• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২, ২০২১, ০৪:৩১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৩, ২০২১, ০৪:৫০ পিএম

স্মৃতিচারণা

সত্যজিৎকে দেখেছিলাম

সত্যজিৎকে দেখেছিলাম

খুব সম্ভবত ১৯৫৭ সালের গোড়ার দিক, আমি তখন কলকাতা আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজের ছাত্র। সেদিন কলেজে ঢুকতেই একটা চাপা উত্তেজনা টের পেয়েছিলাম। কী ব্যাপার? না, সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘অপরাজিত’ ছবির শুটিং করতে  কলেজে আসছেন। ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে থাকবে অপু আর তার এক বন্ধু, এইটুকুই শুধু নকল; বাকি সব আসল। ক্লাসরুমে কলেজের ছাত্ররাই থাকবে, পড়াবেন কলেজেরই অধ্যাপক। পড়ানোর বাইরে চিত্রনাট্যের দু-তিনটি সংলাপ বলবেন দুজন অধ্যাপক।

বিভূতিভূষণের ‘অপরাজিত’ গ্রন্থের অপু ভর্তি হয়েছিল রিপন কলেজে। “রিপন কলেজের বাড়ি তাহার কাছে বেশ ভালো  ও উঁচু মনে হইল। ভর্তি হইয়া সে একটি ছাত্রের সঙ্গে ক্লাস-রুমগুলি দেখিতে গেল। ক্লাসে ইলেকট্রিক পাখা। কি করিয়া খুলিতে হয়? তাহার সঙ্গী দেখাইয়া দিল। সে খুশির সহিত তাহার নীচে খানিকক্ষণ বসিয়া রহিল, এত হাতের কাছে ইলেকট্রিক পাখা পাইয়া বারবার পাখা খুলিয়া বন্ধ করিয়া দেখিতে লাগিল।”

রিপন কলেজ বেশ পছন্দসই ছিল অপুর, কিন্তু ‘অপরাজিত’ ছবির নির্মাতা সত্যজিতের পছন্দ হয়েছিল আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজ। এই কলেজের ক্লাসরুমগুলি আকারে শুধু বড়ই নয়, বড়-বড় জানলা-দরজা দিয়ে আলো-হাওয়া আসে  প্রচুর। ক্যামেরার চোখ এখানে বোধহয় বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করে। বইয়ের অপু ছবিতে এসে তাই সিটি কলেজের ছাত্র হয়ে গিয়েছিল।

সত্যজিৎ রায় মাত্র দু-বছর আগে ধরতে গেলে রাতারাতি জগদ্বরেণ্য হয়ে উঠেছেন। ১৯৫৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর ‘পথের পাঁচালী’  আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে এগারোটি। ১৯৫৬ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে।  নানা দিক থেকে প্রাপ্তির তালিকা আরও দীর্ঘ। সেই মানুষটি সিটি কলেজে ‘অপরাজিত’ ছবির শুটিং করতে আসছেন—এর চাইতে বড় খবর কলেজের ছাত্রদের কাছে আর কী থাকতে পারে!

একটু পরে প্রায় সাড়ে-ছ ফিট লম্বা মানুষটি তাঁর ইউনিট নিয়ে শুট করতে ঢুকলেন ক্লাসরুমে। ছবি দেখা আর ছবি করতে দেখার মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। কিন্তু পরিচালক যদি সত্যজিৎ হন, তাহলে ঘাটতি মিটে যায় অনেকখানি। জলদগম্ভীর কণ্ঠে ‘সাইলেন্স’ এবং ‘কাট’ শুনেছিলাম বেশ কয়েকবার। একফাঁকে গিয়ে অটোগ্রাফও নিয়ে এসেছিলাম।

‘অপরাজিত’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার পরে আমাদের কাছে এই ছবিটির বাড়তি আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল কলেজের চেনা দৃশ্য। আমার শেষ কৈশোরে সত্যজিৎকে সেই প্রথম দেখা, তারপর থেকে শুধু আমি নয়; সামান্য আগে ও পরে আমারই মতো সব বাঙালির হৃদয় ও মননে তিনি একটু-একটু করে অনেকখানি জায়গা করে নিয়েছেন।

