• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১, ২০২১, ০৮:৩১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১, ২০২১, ০৮:৩১ পিএম

নিঃশব্দে অনন্তযাত্রায়

নিঃশব্দে অনন্তযাত্রায়

নিঃশব্দে অনন্তযাত্রায় চলে গেলেন আমাদের কবিতা জগতের অভিভাবক বরেণ্য কবি শঙ্খ ঘোষ। কবি বলে অধিক পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক। রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রেও নিত্য নতুন দিক নির্দেশ করেছেন তিনি। শিশুসাহিত্যেও তাঁর বিচরণ ছিল অবাধ। প্রায় ৭০ বছরের সাহিত্যজীবনে তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৩৫, গদ্যগ্রন্থ ৫০-এর কাছাকাছি। শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত বইয়ের সংখ্যা ২৩। বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার এবং অগ্রন্থিত রচনা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ৭টি।

বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায় ১৯৩২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। বংশানুক্রমিক পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামে। পিতা মনীন্দ্রকুমার ঘোষের কর্মস্থল ছিল পাবনা। সেখানেই পড়াশোনা করে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতায় চলে আসেন কবি। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক আর ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলেজে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ এ্যাডভান্সড স্টাডিজ, শিমলা, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেন। ১৯৬০ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া ইউননিভার্সিটির রাইটার্স ওয়ার্কশপে এক বছরের জন্য যোগ দেন।

কবির প্রথম কবিতার বই ‘দিনগুলি রাতগুলি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নিহিত পাতাল ছায়া’ প্রকাশিত হয় ১১ বছর পর, ১৯৬৭ সালে। স্বাভাবিকভাবেই এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর কাব্যভাষা পাল্টে গিয়েছিল অনেক। কবির এক অন্যরূপ প্রত্যক্ষ করলাম আমরা। এরপর ‘আদিম লতাগুল্মময়’ প্রকাশিত হলো ১৯৭২-এ এবং ১৯৭৪ সালে প্রকাশ পায় ‘মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়’। আমরা পেলাম অমোঘ সেই পঙক্তি— ‘ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?/ চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?’ —এভাবে শুরু করে তিনি লিখলেন— ‘মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই/ মানবশরীর একবার? শেষ পঙক্তিতে পেলাম ‘লোকে বলবে মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়।’ ঐতিহ্যের স্বীকরণ তাঁর কবিতায় স্পষ্ট । ইঙ্গিতধর্মী ভাষা, ছন্দ মিল তাঁর কবিতাকে সর্বজনপ্রিয় করে তুলেছে। অনায়াস দক্ষতায় তিনি যখন লেখেন— ‘হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ নয় / সারাজীবন বইতে পারা সহজ নয়’... তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয়/ তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয়।’ তখন তাঁর কবিতার সূক্ষ্ম দার্শনিকতা স্পর্শ করে সমস্ত পাঠককে।

‘সময়’ খুব স্পষ্ট তাঁর কবিতায়। কবি বা শিল্পীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক লেগে থাকে প্রায়শই। কবিতা থেকেই কবির জীবনবোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিজের জীবনকে দূরে সরিয়ে রেখে কোনো কবিই কবিতা লিখতে পারেন না। সময়ের চিহ্ন সেখানে থাকবেই। কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় সময় সমাজ এবং মানুষ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। অন্তর্মুখী এই কবিকে কোনো কোনো আলোচক ‘দুঃখী সমাজের বন্ধু’ বলেছেন। মানবতা যখনই সঙ্কটে, তখনই সোচ্চার হয়েছেন কবি। কবিতায়, এবং উন্মুক্ত  রাজপথে মানুষের প্রতিবাদ মিছিলে। সময়ের ঘৃণ্য আবহ থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় তিনি অস্থির থেকেছেন নিরন্তর। আর তাই যেখানেই মানুষের অধিকারের ওপর আঘাত এসেছে, তিনি প্রতিবাদ করেছেন কখনো রাস্তায় মানুষের সঙ্গে পা মিলিয়ে, কখনো কবিতায়। এবং সমস্ত কিছুই করেছেন নিজের শর্তে। কোনো রাজনৈতিক রঙ তিনি চাননি। তিনি চাননি কোনো নেতার সেই মিছিলে  অংশগ্রহণ করুন। নন্দীগ্রামের ঘটনার পর বুদ্ধিজীবীদের মিছিলের পুরোভাগে তিনি ছিলেন। ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত কবি মুহূর্তের মধ্যেই যেন হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির বিবেক। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘বাবরের প্রার্থনা’। সে সময়ে ভারতবর্ষে জরুরি অবস্থা চলছিল। এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাতেই ছিল সেই জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এমন প্রতিবাদের কবিতা তিনি বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় ‘বহিরাগত’ শব্দটি খুব ব্যবহার করা হতো। সে সময় তিনি ‘বহিরাগত’ নামে একটি অসাধারণ কবিতা লিখেছিলেন— যার শেষ দুটি পঙক্তি ছিল—                 
বর্শাফলকে বিষ মেখে নিয়ে  কালো মুখোশের আড়ালে যত 
বহিরাগতরা এসে ঠিক ঠিকই বুঝে নেয় কারা বহিরাগত

