মুক্তি চেয়েছিলাম, ‘চিরমুক্তি’ নয়

কবির য়াহমদ প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১, ০৪:২৬ পিএম মুক্তি চেয়েছিলাম, ‘চিরমুক্তি’ নয়

শর্তহীন বেঁচে থাকার অধিকার আমার, আমাদের। মুশতাকের ছিল, কিশোরের আছে। বেঁচে থাকার সেই অধিকার হারিয়েছেন মুশতাক। কারাগারে মারা গেছেন তিনি। মুশতাক আহমেদের পরিচিতি ছিল উদ্যোক্তা হিসেবে, লেখক হিসেবে। নিজস্ব পরিমণ্ডলে তিনি যেভাবেই পরিচিত থাকুন না কেন তার পরিচয় রাষ্ট্র হয়েছিল ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগের গ্রেপ্তারের পর। এই অভিযোগ করেছিল র‍্যাব। বিভিন্ন বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের পর সাধারণ সাদাসিধে জীবনের অনেকেই এমন নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। অনেকের বিরুদ্ধে বাহিনীগুলোর অভিযোগ শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হয় না। মুশতাকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি, মৃত্যুর পর সব প্রমাণের ঊর্ধ্বে ওঠে গেছেন তিনি। অভিযোগের পর্যায়েই থেকে গেছে সকল অভিযোগ, প্রমাণ হয়নি, আবার অভিযোগ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক অব্যাহতিও পাননি তিনি। দীর্ঘসূত্রিতার যে ধারা বিচারের, তদন্তের তার বলি হয়েছেন তিনি। মৃত্যুর আগে আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেনি; র‍্যাবের অভিযোগ ছিল, পুলিশের অভিযোগ ছিল এবং ও পর্যন্তই!

মুশতাক আহমেদ কীভাবে মারা গেছেন এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠেছে। হয়ত স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তার, নয়ত নির্যাতনের কারণে ধুঁকে ধুঁকে মরেছেন তিনি। তবে তিনি যে অসুস্থ ছিলেন সেটা তার আইনজীবীরা জামিন চাওয়ার সময়ে আদালতকে জানিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর গণমাধ্যমকে ফের জানিয়েছেন। স্বাভাবিক বিচারিক প্রক্রিয়ায় তিনি জামিন পেতে পারতেন, পাননি। ছয়-ছয়বার আবেদন করেও জামিন পাওয়া হয়নি তার। স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়ার বাইরে তার অসুস্থতা ‘মানবিক কারণ’ হতে পারেনি জামিনের। অসুস্থতাসহ বিবিধ ‘মানবিক কারণে’ জামিন হয় অনেকের। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতের সকল পর্যায়েই এই ‘মানবিক’ প্রসঙ্গের চল আছে। তবু তার ক্ষেত্রে এসবের কিছুই ঘটেনি। মৃত্যুর আগের দিনও তার জামিনের আবেদন করেছিলেন আইনজীবী, কিন্তু সেটাও আগের পাঁচবারের মতো নামঞ্জুর হয়েছিল।

কেন হয়েছিল এমন, প্রশ্ন জাগছে। এমন তো না এই মামলায় গ্রেপ্তার অন্যদের কেউ জামিন পাননি। একই মামলায় গ্রেপ্তার দিদারুল ভূঁইয়া ও মিনহাজ মান্নান এর আগে জামিন পেয়েছেন। শুধু জামিন পাননি মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। কিশোরও অসুস্থ বলে জানিয়েছে তার পরিবার। তার এই অসুস্থতাও উদ্বেগের পর্যায়ে। তারও জামিন মিলছে না। তাদের এই জামিন না পাওয়ার বিষয়টি কি স্রেফ আইন-আদালতের বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকছে? এখানে কি অন্যায় কোনো হস্তক্ষেপ আছে? হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গ অবিশ্বাস করতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু সেটা পারছি না। কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার অনেকেই যে হয়রানির শিকার হয়েছেন, সেগুলোর সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে কিশোর-মুশতাক নামগুলো। কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের সঙ্গে যে আচরণ হয়েছিল সেটা কেবল আইন-আদালতের বিষয়ের সীমাবদ্ধ ছিল না, এর সঙ্গে প্রভাবশালী অনেকের স্বার্থ ও প্রভাবের যোগ ছিল।