সত্যজিৎ রায়ের সব ছবি একাধিকবার দেখেছি, দেশবিদেশে দেওয়া তাঁর বহু সাক্ষাৎকার একাধিকবার শুনেছি আর  বইপত্তর তো পড়েইছি, কিন্তু ওঁর কাছে গিয়ে একবারই শুধু একান্তে কিছুক্ষণ গল্প করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সাতের দশক শেষ হওয়ার মুখে । কত বছর  আগেকার কথা, কিন্তু সেই স্মৃতি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে।

বরাবর সাংবাদিকতাই আমার পেশা ছিল। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সহ-সম্পাদক পদে যোগ দিই। তারপর ওই  সংস্থারই দুটি ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ প্রধান সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করি বছর-বারো। তারপর চলে আসি মাসিক আনন্দমেলায়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় পত্রিকাটি তখন সবে প্রকাশিত হয়েছে। জাঁক করে বার হচ্ছে হতে পত্রিকাটির পূজাসংখ্যা। সত্যজিৎ পূজাসংখ্যায় লিখতে শুরু করেছেন একটি করে শঙ্কুকাহিনি আর ‘দেশ’ পত্রিকায় ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি।

আনন্দমেলায় নিয়ম ছিল-- প্রতিটি লেখাই, তা লব্ধপ্রতিষ্ঠ কোনও লেখকের হলেও, ভালোভাবে পড়ার পরে প্রেসে পাঠাতে হবে। পড়তে গিয়ে কোথাও কোনও খটকা লাগলে সংশ্লিষ্ট লেখকের সঙ্গে কথা বলে সেটি ঠিক করে নেওয়া  হত। তা সেবার শঙ্কুকাহিনি আমিই আদ্যোপান্ত পড়ার পরে প্রেসে পাঠিয়েছিলাম। বিদেশের পটভূমিকায় লেখা অসাধারণ এক কাহিনি। সাহেব চরিত্রও ছিল বেশ কয়েকটি। তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, অসঙ্গতি, মুদ্রাদোষ চোখে পড়ার মতো। কাহিনির পরতে পরতে রহস্য। বিচিত্র বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড তো ছিলই। ঝকঝকে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, কোথাও কাটাকুটি নেই। শুনেছি, পুরো লেখাটাই উনি নিজের হাতে কপি করে দিতেন। সত্যজিতের বাড়িতে যাতায়াত ছিল এমন একজনের কাছ থেকে শুনেছি, মাঝারি মাপের এই ধরনের একটি কাহিনি লিখে ফেলতে ওঁর দিন-পনেরোর বেশি সময় লাগত না। তবে মাথার মধ্যে গল্পের প্লট সাজানোর কাজ অনেক আগে থেকেই চলত। প্রয়োজনীয় কোনও তথ্য সংগ্রহের দরকার হলে সেটিও আগেভাগেই সংগ্রহ করে নিতেন। এইভাবে পুরো গল্পটি মাথার মধ্যে সাজানো হয়ে গেলেই কলম খুলতেন।

তা, সেবার শঙ্কুকাহিনি প্রেসে পাঠাবার পরদিনই অফিসের কী-একটা কাজে ওঁর বাড়িতে আমাকে যেতে হয়েছিল। যাওয়ার অনুমতি টেলিফোনে আগেই নিয়ে নিয়েছিলাম। বিশ্বখ্যাত অত বড় মাপের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কিছু বাঙালি শিষ্টতা সত্যজিৎ মেনে চলতেন। প্রতিটি টেলিফোন নিজে ধরতেন। মস্ত বড় ঘর, বেশ কিছুটা হেঁটে এসে অতিথির জন্য নিজে দরজা খুলতেন। অতিথিকে পৌঁছেও দিতেন দরজা পর্যন্ত। অতিথি-অভ্যাগতর খাবারদাবারেও বাঙালিয়ানার কিছু ছোঁয়া থাকত।

