• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০১৯, ০৯:৫৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২২, ২০১৯, ০২:৫৩ পিএম

ডোপ টেস্ট ব্যতীত চালকদের স্টিয়ারিং নয়

ডোপ টেস্ট ব্যতীত চালকদের স্টিয়ারিং নয়

গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে চালকদের ডোপ টেষ্ট (ড্রাগ টেস্টিং) বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। ডোপ টেষ্ট ব্যতীত কোন চালক গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসতে পারবেন না। ডোপ টেষ্টে উত্তীর্ণ হলে ওই ব্যক্তি একজন প্রকৃত এবং নিরাপদ গাড়িচালক হিসেবে বিবেচিত হবেন। মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) রাজধানীর নর্দ্দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার নিহতের পর থেকেই নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর প্রধান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ও ব্যবসায়ী সমিতির কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন এবং পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এমনই মন্তব্য করেছেন।

ব্যবসায়ী সমিতির নেতা হেলাল উদ্দিন বলেন, সম্প্রতি একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ লোকজনের প্রাণহানি ঘটছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গাড়ি চাপায় মানুষের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হচ্ছে। পুলিশের তদন্তের অনেক রিপোর্টই চালকের অতিরিক্ত মাদক সেবন, অনিদ্রাকে দায়ী করা হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর লক্ষে সড়ক ও মহাসড়কে গাড়ি চালকদের ডোপ টেষ্ট করানো উদ্যেগ নেয়া হচ্ছে।

  সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সময় ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হলেও গাড়ি চালকদের ক্ষেত্রে ডোপ টেষ্ট করা হচ্ছে না। যার কারণে গাড়িচালকরা মাদক সেবন করে গাড়ি চালাচ্ছেন। এরফলে সড়ক ও মহাসড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে

গত বছর আগষ্টে বিমানবন্দর সড়কের এমইএস এলাকায় জাবালে নূর পরিবহনের বাস প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে লোকজনকে চাপা দেয়। এ ঘটনায় রমিজ উদ্দিন কলেজের ২ শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে মারা যায়। পুলিশের তদন্তে চালকের গাঁজা সেবন ও অনিদ্রার বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের অবরোধ ও বিক্ষোভের ফলে রাজধানীসহ সারাদেশ অচল হয়ে পড়ে। প্রশাসন ও পুলিশ যৌথভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়। কয়েকদিন যেতে না যেতে পুরনো চেহারায় ফিরে যায় রাজধানীর রাজপথ।

মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) সকালে রাজধানীর প্রগতি সরণিতে সুপ্রভাত পরিবহনের বাসের চাপায় মৃত্যু হয় বিইউপি শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে চাপা দেয়া সু-প্রভাত বাসের চালক সিরাজুল ইসলাম নিয়মিত গাঁজা সেবন করতেন। গাঁজা ছাড়া তিনি গাড়ি চালাতে পারেন না। মূলত গাঁজা খেয়ে ও সারা রাত না ঘুমিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এসব তথ্য দেয় বাসচালক সিরাজুল।

সিরাজুল বলেন, সারা রাত না ঘুমিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। না ঘুমানোর কারণে মাথা ঠিক ছিল না। প্রথমে একটি মেয়েকে গাড়ি চাপা দেই। এর থেকে বাঁচার জন্য আরও দ্রুত গাড়ি চালাতে থাকি। মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিল। একটু দূরে আরেক জনকে (আবরার) গাড়ি চাপা দেই। গাড়ির চাকা তার মাথার ওপর দিয়ে যায়।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চললেও মাদকাসক্তদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যক্রমে গতি নেই। ডোপ টেস্ট বা পরীক্ষা পুরোপুরি চালু না করায় সরকারি চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবহন সেক্টরে গাড়িচালকসহ বিভিন্ন পেশায় থাকা মাদকাসক্তরা শনাক্ত হচ্ছে না। মাদকাসক্তরা সহজে চাকরিতে ঢুকে পড়ছে। কোনও পরীক্ষা ছাড়াই পরিবহন মালিকরা গাড়ি চালাতে সম্মতি দিচ্ছে। যদিও নতুন মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে সন্দেহভাজন সবাইকে ডোপ টেস্ট করা যাবে এমন বিধান করা হয়েছে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সময় ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হলেও গাড়ি চালকদের ক্ষেত্রে ডোপ টেষ্ট করা হচ্ছে না। যার কারণে গাড়িচালকরা মাদক সেবন করে গাড়ি চালাচ্ছেন। এরফলে সড়ক ও মহাসড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এতোদিন ডোপ টেস্ট চালু করা না হলেও এবার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের আদলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ভর্তিতেও ডোপ টেস্টের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। সরকারি চাকরিতে কীভাবে মাদকাসক্তদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডোপ টেস্ট করা হবে।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, মাদকাসক্তদের চাকরিতে নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, গাড়ি চালনার লাইসেন্সসহ বিভিন্ন সুবিধা থেকে বাদ দিয়ে আইনের আওতায় আনা হলে মাদকের প্রতি সবার ভয় জন্ম নেবে। এতে মাদকের চাহিদাও কমবে। পাশাপাশি সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি অনেকটা কমে যাবে।
 
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী জানান, গত ৫ ডিসেম্বর সব শ্রেণির সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, গাড়ি চালকসহ সব শ্রেণির সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় বিদ্যমান অন্যান্য ব্যবস্থার সঙ্গে ডোপ টেস্ট অন্তর্ভুক্ত করে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে প্রতিবেদন পরিচালকের (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) কাছে পাঠাতে হবে।

ডোপ টেস্ট পজিটিভ হলে ধারা ৩৬(৪) অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মাদক সেবনের জন্য আদালত তাকে যে কোনো মাদকাসক্ত চিকিৎসা কেন্দ্রে তার নিজস্ব অথবা পরিবারের ব্যয়ে চিকিৎসার জন্য পাঠাবেন। যদি ওই ব্যক্তি নিরাময় কেন্দ্রে যেতে না চান তাহলে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের কথাও বলা হয়েছে

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও গাড়ি চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সময় ডোপ টেস্টের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) সক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। একই সঙ্গে চালকদের ডোপ টেস্টের বিষয়ে পুলিশকে সরঞ্জাম সরবরাহের পরামর্শ দিয়েছে। কারণ পুলিশই সব সময় রাস্তায় চেকপোস্ট পরিচালনা করে। এ ছাড়া পুলিশ ও ডিএনসিসহ কয়েকটি সংস্থায় নিয়োগের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট সীমিতভাবে কার্যকর হলেও শনাক্ত ব্যক্তিদের আইন অনুযায়ী নিরাময়কেন্দ্র কিংবা জেলে পাঠানো হচ্ছে না। পুলিশ, জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য খাত এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মাদক গ্রহণের অভিযোগ ওঠার পরই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করে। এরইঅংশ হিসেবে গত ২৫ ডিসেম্বর কার্যকর করা হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮। এ আইনের ২৪-এর উপধারা ৪-এ বলা হয়েছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি শনাক্ত করবার প্রয়োজনে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ডোপ টেস্ট করা যাবে। ডোপ টেস্ট পজিটিভ হলে ধারা ৩৬(৪) অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। ৩৬ ধারার ৪ উপধারায় বলা আছে যে- অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মাদক সেবনের জন্য আদালত তাকে যে কোনো মাদকাসক্ত চিকিৎসা কেন্দ্রে তার নিজস্ব অথবা পরিবারের ব্যয়ে চিকিৎসার জন্য পাঠাবেন। যদি ওই ব্যক্তি নিরাময় কেন্দ্রে যেতে না চান তাহলে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের কথাও বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, চালকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যেও মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুও হার বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা বিঘ্ন হচ্ছে ও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

গত মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) সকাল ৭টার দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন প্রগতি সরণি এলাকায় সু-প্রভাত (ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৪১৩৫) বাসের চাপায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদ ও মাদকাসক্ত চালকের শাস্তির দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ এবং বিক্ষোভে রাজধানী অচল করে দেয়। অবশেষে ঢাকা  উত্তরের মেয়র ও পুলিশ কমিশনারের জরুরি বৈঠকে দাবি বাস্তবায়নের সুযোগ দানে আগামী ২৮ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত করে।

এইচএম/বিএস/এসএমএম