মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের ‘ইব্‌নে তুফায়্ল’

সলিমুল্লাহ খান প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২১, ০৪:২৮ পিএম মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের ‘ইব্‌নে তুফায়্ল’

ভূমিকা

মুজফ্ফর আহ্‌মদের লেখা এই নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় আজ হইতে একশত বৎসরের কিছু আগে—‘বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা’র ২য় বর্ষ ৪র্থ (বাংলা ১৩২৬ সালের মাঘ, ইংরেজি ১৯২০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) সংখ্যায়। দেখা যাইতেছে, মুজফ্ফর আহমদ তখনও নিজের নামের বানান পুরানা নিয়মে—অর্থাৎ ‘মোজাফ্‌ফর ‌‌আহ্‌মদ’—লিখিতেছেন। পরবর্তী জমানায় তাঁহার নামে যে সকল নিবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হইয়াছে তাহাদের মধ্যে—যতদূর জানি—ইহার স্থান হয় নাই। ‘বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা’র পুরাতন সংগ্রহ হইতে ইহা আমাকে উৎকলন করিয়া দিয়াছে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র আরস্তু লেনিন খান। এখানে আমরা ন্যূনতম সম্পাদনার—মানে পরিষ্কার মুদ্রণ প্রমাদ সংশোধন আর কোন কোন শব্দের একাধিক বানান পরস্পরের অনুগামী করার—অধিক করি নাই।

সম্প্রতি আমেরিকার প্রসিদ্ধ ‘দি নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় পত্রস্থ একটি লেখায় (৫ এপ্রিল ২০২১) ইবনে তুফায়েলের ভূয়সী প্রশংসা করা হইয়াছে। লেখাটির শিরোনাম—‘যে সকল মুসলমান স্পিনোজা, লক এবং ডিফোর প্রাণবায়ু যোগাইয়াছিলেন’।

এই নিবন্ধের লেখক মুস্তফা আকিয়ল মনে করেন, ইবনে তুফায়েলের কহতব্য পরিষ্কার আর—বিশেষ দ্বাদশ শতাব্দীর কথা মনে রাখিলে—সাহসের কাজ বটে। ইবনে তুফায়েলের মোদ্দা কথা—আকিয়লের জবানিতে যতদূর দেখিলাম—এই: সত্য উপলব্ধি করিবার অনেক পথ আর ধর্মও তাহাদের মধ্যে—তবে ধর্মই একমাত্র পথ নহে। ইবনে তুফায়েল দেখাইয়াছেন, সৌভাগ্যের কথা এই যে মানুষ ঐশী প্রত্যাদেশ লাভ করিয়াছে। অধিক সৌভাগ্যের মধ্যে, তাহাদের অন্তরে যুক্তিবুদ্ধি আর বিবেকের স্থানও আছে। এই সুবাদে মানুষ বিশেষ কোন প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম অবলম্বন না করিয়াও—কিম্বা ভিন্ন কোন ধর্ম অনুসরণ করিয়াও—প্রজ্ঞাবান হইতে পারে, হইতে পারে সত্ত্বগুণের অধিকারী। এই সত্য খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর—হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর—পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বড় কথা বটে।

মুস্তফা আকিয়ল জানাইতেছেন, আধুনিক যুগের প্রারম্ভিক পর্বে—তথাকথিত মধ্যযুগে নহে—আরবি ভাষায় লেখা ইব্নে তুফায়েলের ‘কল্প-উপন্যাস’ “হাই ইবনে ইয়কজান” এয়ুরোপ খণ্ডের নানান ভাষায় তর্জমা করা হইয়াছিল। আকিয়ল দেখাইতেছেন, মূল লেখার প্রায় পাঁচ শত বৎসর পর ১৬৭১ সালে লাতিন ভাষায় ইহার তর্জমা করেন এডোয়ার্ড পোকক জুনিয়র। কাছাকাছি দুই দুইটি ইংরেজি অনুবাদের খবরও পাওয়া যায়—একটি জর্জ কিথের (১৬৭৪), দ্বিতীয়টি সাইমন ওকলির (১৭০৮) কীর্তি।

ওকলির তর্জমা প্রকাশের এগার বছর পর—ইংরেজি সন ১৭১৯ নাগাদ—ড্যানিয়েল ডিফোর জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘রবিনসন ক্রুসোর কাহিনি’ লেখা হয়। এই কল্প-কাহিনিতে ‘হাই ইবনে ইয়কজানে’র ছায়া অনেকেই দেখিতে পাইয়াছেন। ইংলন্ডের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার ভূতপূর্ব সম্পাদক মার্টিন ওয়েনরাইট মনে করেন, ডিফোর ‘এই ক্লাসিক বা প্রাতঃস্মরণীয় উপন্যাসটির অঙ্গে অঙ্গে ইবনে তুফায়েলের পায়ের চিহ্ন লাগিয়া রহিয়াছে।’

ইবনে তুফায়েলের অনুরাগীদের মধ্যে অনেকের নামও উল্লেখ করিয়াছেন আকিয়ল। তাঁহাদের মধ্যে এয়ুরোপের মৌরসি এনলাইটেনমেন্ট বা সহি চেরাগি যুগের তত্ত্বজ্ঞানী ওলন্দাজ বারুক স্পিনোজা, জার্মান গটফ্রিড বিলহেলম লিবনিৎস এবং ইংরেজ জন লক। এয়ুরোপ খণ্ডে তখন ধর্মের নামে ভয়ানক রক্তপাত হইতেছিল এবং নানান জাতির মধ্যে ধর্ম সম্প্রদায়ের অন্তর্বিরোধ তুঙ্গে উঠিয়াছিল। ইব্নে তুফায়েলের ‘উপন্যাস’ এয়ুরোপের বিবিধ বিবদমান নাসারা বা খ্রিস্টান গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তির বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছিল। ধর্মকেন্দ্রিক বিবাদ-বিসম্বাদ-পীড়িত সেই চরম হতাশার যুগে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উপরোক্ত তত্ত্বজ্ঞানীগণ ছাড়াও আরও অনেকেই ইবনে তুফায়েলের লেখায় পরম আশার আলো দেখিয়াছিলেন।

আর কিছুদিন পরে যিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করিবেন তিনি যে এই মানবতন্ত্রের ধ্বজাবাহক মনীষীর একান্ত অনুরাগী হইবেন তাহাতে বিশেষ বিস্ময়ের কারণ নাই। এই ‘ইবনে তুফায়েল’ বন্দনাটি রচিবার সময় তাঁহার বয়স বড়জোর—টানিয়াটুনিয়া বলিলে—৩০ বছর হইয়াছে। তাঁহার গদ্যের প্রাঞ্জলতা তখনই প্রশংসার যোগ্য হইয়াছে।

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ এই লেখা বাবদ কোন অপূর্বতা দাবি করেন নাই। অবশ্য ইহাকে তর্জমাও বলেন নাই তিনি, সবিনয়ে শুদ্ধ ‘সঙ্কলন’ প্রজাতির অন্তর্গত করিয়াছিলেন। পুরাতন বাংলাদেশের মতন আজিকার স্বাধীন বাংলাদেশেও নিও-লিবারেল বা নব্য-স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের ফলে সাধারণ লোকে এখনও মুজফ্ফর আহ্‌মদকে সম্যক জানিতে ও চিনিতে পারে নাই। তাঁহার পরিচয়-চিহ্ন স্থিত হইয়াছে ‘কাকাবাবু’ নামক একটি পদে। জন্মভূমি বাংলাদেশে কি—প্রাজ্ঞ জীবনের কর্মতীর্থ ভারতবর্ষে—আজও তাঁহার সম্পূর্ণ রচনাবলী কেহ সম্পাদনা করেন নাই। ‘দুর্ভাগা দেশ’ আর কাহাকে বা বলিব!