বিশপ লেফরয় রোডের বাড়িতে সেই আমার প্রথম যাওয়া। ব্রিটিশ আমলে বানানো মস্ত বাড়ি। প্রতিটি ফ্লোরের সিলিং অনেক উঁচুতে। সত্যজিতের ফ্ল্যাট তিনতলায়। বেশ চওড়া কাঠের সিঁড়ি, সিঁড়ি উঠে গিয়েছে ওপরে। ওই বাড়িতে তখনও  লিফ্‌ট বসেনি। ঘরের জানলা-দরজাগুলো মস্ত বড়-বড়। আমি যে কাজ নিয়ে গিয়েছিলাম সে কাজ মিটতে খুব বেশি সময় লাগেনি। অতিমাত্রায় ব্যস্ত মানুষের সময় নষ্ট করা ঠিক নয়, উঠে পড়ার মুখে বললাম, ‘আপনার এবারের শঙ্কুকাহিনি আমার দারুণ লেগেছে।’

গম্ভীর, ব্যস্ত মানুষটির চোখমুখের চেহারা সঙ্গে সঙ্গে পালটে গিয়েছিল। ‘সে কি! তুমি এর মধ্যেই পড়ে ফেলেছ?’

বললাম, ‘কাল প্রেসে পাঠাবার আগে পড়ে নিয়েছিলাম, অসাধারণ লেখা!’ একজন মুগ্ধ পাঠক সদ্য-পড়া লেখার কথা তো পাঁচজনকে ডেকে ডেকে শোনাতে চায়, আর আমি তো এখন স্বয়ং লেখকের সামনে। পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানার ব্যাপারে লেখক আবার আগ্রহী। মাত্র একদিন আগে পড়া কাহিনির নাম, ধাম, রহস্য ও চমক তো মাথার মধ্যে ঘুরছিল ; কথাপ্রসঙ্গে তার অনেকটাই আমি গড়গড় করে বলে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বিদেশের পটভূমিকায় শঙ্কু আর বিদেশি চরিত্রদের চালচলন, কথাবার্তা ভীষণ জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

সুবিশাল ব্যক্তিত্বের মানুষটি এবার ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠে বললেন, ‘এই ব্যাপারে কেউ আমাকে হারাতে পারবে  না।’ কথাটি আজও আমার পরিষ্কার মনে আছে। মনে আছে খোলামেলা ভঙ্গির উজ্জ্বল সেই হাসিটিও। আসলে এর মধ্যেই  বোধহয় সাহিত্যের সেই চিরন্তন সত্যটি ধরা পড়েছে। লিখে একজন লেখক আনন্দ পান, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে লেখা তো পাঠকের। শেষ আনন্দ বুঝি পাঠকই দিতে পারেন লেখককে। গান যেমন শুধুমাত্র গায়কের নয়, তার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় রসজ্ঞ শ্রোতা পেলেই।

শঙ্কু খাপছাড়া গোছের বিজ্ঞানী, বিচিত্র সব আবিষ্কার আছে তার। কিন্তু এই বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের মৌলিক সত্যের বাইরে যায় না কখনো, তার স্রষ্টা কখনো তাকে সৃষ্টিছাড়া বানাতে চান না।  গল্পের মধ্যে এসব কথাও এসেছিল খানিকটা।  সেদিনের খাবারের কথাটাও মনে আছে। একটি প্লেটে দুটি নাড়ু, খানিকটা চানাচুর আর এক কাপ চা। শঙ্কুকাহিনি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ গল্প চালাবার পরে বিদায় নিয়েছিলাম। দীর্ঘদেহী, ব্যারিটোন মানুষটি মস্ত ঘরের দরজা পর্যন্ত সঙ্গে এসেছিলেন।

শুনেছি, পুজোর লেখা পত্রিকা-অফিসে পাঠাবার আগে সত্যজিৎ রায় স্ত্রী ও ছেলেকে লেখাটি পড়ে শোনাতেন। সেবারের ওই শঙ্কুকাহিনির আমি ছিলাম তৃতীয় পাঠক।

