• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২১, ০৭:৫৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১, ২০২১, ০৮:৩২ পিএম

শঙ্খ ঘোষ : সতত পদ্মার ঢেউ ছিল যাঁর বুকে

শঙ্খ ঘোষ : সতত পদ্মার ঢেউ ছিল যাঁর বুকে

‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর

লেখো আয়ু লেখো আয়ু

ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে

স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও।’

সত্যি সত্যি চুপ হয়ে গেলেন বাংলা কবিতার আরেক বরপুত্র শঙ্খ ঘোষ। চলে গেলেন ‘বিজ্ঞাপনের আড়ালে’। রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ‘সবিনয়ে নিবেদন’ বলবার মতো মানুষটি আর রইল না।
২১ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টায় ৮৯ বছর বয়সে কবি শঙ্খ ঘোষ শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন। ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মামার বাড়ি চাঁদপুরে এই কবির জন্ম। পিতৃভিটা অবশ্য ছিল বরিশালের বানারিপাড়ায়। বড়ো হয়েছেন পাকশীর রেলপাড়ায়। তাঁর বাবা মনীন্দ্র কুমার ঘোষ ছিলেন পাকশীর রেলওয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিক্ষক। বাবার স্কুল চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে তিনি ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। তারপর দেশবিভাগের কারণে চলে যান কলকাতায়। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। মাত্র ১৫ বছর বাংলাদেশে কাটানোর স্মৃতি তিনি কোনোদিন ভুলে যেতে পারেননি। তাঁর গদ্যে কাব্যে বারবার ধরা দিয়েছে প্রমত্তা পদ্মা।  

কবি শঙ্খ ঘোষের স্মৃতিতে পাকশী ছিল সতত রঙিন। তাঁর ‘সন্ধ্যানদীজল’ কবিতায় সেই পদ্মাকে দেখতে পাই চোখের সামনে। তর্পণরত এক কিশোর যেন দু’বাহু যুক্ত করে বসে আছে প্রমত্তা পদ্মার সামনে।
‘দুহাত তোমার স্রোতে, সাক্ষী থাকো,
সন্ধ্যানদীজল।
এমন তর্পণদিনে বহু মঠ পেরিয়ে পেরিয়ে
তোমার দুঃখের পাশে বসে আছি 
এই ভোরবেলা।’

২০০৮ সালে আজিজ সুপার মার্কেটের এক আড্ডায় সুধীজনের সঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর শৈশবের স্মৃতি ভাগ করেছিলেন। সে বছর ১৪ নভেম্বর তা দৈনিক ভোরের কাগজে তা প্রকাশিত হয়। সেখানে কবি তাঁর পাকশীর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, “ছোট্ট মফস্বল শহর। খুব গোছানো রেলওয়ে কলোনি। পেছনে ছিল একটা বন। সেটা এখন কেটে ফেলা হয়েছে। ভোরবেলা উঠে পদ্মার তীরে গেলাম বেড়াতে। নানা রকম খেলার মাঠ, ছোট স্কুল, খুব বেশি ছাত্র নেই সেখানে। পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত আমার একটা স্বপ্নের মধ্যে কেটেছে বলে মনে হয়। ষোল বছর বয়স যখন আমার, সেটা সাতচল্লিশ সাল, আমি স্কুল পরীক্ষা দিলাম, কলেজে এসে ভর্তি হলাম। তারপর কলেজে এসে চলে গেলাম কলকাতায়। একটা অন্যরকম জীবন শুরু হলো।”