শুনিয়াছি ‘হাই ইবনে ইয়কজান’ গ্রন্থটির একটি বাংলা তর্জমাও প্রকাশ পাইয়াছে। দুর্ভাগ্যবশত বইটি এখনও যোগাড় করিতে পারি নাই।

 

সলিমুল্লাহ খান

৯ এপ্রিল ২০২১

 


 

ইব্নে তুফায়্‌ল

 

স্পেনের বিখ্যাত দার্শনিক ইব্‌নে তুফায়লের বিষয় এ দেশের অনেকেই জানেন না। আজ আমি তাঁহার সামান্য কিছু তথ্য এখানে সঙ্কলন করিয়া দিব—এই আশায় যে আমার স্বদেশবাসীরা তাঁহাকে জানিতে ও চিনিতে চেষ্টা করিবেন।

তাঁহার পূর্ণ নাম—আবুবকর বিন্ মোহাম্মদ বিন্ আবদুল মালিক বিন্ মোহাম্মদ বিন্ মোহাম্মদ বিন্ তুফায়ল আল্-কায়সী। আল্-কায়স নামক বিখ্যাত আরব বংশে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়াই ইব্‌নে তুফায়লের বংশের লোককে আল্-কায়সী বলা হয়। কেহ কেহ তাঁহাকে আল্-আন্দালুসী (স্পেনবাসী) এবং আল্-কুদ্দবীও (কর্ডোভাবাসী) বলিয়া থাকেন। প্রায় সর্ব্বত্র তিনি ইব্‌নে তুফায়ল নামেই পরিচিত। তবে ইউরোপের খৃষ্টান Scholastics-রা তাঁহাকে আবু বকরের অপভ্রংশ Abubacer নামে অভিহিত করিতেন।

গ্রানাডা হইতে ৪০ মাইল উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত ওয়াদিআশ্ (বর্ত্তমান Guadix) নামক স্থানে দ্বাদশ শতাব্দীতে (হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দী) ইব্‌নে তুফায়ল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পরিবার ও শিক্ষা সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় নাই। লোকে যে তাঁহাকে ইব্‌নে বাজ্জার শিষ্য বলিয়া থাকেন সে কথা ভুল। কারণ ইব্‌নে তুফায়ল নিজেই তাঁহার বিশ্ব-বিখ্যাত দার্শনিক উপন্যাসের ভূমিকায় লিখিয়া গিয়াছেন যে ইব্‌নে বাজ্জার সহিত তাঁহার পরিচয় ছিল না। এক্ষণে তাঁহার কর্ম্মজীবন সম্বন্ধে কিছু বলিব।

প্রথমে তিনি গ্রানাডাতে চিকিৎসকের কার্য্য আরম্ভ করেন। তারপর সে প্রদেশের গবর্ণরের মুন্‌শীরূপে নিযুক্ত হন। ১১৫৪ খৃষ্টাব্দে তিনি সেণ্টা (Centa) ও টাঞ্জিয়ারের শাসনকর্ত্তার মুন্‌শী নিযুক্ত হন। এই শাসনকর্ত্তাটি ছিলেন আল্-মোওয়াহিদ রাজবংশের স্থাপয়িতা আবদুল মু’মিনের পুত্র। পরিশেষে তিনি আল্-মোওয়াহিদ্ সুলতান আবু ইয়াকুব ইউসুফের দরবারে রাজচিকিৎসকের পদ গ্রহণ করেন (১১৬৩-১১৮৪ খৃ:)। কেহ কেহ বলেন তিনি সুলতান আবু ইয়াকুবের উজীর ছিলেন। কিন্তু সে কথা যে কতদূর সত্য তাহা ঠিক করিয়া বলা যায় না। তবে দরবারে যে তাঁহার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাঁহারি প্রসাদে মোওয়াহিদ্ সুলতানের দরবারে সুধীমণ্ডলী আকৃষ্ট হইয়া আসিতেন। যুবক ইব্নে রুশ্‌দ্‌কে (ইউরোপীয় ইতিহাসের Averroes) তিনিই সুলতানের সহিত পরিচয় করাইয়া দিয়াছিলেন। সুলতান ইব্নে রুশ্‌দ্‌কে এরিষ্টটলের গ্রন্থাবলীর টীকা লিখিতে উপদেশ দিয়াছিলেন ইব্নে তুফায়লেরই ইঙ্গিতে। তাঁহার এক ছাত্র, আবু বকর বুন্দুদ, বলেন: “সুলতান তাঁহার (ইব্নে তুফায়লের) অতিশয় অনুরক্ত ছিলেন। তিনি সুলতানের সঙ্গে সমস্ত রাত্রিদিন রাজপ্রাসাদের ভিতরে থাকিতেন।”

৫৭৮ হিজরীতে বার্দ্ধক্য প্রযুক্ত ইব্‌নে তুফায়ল রাজকার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করেন এবং ইব্নে রুশ্‌দ্‌ তাঁহার পদে রাজচিকিৎসক নিযুক্ত হন। সুলতান আবু ইয়াকুবের অনুগ্রহ হইতে কিন্তু তিনি কখনও বঞ্চিত হন নাই। ৫৮০ হিজরীতে তাঁহার মৃত্যু হওয়ার তদীয় পুত্র আবু ইউসুফ ইয়াকুবের সহিতও ইব্নে তুফায়লের বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ন থাকে। ৫৮১ হিজরীতে (১১৮৫ খৃঃ) তিনি পরলোক গমন করেন। সুলতান নিজেও তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করিয়াছিলেন।

সুপ্রসিদ্ধ দার্শনিক উপন্যাস “হাই ইব্‌নে ইয়ক্জান” ইব্‌নে তুফায়ল প্রণয়ন করিয়াছেন। মধ্যযুগে লিখিত পুস্তকাবলীর মধ্যে এখানা অতীব উৎকৃষ্ট পুস্তক। তাঁহার লিখিত তেমন আর কোনও পুস্তকের খবর জানা যায় নাই। তবে তিনি চিকিৎসা সম্বন্ধেও দুইখানা পুস্তক রচনা করিয়াছিলেন। ইব্নে রুশ্‌দ্‌ ও প্রসিদ্ধ জ্যোতির্ব্বিদ আল্-বিত্‌রুজী টলেমীর epicycles এবং eccentric circles-এর মত খণ্ডন করিয়া পুস্তক প্রণয়ন করিয়াছিলেন। সেই পুস্তকের ভূমিকায় লিখিয়াছেন, তিনি ইব্‌নে তুফায়লের মতেরই অনুসরণ করিতেছেন।

ইব্‌নে তুফায়ল তদীয় দার্শনিক উপন্যাসে মধ্যযুগের Neo-Platonic মতের আধ্যাত্মিক আকারটাই বিশেষরূপে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। তাঁহার বর্ণনা প্রণালী যেমনই উন্নত তেমনই শিল্পকলায় পরিপূর্ণ। তিনি দেখাইয়াছেন একটি লোক শিশুকাল হইতে জনমানবহীন দ্বীপে রহিয়াছে। ক্রমশঃ তাহার মনে কল্পনারাশি জাগিয়া উঠে এবং কেবল বিচারশক্তির বলে সে দর্শনের আবিষ্কার করে। তারপর সে তাহার নিজের জন্য মোস্‌লেম দর্শন গঠন করিয়া লয়। এই লোকটিকে বিচারশক্তির সিম্বল বা প্রতিরূপ হিসাবে দেখান হইয়াছে, আর তাঁহার নাম রাখা হইয়াছে—হাই (জীবিত) ইব্‌নে ইয়ক্জান (জাগ্রতের পুত্র)। গল্পের শেষাংশে সালামান ও আসল (কোথাও বা আবসাল) এই দুইটি রূপক নামের উল্লেখ আছে।

হাই, সালমান, আসল বা আবসাল—এই নামগুলি দার্শনিক সাহিত্যে নূতন নহে। আবু আলী সিনা (Avicenna) “হাই ইব্‌নে ইয়ক্‌জান” নামক একখানা রূপক পুস্তক পূর্ব্বেই রচনা করিয়াছিলেন; নাসির উদ্দীন তুসী ও জামী তাঁহাদের নিজ নিজ গ্রন্থে সালামান ও আবসাল এই দুইটি রূপক নামের ব্যবহার করিয়াছেন। সালামান ও আবসাল বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন অভিনয় করিয়াছেন বটে কিন্তু তাহাদের নামের ব্যবহার সর্ব্বত্রই রূপক। তাহারা সর্ব্বত্রই “বাস্তব জগতের সহিত যুদ্ধলিপ্ত মানব-বিচারশক্তি” রূপে প্রদর্শিত হইয়াছে। ইব্‌নে তুফায়লের উপন্যাসের বিষয় সংক্ষেপে এইরূপ:—

গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি মোস্‌লেম দর্শনের এক ইতিহাস প্রদান করিয়াছেন। ইহাতে তিনি তাঁহার পূর্ব্ববর্ত্তিগণের বিশেষ করিয়া আবু আলী সিনা, ইব্নে বাজ্জা এবং ইমাম গাজ্জালীর প্রশংসা করিয়াছেন। দর্শনের উদ্দেশ্য—তিনি বলিয়াছেন—আল্লাহ্তাআলার সান্নিধ্যলাভ। অর্থাৎ আনন্দের ও অবারিত দর্শনশক্তির এমন এক অবস্থায় উপনীত হওয়া যেখানে সত্য ব্যাপ্তিগ্রহের (deduction) কায়দা দ্বারা নির্ণীত না হইয়া প্রত্যক্ষ উপলব্ধ হয়। তারপর গল্পটি বর্ণিত হইয়াছে। এখানে সামান্য মাত্র বিবরণ দেওয়া হইলঃ—

এক জনমানবহীন দ্বীপে পুরুষের সংসর্গ ব্যতিরেকে একটি বালক জন্মগ্রহণ করিয়াছে কিংবা কোনও নিকটবর্ত্তী দ্বীপে কোনও রাজকুমারী কর্ত্তৃক সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হইয়া স্রোতের বেগে সেই দ্বীপে ভাসিয়া আসিয়াছে। এখানে ঈষৎ উত্তাপ সহকারে মৃত্তিকার স্ফূটন দ্বারা যে স্বতঃপ্রজনন সম্ভবপর তাহা বিশেষরূপে আলোচিত হইয়াছে। একটি হরিণী বালককে খাওয়াইতে আরম্ভ করে এবং তাহার প্রথম শিক্ষয়িত্রী হয়। কিছু বড় হইয়া বালক দেখিতে পাইল যে সে উলঙ্গ ও নিরস্ত্র,—তাহার দৃষ্টিপথে পতিত অন্যান্য জন্তুদিগের মত সে নহে। সে নিজেকে গাছের পাতা দ্বারা ঢাকিয়া লইল এবং অস্ত্রস্বরূপে একটি লাঠি ধারণ করিল। ইহাতে সে বুঝিতে পারিল তাহার হাতের বিশেষত্ব কতটুকু। তারপর সে শিকার করিতে আরম্ভ করিল, তাহার কৌশলেরও আর উন্নতি হইল অর্থাৎ সে সামান্য বৃক্ষপত্র পরিত্যাগ করিয়া ঈগলের চর্ম্মদ্বারা দেহাবৃত করিল। ইতিমধ্যে যে হরিণী তাহাকে লালন পালন করিয়াছিল উহা জরাজীর্ণ ও রুগ্ন হইয়া পড়িল। ইহাতে তাহার অস্বস্তি বোধ হইতে লাগিল। সে ইহার কারণানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইল। নিজেকে বুঝিতে চেষ্টা করিয়া সে তাহার অনুভবশক্তির বিষয় জানিতে পারিল। তাহার বুকের ভিতরে ব্যথা অনুভব করায় ধারাল পাথরের দ্বারা জন্তুটির বক্ষদেশ চিরিয়া দেখার ধারণা তাহার মনে উদয় হইল। এইরূপ পরীক্ষার দ্বারা সে হৃৎপিণ্ড ও ফুস্‌ফুসের বিষয় অবগত হইল। এতদ্বারা তাহার আর একটি অদৃশ্য জিনিসের বিষয়ও প্রথম ধারণা জন্মিল—যে জিনিসটি সে বুঝিল চলিয়া গিয়াছে কিন্তু জন্তুর স্বাভাবিক অবস্থাটা বজায় রাখার জন্য উহা দেহাপেক্ষা অধিকতর প্রয়োজনীয়। তারপর হরিণীর দেহ যখন পচিতে আরম্ভ করিল হাই দাঁড়কাকের নিকট হইতে শিক্ষা পাইল, কিরূপে উহা সমাহিত করিতে হইবে।