বাংলার নবজাগরণের শেষ স্তম্ভ ছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর মনীষার দীপ্তি আজও সমুজ্জ্বল। শুধু তাই নয়, আজও সমাজজীবনের নানা ক্ষেত্রে তিনি  সমান প্রাসঙ্গিক। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ ও নির্মল হাস্যরসের ধাক্কায় আজকের সমাজের নানা অসঙ্গতিও আমাদের চোখের সামনে উঠে আসে।

প্রচণ্ড পড়ুয়া মানুষ ছিলেন, আর পড়াশোনার পরিধিও ছিল ব্যাপক। ছয়-সাতের দশকে কলকাতায়, বিশেষ করে চৌরঙ্গিপাড়ার বইয়ের দোকানগুলিতে ইউরোপ-আমেরিকার হালফিলের বেশ কিছু বইপত্তর পাওয়া যেত। সত্যজিতের প্রিয় বইয়ের দোকান ছিল সেদিনের ‘লাইটহাউস’ সিনেমাহলের উলটো দিকের বইয়ের দোকানটি। আমি দিনতিনেক ওই বইয়ের দোকানে ওঁকে দেখেছি। দোকানে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটির পরে একগাদা বই কিনে নিতেন। কলকাতার বিখ্যাত সেই ‘লাইটহাউস’ সিনেমাটি কবে উঠে গিয়েছে, এখন সেখানে মস্ত এক পোশাকবিপণি। দুঃখের কথা, উলটো দিকের  ঝলমলে সেই বইয়ের দোকানটি ডিজিটাল এজের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত উঠেই গেল। কয়েক দিন আগে একটি খবরের কাগজে ওই দোকানের বৃদ্ধ মালিকের ছোট্ট একটি সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, এই দোকানের নিয়মিত একজন খদ্দের ছিলেন সত্যজিৎ রায়। এসেই নতুন বইপত্তরের খোঁজখবর নিতেন। বেশ কিছুক্ষণ উলটেপালটে দেখার পরে কিনতেনও বেশ কয়েকটি বই।

আজ থেকে বছর-ত্রিশ আগে মাত্র সত্তর বছর বয়সে মানুষটি প্রয়াত হয়েছেন। যদি আরও দশ-পনেরোটি বছর বাঁচতেন, আমাদের সমৃদ্ধির পরিমাণ আরও কতখানি বেড়ে যেত ভাবা যায় না! নানা বিষয়ে কত স্মৃতি, বলার মতো কথাও কম  নেই। তবে উপস্থিত লেখাটি শেষ করছি চমকপ্রদ একটি অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে।

আমি রাজস্থান সফর করেছি দুবার। একবার অল্প বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে, আর একবার বছর-চারেক আগে। দ্বিতীয়বারের সফরটি প্রথমবারের তুলনায় ঢের বেশি পরিকল্পিত ছিল। কলকাতা থেকে বিমানে জয়পুর। এক পর্যটন কোম্পানির একটি গাড়ি ঠিক করা ছিল বিমানবন্দরে। ওই গাড়িতে চেপেই আমরা দিন দশ-বারো ধরে গোটা রাজস্থান সফর  করেছি। সফরের শেষ দিকে গিয়েছিলাম জয়সলমিরের সোনার কেল্লা দেখতে। আমার প্রথমবারের রাজস্থান-সফরে জয়সলমির ছিল না। কেউই তখন ওখানে বেড়াতে যেত না। কিন্তু সত্যজিতের ‘সোনার কেল্লা’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরে রাজস্থানের পর্যটকদের ‘অবশ্যদ্রষ্টব্য’ তালিকায় ঢুকে গিয়েছে সোনার কেল্লা।

আজ থেকে প্রায় ন’শো বছর আগে তৈরি জয়সলমির দুর্গটি দীর্ঘকাল ধরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। দুর্গটি এখন ছোট একটি মরুশহরের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। এটি আবার পাকিস্তান সীমান্ত-এলাকার কাছে। ব্যবসাবাণিজ্য একেবারেই শুকিয়ে গিয়েছিল জয়সলমিরে। কিন্তু পরিত্যক্ত এই শহরে  আবার প্রাণের সঞ্চার হয় সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা এখন নিয়মিত ভাবে আসতে শুরু করেছেন সোনার কেল্লা দেখতে। হালে তো রমরমা। এই কেল্লায় রাজার বংশধর ও তাঁদের আশ্রিতের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এঁদের মধ্যে সত্তর শতাংশ  ব্রাহ্মণ আর ত্রিশ শতাংশ রাজপুত। এঁদের অনেকেই এখন পর্যটকদের গাইডের কাজ করে থাকেন।