একবার পদ্মায় বেড়াতে গিয়ে চোরাবালিতে তাঁর এক বন্ধুর প্রাণ সংশয়ের অবস্থা হয়েছিল। কবির স্মৃতিকথনে, “পদ্মার চরেও বেড়াতে যেতাম। তখনো চর ছিল। এখন সেটা আরো বড় হয়েছে। এদিক থেকে ওদিক জল আসতো। সে সরে অনেক বিপদেও পড়েছি। আমার এক বন্ধু ছিল খুব দুষ্ট। সে সবাইকে ধোঁকা দিতো। সে একদিন চরে গিয়ে বললো যে, এই আমাকে ধর, আমি তলিয়ে যাচ্ছি। আমরা তাকে ছেড়ে আসছিলাম। কিন্তু যখন দেখা গেলো কোমর পর্যন্ত তলিয়ে গেছে, তখন বোঝা গেল চোরাবালিতে আটকে গেছে। তখন দৌড়ে সবাই তাকে সেই চোরাবালি থেকে উদ্ধার করলাম। সুতরাং চর ছিল, চোরাবালিও ছিল।’’

পদ্মার ইলিশের স্মৃতি তিনি ভুলেননি কখনো। স্মৃতির পৃষ্ঠা মেলে ধরেন, “ছোটবেলায় ঘরে ঘরে হঠাৎ রটে গেল যে, ইলিশের নৌকা এসেছে, ইলিশের নৌকা এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা সব দৌড়ালাম সেখানে। দৌড়ে গিয়ে দেখি নৌকার ওপর একেবারে পাহাড় করা ইলিশ। আমরা জোড়ায় জোড়ায় সবাই ইলিশ কিনে বাড়ি ফিরে এসেছি।”

২০১৯ সালে প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’ কবি শঙ্খ ঘোষের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে লেখা লেখাগুলো এক করে একটি সংকলন প্রকাশ করে। নাম ‘সন্ধ্যানদীর জলে’। সেখানে কবির সরল স্বীকারোক্তি পাই, “এমন কবিতা কমই লিখেছি যার মধ্যে—শব্দে বা প্রতিমায়—বাংলাদেশই প্রচ্ছন্ন হয়ে নেই।”

আজীবন কবি দেশান্তরের কষ্টকর স্মৃতি ভুলে থাকতে পারেননি। তাঁর ‘পুনর্বাসন’ কবিতায় তারই প্রতিধ্বনি শুনি। পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে যাওয়ার বেদনা।
‘যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ঘাসপাথর
সরীসৃপ
ভাঙা মন্দির
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
নির্বাসন
কথামালা
একলা সূর্যাস্ত
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ধ্বংস
তীরবল্লম
ভিটেমাটি
সমস্ত একসঙ্গে কেঁপে ওঠে পশ্চিম মুখে
স্মৃতি যেন দীর্ঘযাত্রী দলদঙ্গল
ভাঙা বাক্স প’ড়ে থাকে আমগাছের ছায়ায়
এক পা ছেড়ে অন্য পায়ে হঠাত সব বাস্তুহীন’|

শঙ্খ ঘোষের আড়ালে থাকা মানুষটির প্রকৃত নাম হলো চিত্তপ্রিয় ঘোষ। পেশায় তিনি ছিলেন বাংলার অধ্যাপক। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বাংলা সাহিত্য পড়িয়েছেন। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার একাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ সালে লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। 
‘আত্মপ্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘এ তো সত্যি যে মুহুর্মুহু আমি বেঁচে থাকি বাংলাদেশেরই মধ্যে।’
সত্যি তিনি বেঁচে থাকবেন প্রদত্তা পদ্মার ঢেউয়ে; বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে।
‘সন্ধ্যানদীর জলে’ টলমল করবে তাঁর স্মৃতি।
‘তাদের সবার শ্বাস দুহাতে অঞ্জলি দিয়ে আজ 
এইখানে বসে ভাবি আমার সম্বল 
স্থির থাকা। 
আমার সম্বল শুধু ঝুমকোঘেরা মঠ অবিকল 
আমার নদীর নাম সন্ধ্যানদী, 
তুমি তার জল।’ 

ওঁ দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু। হে পরমেশ্বর! কবি যেন দিব্যলোকে গমন করেন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।