মূলত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তারা কেবল আইন-আদালতকেই সামলাচ্ছেন না, আরও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাবকেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাদের। অভিযোগের পর্যায়ে যখনই সরকারবিরোধী গুজব, ষড়যন্ত্র শব্দগুলো যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে সেখানে কোনো কিছু আর স্বাভাবিক থাকছে না। কিশোর-মুশতাকের মামলা ও মুশতাকের পরিণতি এর বাইরের কিছু নয় বলেই ধারণা করি। একই মামলায় একাধিক আসামি জামিনের নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা পেলেও কিশোর-মুশতাক সেটা পাননি। পাননি বলে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু দিয়েই ‘চিরমুক্তি’ ঘটেছে মুশতাক আহমেদের। আর কার্টুনিস্ট কিশোরের শারীরিক যে অবস্থা, তাতে তিনিও শঙ্কার বাইরে নন।

শুরু থেকেই অধিকার বিষয় সচেতন নাগরিকেরা এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতা করে আসছেন। তথ্য প্রযুক্তি আইনের সাতান্ন ধারার অপব্যবহারের পর সরকার সেই আইন বিলুপ্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে ধারাগুলো যুক্ত করেছে, সেটা পূর্বতন সেই কালাকানুনের প্রতিনিধিত্ব করছে। আগের মতো একইভাবে অপপ্রয়োগ করে চলেছে সরকার। এতে করে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে মানুষের। বিতর্কিত এই আইনে গত বছর আসামি করা হয়েছে সাড়ে চার শতাধিক লোককে, মামলা হয়েছে প্রায় দুইশটি। আর্টিকেল-১৯-এর প্রতিবেদনের এই তথ্যের বাইরে আরও অনেক ঘটনা নিশ্চয়ই রয়েছে, যা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়নি কিংবা কোনো মিডিয়ায় প্রকাশ হয়নি। এর আগের বছরের এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা ছিল ষাটের কিছু বেশি। অর্থাৎ দিন দিন বিতর্কিত এই আইনের অপব্যবহার ও বহুল ব্যবহার হচ্ছে।

তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা দিয়ে আগে সরকার মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছিল, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী এই আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মানুষদের হয়রানি করেছিল। বিতর্কের মুখে সেই ধারা বাতিল হলেও এখন পুরনো ধারাগুলো নতুন নামে এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। আগের মতো এখানেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে আরও বেশি নিবর্তনমূলক ভূমিকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এখানে লেখক মুশতাক আহমেদকে প্রাণ দিতে হয়েছে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। একই পথে হাঁটছেন কার্টুনিস্ট কিশোরও। একের পর এক জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে মুশতাক-কিশোরের। রাষ্ট্র প্রাণ নেবে তবু জামিন দেবে না মুশতাক-কিশোরকে।

ছয়বার জামিন চেয়ে পাননি মুশতাক। সপ্তমবারের মতো আর জামিন চাইবেন না তিনি। জামিনের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন তিনি। কারাগারেও তাকে আর রাখা যাচ্ছে না, তাকে কারাগারেও রাখা যায়নি। রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে জামিন ছাড়াই তার পরিবারের কাছে তাকে ফিরিয়ে দিতে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী জীবিত গ্রেপ্তার করেছিল মুশতাককে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জীবিত মুশতাককে জেলে পুরেছিল; কথা ছিল সেই মুশতাক জীবিতই থাকবেন। কিন্তু সে কথা রাখতে পারেনি রাষ্ট্র। তাকে তিলে তিলে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রাণ নিয়েই থেমেছে মুশতাককে। তার ভয়াল থাবা এবার কিশোরের দিকে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের কালাকানুন বাতিলের দাবি নতুন নয়। এই আইন শুরুর সময় থেকেই আমরা এর প্রতিবাদ করছি, এখনও করছি। এই কালাকানুন বাতিল করুন। এই আইনের বলি হয়েছেন মুশতাক। এই মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রের, সরকারের, র‍্যাবের, পুলিশের; এই মৃত্যুর দায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত সকলের, এই মৃত্যুর দায় জামিনের আইনি অধিকারের পথে বাধা হয়ে থাকা সকলের। কেউ এই মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না, শেকড় থেকে শিখরের কেউ না। মুশতাক হত্যায় আমরা সংক্ষুব্ধ, কিশোরকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। মুশতাককে ফেরত পাওয়া যাবে না আর, তিনি ইতিহাস হয়ে গেছেন। এই লজ্জার ইতিহাস সরকারের, হাহাকারের ইতিহাস আমাদের। এ ইতিহাসে আর কোনো নাম যুক্ত না হোক এটাই চাওয়া আমাদের।

কার্টুনিস্ট কিশোরকে মুক্তি দিন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করুন; এটাই হতে পারে আপাত অনুশোচনাজনিত দায়িত্বশীলতা!

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক