• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০১৯, ০৯:৫১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ৩১, ২০১৯, ০৩:৫১ এএম

পুরান ঢাকার মৃত্যুফাঁদ ‘কেমিক্যাল গুদাম’ বহালই আছে!

পুরান ঢাকার মৃত্যুফাঁদ ‘কেমিক্যাল গুদাম’ বহালই আছে!
পুরান ঢাকার নিমতলীতে ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছে কেমিক্যাল  - ছবি : জাগরণ

অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন এখনও পুরোপুরি সরেনি। রাত গভীর হতেই কেমিক্যালের ড্রাম বোঝাই ট্রাক একে একে ঢুকছে নিমতলী, মাজেদ সরদার রোড (নতুন রাস্তা) বংশাল, নাজিমউদ্দিন রোডসহ বিভিন্ন স্থানে। এগুলোর পিছু নিচ্ছে পুলিশের রাত্রিকালীন টহল টিম। মাসোয়ারা নিয়ে টিমের সদস্যরা ফিরে যাচ্ছেন গন্তব্যে। এক্ষেত্রে পোশাকধারী পুলিশের চেয়ে সাদা পোশাকে থাকা টিমের তৎপরতা খুব বেশি বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর চকবাজারে চুরিহাট্টার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, এলাকার ওয়াহেদ ম্যানসনের দোতলায় থাকা বডি স্প্রে ও পারফিউমের গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের ৩২টি ইউনিট রাত ৩টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন লোক প্রাণ হারান। ঘটনাস্থলে বিভিন্ন গুদামে রক্ষিত মারাত্মক দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের কারণেই ভয়াবহ এ ঘটনা ঘটে। এরকম আরো কিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হিমশিম খেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষকে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অগ্নিকাণ্ডের কোনো ঘটনা ঘটার পর শুরু হয় কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণের অভিযান। কয়েকদিন গেলেই সব শেষ। এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলছে রাজধানীর পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডউনগুলো। এ যেন এক ধরনের চোর-পুলিশ খেলা চলে এই গুদামগুলো ঘিরে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক হিসাবে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসা-বাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে। যেকোনো সময় আবারো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কার কথা বলছে ফায়ার সার্ভিস।

পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাসা-বাড়ি ঘুরে দেখা গেছে, অনেক আবাসিক ভবনের নিচতলার পার্কিং স্পেস ব্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিক গুদাম হিসেবে। কিছু বাড়িতে রাসায়নিক পণ্যের কারখানাও আছে। প্রকাশ্যে এসব গুদাম থেকে কেমিক্যাল আনা-নেয়া করছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে কর্তৃপক্ষ বা গুদাম মালিক- কেউই আইন মানছেন না।

এদিকে উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে দূষণ সহায়ক শিল্প-কারখানা চলছে রাজধানীর হাজারীবাগে। এলাকাজুড়ে বিক্রি হচ্ছে চামড়া প্রক্রিয়াকরণে প্রয়োজনীয় সব ধরনের রাসায়নিক। অবাধে ব্যবসা করছে শতাধিক রাসায়নিকের দোকান। নিয়মিত চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে আমদানি করা রাসায়নিকবাহী ট্রাক আনলোডও হচ্ছে এখানে। শ্রমিকরা বলেন, বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল আছে এখানে। তবে কী কেমিক্যাল তা বলতে পারব না।

স্থানীয়রা বলেছেন, প্রতিটি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় আড়াইশ। কারখানায় প্রবেশের বিষয়টি নিষিদ্ধ থাকায় কী ধরনের কর্মকাণ্ড চলে এসব কারখানায় তা দেখার উপায় নেই। তবে চলমান দূষণের সবচেয়ে বড় সাক্ষী হাজারীবাগের সুয়েরেজ লাইনগুলো। রাসায়নিক মিশ্রিত বিভিন্ন রঙের দূষিত পানির অস্তিত্ব।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, রাসায়নিক প্রয়োজন হয় এমন কোনো কাজ আমরা করছি না। দুই চারটি কারখানায় রাসায়নিক ব্যবহার হতে পারে। কিন্তু রঙ বের হওয়ার কথা নয়। তবে এ বক্তব্যকে শুধু অজুহাত হিসেবেই দেখছেন পরিবেশবিদরা। শিগগিরই কারখানাগুলো সিলগালা করার আহ্বান তাদের। 

পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, বড় ব্যবসায়ীরা আইন অবজ্ঞা করছে না। কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তা করছে। তারা রাতারাতি ধনী হতে চায়। এদের কৈফিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়। সংবিধানে রয়েছে, প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে, যারা প্রকৃতি নষ্ট করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। 

পুরান ঢাকার এসব গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইলসহ ভয়ঙ্কর রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ। এসব রাসায়নিক সামান্য আগুনের স্পর্শ পেলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই এখানে মানুষ বসবাস করছে। রাসায়নিক সংশ্লিষ্ট অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা বেশিরভাগ ঘটেছে পুরান ঢাকায়। 

ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ডিডি-অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, কেমিক্যাল গোডাউনের  শতকরা ৯৮ ভাগই অবৈধ। আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার, কামরাঙ্গীর চর, লালবাগ, ইসলামপুরসহ আশপাশের এলাকায় গুদাম ও কারখানার অধিকাংশেরই বৈধ কাগজপত্র ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন নেই। মাত্র ২ শতাংশ গোডাউনের অনুমোদন রয়েছে। 

বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম বলেন, আমরা পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্যের অনুমোদন দিই। পুরান ঢাকায় আমাদের অনুমোদিত কোনো গুদাম নেই। যেগুলো আছে সেগুলো সবই অবৈধ। 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনার পর ধারাবাহিকভাবে সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন সেখানে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালাচ্ছে। অবৈধ গুদামগুলো সিলগালা করা হচ্ছে, জরিমানা করা হচ্ছে। অনেককে জেলেও পাঠানো হচ্ছে। তারপরও আবাসিক ভবন, বাড়িতে থাকা কেমিক্যাল গোডাউন পুরোপুরি সরানো হয়নি। তবে অভিযান ধারাবাহিকভাবে চলমান রয়েছে। 

এইচ এম/ এফসি