কিছুদিন ধরে দেশের রাজনীতিতে ‘এনআরসি’, ‘সিএএ’ শব্দগুলি বিষের ধোঁয়ার মতো উড়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে, তিনি লিখলেন— ‘মাটি’ নামের একটি অনবদ্য কবিতা। যার শেষ কয়েকটি পঙক্তি— 
গোধূলিরঙিন মাচা, ও পাড়ায় উঠেছে আজান
এ-দাওয়ায় বসে ভাবি দুনিয়া আমার মেহমান।
এখনও পরীক্ষা চায় আগুনসমাজ
এ-মাটি আমারও মাটি সেকথা সবার সামনে কীভাবে প্রমাণ করব আজ

কবির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি  কাব্যগ্রন্থ— ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’[১৯৮০],  ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’[১৯৮৪], ধুম লেগেছে হৃদকমলে’[১৯৮৪]’ লাইনেই ছিলাম বাবা [১৯৯৩], গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ [১৯৯৪ ], জলই পাষাণ হয়ে আছে [২০০৪], হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ [২০১১], বহুস্বর স্তব্ধ পড়ে আছে  [ ২০১৪]। আসলে কবির প্রতিটি কবিতার বই-ই পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে । সহজ সরল কাব্যভাষার মধ্যেও এক সূক্ষ্ম দার্শনিকতা
এবং তীক্ষ্ণ বক্তব্য থাকে তাঁর কবিতায়, যা সম্মোহিত করে রাখে পাঠককে।

রবীন্দ্রচর্চায় বিশেষজ্ঞ  ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ। ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্র নাটক’  বইটিতে তিনি রবীন্দ্র নাটকের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। ‘আরোপ আর উদ্ভাবন’ ও বিশেষ করে  নাট্যকর্মীদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় গ্রন্থ। ‘নির্মাণ ও সৃষ্টি’  রবীন্দ্রবিষয়ক  এই গ্রন্থটির রচয়িতা হিসেবে তাঁর নাম চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে পাঠকের  মনে। ‘নিঃশব্দের তর্জনী’, ‘ছন্দের বারান্দা’, ‘উর্বশীর হাসি’, ‘শব্দ আর সত্য’, ‘ হে মহাজীবন—রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ’ বাংলা গদ্যসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি, কিন্তু একাদশ খণ্ড গদ্য সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে একটি সংকলন ‘সন্ধ্যানদীর জল’ যেখানে সংকলিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নানান সময়ে  লেখা তাঁর  স্মৃতিকথা, ভ্রমণপঞ্জি এবং  অন্যান্য বিষয় নিয়ে কিছু প্রবন্ধ।

শিশু ও কিশোরদের জন্য লেখা তাঁর প্রতিটি গ্রন্থ শিশু-কিশোর মহলে সমাদৃত। তার মধ্যে ‘সুপারি বনের সারি’, ‘কথা নিয়ে খেলা’, ‘আমন যাবে লাট্টু পাহাড়’, ‘ওরে ও বায়নাবতী’ খুবই উল্লেখযোগ্য।

অনুবাদ জগতেও তাঁর অবদান কম নয়। প্রিয় বন্ধু কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর সঙ্গে সম্পাদনা করেছিলেন ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত’। সমস্ত পৃথিবীর কবিতা থেকে নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ।

ভারভারা রাও-এর কবিতার অনুবাদ করেছিলেন তিনি। ইকবাল-এর কবিতা ও তাঁর কবিতার আলচনা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘ইকবাল’। এ ছাড়াও অনেক কবির কবিতা অনুবাদ করেছেন তিনি।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর বিশাল অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন স্বীকৃতি লাভ করেছেন। ১৯৭৭ সালে ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার। ঐ বছরেই ‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন নরসিংহ দাস পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তাঁকে সরস্বতী পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৯৯ সালে কন্নড় ভাষার নাটক ‘রক্তকল্যাণ’ অনুবাদের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার। ১৯৯৯ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি প্রদান করে। ২০১১তে তিনি ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হন। ২০১৬ সালে তিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন তাঁর সাহিত্যকৃতির জন্য।

ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছুই শিখেছি কবির কাছে। ‘স্থিতধী’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ আমি ওঁকে দেখেই জেনেছি। পর্বতপ্রমাণ জ্ঞান নিয়ে কীভাবে যে এমন নিরহংকার থাকা যায়, আশ্চর্য হয়ে তাই দেখেছি। কবিতা বিষয়ে অনেক শিক্ষা তাঁর কাছেই পাওয়া। অতিমারির বিধিনিষেধ মেনে তাঁকে বিদায় জানাতে হলো দূর থেকে। প্রণম্য কবির পায়ে শেষ প্রণাম  
জানাবার সুযোগ পেলেন না কেউ— এ যন্ত্রণা  দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াবে বাঙালিসমাজ ।