একদা বৃক্ষের শাখায় শাখায় ঘর্ষণে অগ্নি উৎপন্ন হইয়া শুষ্কবৃক্ষ জ্বলিয়া উঠায় তাহার নিকট অগ্নি আবিষ্কৃত হইয়া পড়িল। সে এই আগুন তাহার থাকিবার জায়গায় আনিয়া রক্ষা করিল। ইহার পর সে আবার ভাবিতে লাগিল এই দৃশ্য অগ্নি ও তাহার পূর্ব্বানুভূত প্রাণিদেহের উত্তাপের কথা। পরীক্ষার্থ সে প্রাণিদেহ ব্যবচ্ছেদ করিতে লাগিল। তাহার নৈপুণ্য আরও বৃদ্ধি পাইল; সে নিজেকে চর্ম্মদ্বারা পরিহিত করিতে লাগিল, পশম ও মসিনা হইতে সূতা কাটিতে এবং সূচ প্রস্তুত করিতে শিখিল। বাবুই পক্ষী তাহাকে শিক্ষা দিল, কিরূপে গৃহনির্ম্মাণ করিতে হইবে। সে শিকারী পক্ষীকে তাহার জন্য শিকার করিতে শিক্ষা দিল এবং নিজে পাখীর ডিম ও গো-মহিষাদি পশুর শৃঙ্গের ব্যবহার করিতে শিখিল। উপন্যাসের এই অংশটা বড়ই চিত্তাকর্ষক এবং নিপুণ হস্তের সুবিন্যস্ত বিশ্বকোষ বিশেষ।

তাহার জ্ঞান উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া দর্শনে (Philosophy) পরিণত হইল। বৃক্ষলতা, খনিজ পদার্থ, এই সমস্তের স্বাভাবিক গুণ এবং প্রাণীর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহারের বিষয় অধ্যয়ন করিয়া হাই এই সমুদায়কে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া লইল। সে জিনিসসমূহের লঘুত্ব ও গুরুত্ব হিসাবেও বিভাগ করিয়া ফেলিল। অতঃপর হাই পুনরায় জীবনীশক্তি সম্বন্ধে ভাবিয়া তাহা হৃৎপিণ্ডের মধ্যে অনুভব করিল। তাহা হইতে সে প্রাণীর ধারণা ও বর্দ্ধনশীল আত্মার (Soul) বিষয় কল্পনা করিয়া হইল। অতঃপর সে মৌলিক পদার্থসমূহের অনুসন্ধান করিয়া চারিটি পদার্থ প্রাপ্ত হইল। মাটি পরীক্ষা করিতে করিতে পদার্থের ধারণা তাহার মনে উদয় হইল এবং ইহাও তাহার মনে বদ্ধমূল হইল যে দেহসমূহ বিভিন্ন পরিসরের পদার্থ মাত্র। জলকে বাষ্পে পরিণত হইতে দেখিয়া, এক জিনিস যে অন্য জিনিসে পরিবর্ত্তিত হইতে পারে ইহা তাহার নিকট আবিষ্কৃত হইয়া পড়িল। ইহাও সে বুঝিতে পারিল যে প্রত্যেক নবীন সৃষ্টদ্রব্যের গোড়ায় অবশ্য একটা কারণ থাকিতে পারে যাহা হইতে দ্রব্যটির সৃষ্টি হইয়া থাকে। এইরূপে সাধারণভাবে তাহার মনে স্রষ্টার ধারণা বদ্ধমূল হইল।

এই সময় হাইর বয়স ২৮ বৎসর হইয়াছিল। এখন হইতে সে আকাশ সম্বন্ধে চিন্তা করিতে লাগিল। সে নিজের মনে প্রশ্ন করিতে লাগিল আকাশটা অসীম কিনা কিন্তু ইহা তাহার নিকট অসম্ভব বলিয়া বোধ হইল। সে ইহাকে গোলাকার বলিয়া কল্পনা করিল। তাহার পর্য্যবেক্ষণে চন্দ্র ও গ্রহের অবস্থান জন্য বিশেষ চক্রের প্রয়োজন অনুভূত হইল। প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টার প্রয়োজনও সে বুঝিতে পারিল। সে স্রষ্টা শরীর বিশিষ্ট নহে যে শরীরের ভিতর বিশ্বের চালিকাশক্তি (Motive power of the world) নিহিত—পরন্তু সে অনন্ত, অক্ষয়। আল্লাহ্ সম্বন্ধে ধারণার উন্নতি করিতে যাইয়া সে স্বভাবজ প্রাণীদিগের সহিত তুলনা করিয়া তাঁহার গুণাবলী অনুমান করিয়া লইল। তাহার নিকট আল্লাহ্ স্বাধীন ইচ্ছাসম্পন্ন, সর্ব্বজ্ঞ, জ্ঞানময়, দয়াময় ইত্যাদি ইত্যাদি। সে নিজের আত্মা সম্বন্ধে বিবেচনা করিতে যাইয়া মীমাংসা করিল যে উহা অবিনশ্বর। ইহাও সিদ্ধান্ত করিল যে সেই সর্ব্বগুণান্বিত সত্তার ধ্যানদ্বারা তাহার সুখ ও আনন্দ লাভ করা উচিত। এই আনন্দ কেবলমাত্র স্বর্গীয় গুণাবলীর অনুকরণ করিয়া অর্থাৎ নিজেকে ঘোর তপস্যায় লিপ্ত করিয়া পাওয়া যাইতে পারে। ইহার পর হাই নিজেকে ধ্যান-ধারণার ভিতর ডুবাইয়া দিল। এইরূপে তাহার জীবনের ৪৯ বৎসর অতীত হইয়া গেল।

তারপর পার্শ্ববর্ত্তী দ্বীপ হইতে আসল নামক প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম্মের জনৈক অনুসরণকারী আসিয়া উপস্থিত হইল। এই দুইটি লোক পরস্পরকে যখন বুঝিতে আরম্ভ করিল তখন ‘হাই’ এর নিকট প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম্ম মূলত তাহার দার্শনিক বিশ্বাসের সহিত তুলনায় একই বলিয়া প্রমাণিত হইল। আসলও তখন বুঝিতে পারিল যে এই উদাসীন যে মত পোষণ করিতেছে তাহা তাহারই ধর্ম্মের, সাধারণভাবে প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম্মসমূহের অত্যুৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা মাত্র। পার্শ্ববর্ত্তী দ্বীপে সালামান নামক এক রাজা ছিল। আসল ছিল তাহার মিত্র ও মন্ত্রী। এই রাজার নিকট হাই-এর দর্শনের ব্যাখ্যা করার জন্য আসল তাহাকে তথায় লইয়া গেল। কিন্তু তাহার দর্শন কেহ বুঝিল না। কয়েকবার বৃথা চেষ্টা করিয়া আসল ও হাই সেই বিজন দ্বীপে ফিরিয়া আসিয়া ধ্যানমগ্ন হইল। ওদিকে লোকগণ তাহাদের মূর্ত্তি ও সিম্বল লইয়া ব্যস্ত হইল।

এই অত্যাশ্চর্য্য উপন্যাসে দর্শনের তত্ত্বের দিকটার (mystic side) সহিত ধর্মের কতদূর সম্বন্ধ রহিয়াছে তাহা অতীব বিশদরূপে বর্ণিত হইয়াছে। ইব্‌নে তুফায়লের উপন্যাস মুসলমানদের নিকট যথেষ্ট আদর লাভ করিয়াছে। বহু ভাষায় ইহার অনুবাদও প্রকাশিত হইয়াছে।

 

মোজাফ্‌ফর আহ্‌মদ

 

[Dr. Carra De Vaux-এর ইংরেজী হইতে সঙ্কলিত।]

 

দোহাই

১. Mustafa Akyol, `The Muslims Who Inspired Spinoza, Locke and Defoe,’ The New York Times, April 5, 2021;

https://www.nytimes.com/2021/04/05/opinion/enlightenment-islam-robinson-crusoe.html

২. বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা, বর্ষ ২য় সংখ্যা ৪র্থ, মাঘ ১৩২৬ (পৃ. ৩১৯-৩২৩) ॥