• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১২, ২০১৯, ০৩:২৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১২, ২০১৯, ০৩:৩৮ পিএম

আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস

পদে পদে বাড়ছেই শিশুশ্রম, নেই কোনও নীতিমালা 

পদে পদে বাড়ছেই শিশুশ্রম, নেই কোনও নীতিমালা 
ঝুঁকিপূর্ণ ওয়েল্ডিং কাজে নিয়োজিত এক শিশু-ফাইল ছবি

● পরিবারের অস্বচ্ছলতার কারণে অনেক শিশু বাধ্য হচ্ছে সংসারের ঘানি টানতে

● যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ণ ও শিশু বিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি 

● বিশ্বে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু ‘শ্রম’ বিক্রি করে দিনাতিপাত করছে

দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। এরমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নিয়োজিত নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। নদী ভাঙনসহ পরিবারে আর্থিক অনটন, অশিক্ষা ও অসচেতনতাসহ নানা কারণে এর জন্য দায়ী। যুগোপযোগী নীতিমালার অভাবেই এই সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ‘আজকের শিশুকে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ হিসেবে গড়ে তুলতে ‘শিশুশ্রম’ বিষয়ক বিদ্যমান নীতিমালার আধুনিকায়নের পাশাপাশি ‘শিশু’ বিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

বয়স মাত্র ১১ পেরিয়ে ১২। এই বয়সে বই খাতা কলম নিয়ে স্কুলে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকার কথা। অথচ এই বয়সেই বিবর্ণ হয়ে গেছে তার জীবন। ভারিসব যন্ত্রের সাথে নিত্য উঠাবসা তার। রাজধানীর মোহাম্মদপুর গার্মেন্টস কোম্পানিতে কাজ করে কিশোরগঞ্জের লাল মিয়া। একই কারখানায় কাজ করেন মা ফুলভানু। আর্থিক অনটন থাকায় পড়াশোনার চেয়ে সন্তানকে নিয়ে কাজ শেখাতেই বেশি আগ্রহ লাল মিয়ার মা ফুলভানুর। 

মা ফুলভানু বলেন, অভাবের সংসার, ওর বাবা রিকশা চালায়। তার অল্প আয় দিয়ে বাসা ভাড়া করে ঢাকায় চলা মুশকিল। তাই আগেই সন্তানকে কাজ করে খাওয়া শিখাচ্ছি। বাসায় থাকলে নষ্ট হতে পারে। এজন্য কাজ শেখাচ্ছি যেন ভবিষ্যতেও ছেলেটা কিছু করে খেতে পারে।

দেখা গেছে, পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে অনেক শিশু এই বয়সে বাধ্য হচ্ছে সংসারের ঘানি টানতে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে সব শ্রেণির শিশুশ্রম বন্ধের নির্দেশনা থাকলেও পরিবহন সেক্টরসহ ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মন্তব্য, সংশ্লিষ্ট মহলের সঠিক নজরদারির অভাবেই ঝুঁকির মুখে শিশুর ভবিষ্যৎ।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর সিনিয়র প্রকল্প পরিচালক রাজিয়া শাহীন বলেন, পরিবারকে বুঝতে হবে, আজকে যে শিশু আয় করছে ভবিষ্যতে তার অবস্থা আরও খারাপ হবে, যার নেতিবাচক ফল ভোগ করবে রাষ্ট্র ও সমাজ। শিশুশ্রমিকের সংখ্যা হ্রাসে যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি শিশু বিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের পরামর্শ তার।

এসডি আরএস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচাক গোলাম মোস্তফা দৈনিক জাগরণকে বলেন, শিশুদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় নেই।নেই সঠিক নীতিমালা। এখানে এই সমস্যাটা রয়েই গেছে। সম্প্রতি শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধ করা হবে। কিন্তু তেমন কোনও নজির বা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ মাইনউদ্দিন মোল্লা সম্প্রতি এক গবেষণা পরিচালনা করেছেন। তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল- ঢাকা শহরে  অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকদের কর্ম ও জীবন। তার অনুসন্ধানমূলক গবেষণায় উঠে এসেছে নানা তথ্য।

তিনি গবেষণা করে দেখেছেন, ঢাকা শহরকেন্দ্রিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে ৫২ দশমিক ২৬ শতাংশ শিশু পায়ে আঘাত পায় বা ভেঙে গেছে। চোখে আঘাত পাচ্ছে ৩২ দশমিক ৪৬ শতাংশ শিশু। ৩১ দশমিক ৫৮ শতাংশ মাথায় আঘাত পেয়েছে। ২২ দশমিক ৮১ শতাংশ ঘাড়ে আঘাত, ২০ দশমিক ১৮ শতাংশ আগুনে পুরো শরীর বা শরীরের অংশবিশেষ পুড়েছে এবং ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু বুকে আঘাত পেয়েছে।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকদের গড় বয়স ১৪ দশমিক ৭ বছর। ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো হচ্ছে- ওয়েল্ডিং, ট্যানারি, পরিবহন (মিনিবাস ও টেম্পো হেলপার) ও ক্ষতিকর রাসায়নিক ফ্যাক্টরির কাজ। 

অধ্যাপক মোল্লার গবেষণায় দেখা গেছে, সর্বাধিক সংখ্যক (৪৪ দশমিক ১৭ শতাংশ) শিশুশ্রমিকের বয়স ১৪-১৬ বছরের মধ্যে। সবচেয়ে কমসংখ্যক (৫ শতাংশ) শিশুশ্রমিকের বয়স ৮-১০ বছরের মধ্যে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকদের মধ্যে বেশিরভাগই (৭১ দশমিক ৬৭ শতাংশ) গ্রাম বা অন্য শহর থেকে ঢাকায় এসেছে।

দেখা গেছে, দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার শিকার শিশুশ্রমিকদের মধ্যে ৮৭ দশমিক ৭২ শতাংশ চিকিৎসার সুযোগ গ্রহণ করলেও ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ কোনও ধরনের চিকিৎসা গ্রহণ করেনি।

দেশের মধ্যে শিশুশ্রমের এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার (১২ জুন) আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হতে যাচ্ছে।

শিশু অধিকার সুরক্ষা ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম সংস্থা (আইএলও) ২০০২ সাল থেকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতি বছর দিবসটি পালন করে আসছে।

এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘চিলড্রেন শুড নট ওয়ার্ক ইন ফিল্ড, বাপ অন ড্রিমস।’

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশুশ্রম বিক্রি করে দিনাতিপাত করছে। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। 

বাংলাদেশে ‘জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০১৩’ এর জরিপে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনও না কোনও শ্রমে নিয়োজিত। তাদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ১২ লাখ ৮০ হাজার। শিশুশ্রম নিরসনে সরকার ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নির্ধারণ করে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের অঙ্গীকার করেছে।

তবে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ২০১১ সালে সরকারি এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭৯ লাখ।

টিএইচ/এসএমএম