির্দিষ্টকরণ করেন না যে এটিই শতভাগ সত্য। ফোর গ্রাউন্ড বা অগ্রভূমির এই ব্যবহারে গল্পকার অসাধারণ নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন, এ কথা স্বীকার করতেই হবে। সরাসরি পরিণতির কথা না বলে একটা ইঙ্গিত থাকে, পাঠককে সে সাংকেতিক ধাঁধা ভেঙে নিতে হয়। যেমন তিনি ‘যে জীবন ফুটবলের’ গল্পের শেষে বললেন না যে বৃদ্ধা দাদির মাথাটার ফুটবলে পরিণত হওয়ার কথা, কিন্তু ইঙ্গিত তো তিনি দিয়েছেন। ঠিক তেমনি অ্যালিগরির মাধ্যমে বলে গেলেন একই সঙ্গে জনমানুষের ফুটবল হওয়ার গল্প। রাজনৈতিক নেতাদের পায়ে উদ্দেশ্য থাক আর না থাক, হার-জিত থাক আর না থাক, শুধু সময় যাপন বা সাময়িক উল্লাসের কারণেও সাধারণ মানুষের মাথা ফুটবল হয়েছে। এখানে বোবা-কালাজনই বা কে? কোন দল, কোন পক্ষ? হত্যা, লুণ্ঠন, গুম, ধর্ষণ, দল পরিবর্তন বা পাশবিক উল্লাস এক ফ্রেমে এর চেয়ে গোছানো হতে পারত না হয়তো।

গল্পগুলোতে পাঠক নিরবচ্ছিন্ন থ্রিলারের স্বাদও পাবেন। টান টান একটা উত্তেজনা আছে গল্পগুলোতে, যা পাঠককে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত। কোনো গল্পই পাঠক শেষ না করে পরে পড়ব বলে উঠে যেতে পারবেন না। শুধু থ্রিলার বলে নয়, গল্পের শেষগুলো চমৎকারিত্ব আর আকস্মিকতার মেলবন্ধনও বটে। চতুরতায়, একেবারে সিলেক্টিভ অল্প শব্দে, ক্ষুরধার বাক্যে গল্পগুলো যে শেষ হয়, রেশ থেকে যেতে বাধ্য। যেমন ‘মসজিদ’ গল্পেও কোথাও মজিদের মেয়ে ময়নার পরিণতির কথা বলেননি, হুজুর মজিদকে কী প্রস্তাব ভেবে দেখতে বলেছেন, সে কথাও প্রকাশ্যে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেননি। কিন্তু পাঠক মাত্রই বুঝতে পেরেছেন গল্পকার কী বলতে চেয়েছেন, কী বোঝাতে চেয়েছেন। পাঠক বুঝবেন বলেই ‘পানির মধ্যে কাঁপতে থাকা মসজিদ’টার মতো পাঠকের হৃদয়ও কেঁপে উঠবে এই অন্যায় প্রস্তাবে, মজিদের হৃদয়ের বিশ্বাসের দ্বন্দ্বের কাঁপুনিতে। 

এই গল্পগ্রন্থের উপমা সাধারণত লোকজ উপাদানের আর ঐতিহ্যিক, সরল কিন্তু বৈদগ্ধ্যপূর্ণ। যেমন ‘সে নিয়ম করে কৃষাণের হেঁসু ধার দেওয়ার মতো করে এই সামান্য স্মৃতিটুকু শান দিয়ে রাখে।’ বা ‘সাপের মতো মেরুদণ্ডহীন লিকলিকে দেহ নিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে।’ বিরোধাভাসের অজস্র ব্যবহারে বক্তব্যকে করেছেন সুসংহত এবং একই সঙ্গে স্যাটায়ারের বাণে জর্জরিত। পরাবাস্তব বা জাদুবাস্তব টেকনিক অবলম্বন সত্ত্বেও তা পড়তে এতটুকু বোরিংনেস আনেনি। তত্ত্বের অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা বয়নে ধূম্রজাল বা জটিলতা তৈরি করা। সে কুহকে কেউ পথ খুঁজে পায়, কেউ ভ্রমণেই সন্তুষ্ট। তত্ত্ব বা ইজমের গুরুগম্ভীর মিশ্রণ সত্ত্বেও কীভাবে পরিবেশ সৃষ্টি আর বয়নভঙ্গির বদৌলতে মোজাফ্ফর মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ খুলে বসেছেন, তা না পড়লে পাঠক হয়তো আন্দাজও করতে পারবেন না।

আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’য় যেমন তৎকালীন সমাজব্যবস্থাকে প্রতিবিম্বিত করা হয়েছিল, এই রেস্তোরাঁও রূপকে বর্তমান সমাজব্যবস্থাকেই উপস্থাপন করেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুসংঘবদ্ধ প্রকাশে রেস্তোরাঁটি কিছু দিক দিয়ে আয়নাকেও ছাড়িয়ে গেছে, বিশেষ করে আঙ্গিকের দিক দিয়ে। কেন গ্রন্থটির নাম এমন বীভৎস? এ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে লেখক বলেছেন, ‘এটা আসলে প্রতীকী অর্থে, অনেকটা ডার্ক ফ্যান্টাসির মতো। মানুষজন রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে মানুষের মাংস খেতে, কিন্তু তারপর সেখানে গিয়ে তারা হিউম্যান রাইট নিয়ে কথা বলছে, মানুষকে নিয়ে কাজ করার কথা বলছে; কিন্তু তাদের টেবিলে সার্ভ করা হচ্ছে মানুষের মাংস। এইটা একধরনের ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজব্যবস্থাকে বলা।’ আর আমাদের সমাজের বর্তমান বীভৎসতাকে তুলে আনতে এমন একটা নাম তো সামান্যই। 

২১টি গল্প নিয়ে করা এই গ্রন্থটির প্রায় প্রতিটা গল্পই অনন্য। কাহিনির বিভিন্নতায় গল্পগুলো শেষ পর্যন্ত একটা সমাজের সমগ্রতার প্রজেকশন। গ্রন্থটি সম্পর্কে একটি বাক্য বলতে বললে বলব, ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ আমাদের সমসাময়িক বাংলাদেশের গদ্য প্যারোডি বা সামাজিক সমস্যার ডায়াগনস্টিক সেন্টার। যেখানে শৈল্পিকভাবে সমাজের নানা অসংগতির ওপর আলাদা করে করে আলো ফেলে প্রতিবিম্বিত করা হয়েছে। যেন সমস্যাগুলোর একটা রিপোর্ট দেওয়া হলো যে এই এই জায়গায় সমস্যা, এখন আপনার সমস্যা আপনি সমাধান করুন। এই প্রজেকশন করতে গিয়ে গল্পকার নানা ফন্দি এঁটেছেন, নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাপার ঘটিয়েছেন। আঙ্গিকগত নানান ব্যাখ্যা এখানে আনা যেতে পারে, আনা যেতে পারে জাদুবাস্তবতার মতো ইজমের অতুল্য ব্যবহার, মিশ্রণ, নিজেকেই ভেঙে নতুন করে গড়ার পরীক্ষণ, চমৎকার বয়নভঙ্গি, ভাষার ক্ষুরধার ব্যবহার, স্যাটায়ার, উইটের মসিচালনা, ফোর গ্রাউন্ডের উত্তেজক খেলা, চিত্রকল্পের নিখুঁত অবয়বের মতো শিল্প ও নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়গুলোর কথা। কিন্তু তা ছাপিয়ে গল্পকারের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, সত্য বলার সাহস আর প্রতিবাদের ভাষা পাঠকমাত্রই মুগ্ধ হতে বাধ্য। আলোকে আলো, অন্ধকারকে অন্ধকার বলার যে সাহস গল্পকারের মজ্জাগত, তার প্রশংসা না করলেই বরং অন্যায়। এই মস্তিষ্কহীনতার দিনে লেখক রূপকের আড়ালে, জাদুবাস্তবতার পোশাকে যে বাস্তবতার কুহকের রিফর্মেশন করেছেন, এর জন্য এ বইটির বহু গল্পই যে টিকে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।