আমাদের গাইড নরেন্দ্র পুরোহিত দিল্লিতে গিয়ে ট্যুরিস্ট গাইড হওয়ার একটা কোর্স করে এসেছেন । হিন্দি ও ইংরেজির বাইরে কাজ চালানোর মতো স্প্যানিশ ও ইতালীয় জানেন। বছর-পঁয়ত্রিশ বয়েস, উৎসাহী যুবক। জয়সলমির দুর্গ ঘোরাতে ঘোরাতে সত্যজিৎ রায়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘এই দুর্গটি একটি পরিত্যক্ত দুর্গের চেহারা ধরেছিল। চারপাশে শুধুই মরুভূমি। কাছেই পাকিস্তানের সীমান্ত-এলাকা। প্রাচীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দুর্গের লোকজনের কোনও কর্মসংস্থান ছিল না। এক-এক করে কিংবা ঝাঁক বেঁধে অনেকেই রুটি-রুজির ধান্দায় এখানে-সেখানে সরে পড়ছিলেন। এমন সময় ম্যাজিক দেখিয়ে দিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘সোনার কেল্লা’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, তারপরেই সবার চোখ পড়ল এই কেল্লার দিকে। সত্যজিতের অনুরাগী দর্শক ছড়িয়ে আছে গোটা পৃথিবীতে। সারা বছরই দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে পর্যটক আসে এখানে। আর দেশের লোকজনরা তো আছেই। আশেপাশে অনেক হোটেল গজিয়ে উঠেছে, ভালো-ভালো হোটেল। দুর্গের মধ্যেও থ্রি-স্টার লেভেলের হোটেলও তৈরি হয়েছে। দোকানপাট হয়েছে বিস্তর। সবাই কিছু-না-কিছু কেনেন স্মারক হিসেবে। দুর্গের ভালোরকম সংস্কার হয়েছে, শুধু একটা বাড়ি ভাঙাচোরা অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়েছে-- ।’

‘কেন?’

আমার প্রশ্নের উত্তরে একগাল হেসে নরেন্দ্র বললেন, ‘ওই ভাঙা বাড়িটাই তো সোনার কেল্লার মুকুলের গত জন্মের বাড়ি। অনেক ট্যুরিস্ট দুর্গে পা দিয়েই প্রশ্ন করেন—মুকুলের বাড়িটা কোথায়?’

এর পরেই ট্যুরিস্ট যে তথ্যটি দিলেন সেটি চমকপ্রদ। বললেন, ‘ দুর্গ-কমিটির পক্ষ থেকে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে— এত বছর ধরে যে মানুষটির জন্যে আমাদের কর্মসংস্থান হয়েছে, কপাল ফিরেছে ; তাঁকে নিয়ে আমরা একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করব। মন্দিরে সত্যজিতের একটি মূর্তি স্থাপন করা হবে। তবে ওটি নিছক মূর্তি প্রতিষ্ঠা নয়, তার চেয়েও ঢের বেশি কিছু। মন্দিরের বাইরে ঝোলানো ফলকে লেখা থাকবে—অনুগ্রহ করে বাইরে জুতো খুলে রেখে ভেতরে ঢুকুন।’

জয়সলমির দুর্গের পাশেই একটা হোটেলে আমরা রাতে ছিলাম। পরদিন ভোররাতেই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম বাইরে। একটু বাদে ভোরের প্রথম সূর্যের আলোয় এক আশ্চর্যসুন্দর দৃশ্য দেখেছিলাম। হলুদ-হলুদ পাথরে তৈরি বিশাল দুর্গটিকে ঠিক সোনার কেল্লা বলে মনে হচ্ছিল।