• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০১৯, ০২:৩৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১০, ২০১৯, ০২:৪২ পিএম

সারাদেশে পুলিশ নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য

অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ অর্ধশত সদস্যের শাস্তি

অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ অর্ধশত সদস্যের শাস্তি

সারাদেশে পুলিশ নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। যদিও এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যায় কিন্তু এরমধ্যে লাখ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছে পুলিশ ও তাদের ঘনিষ্ঠ জনরা। এ সকল ঘুষ বাণিজ্যসহ অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার তথ্য প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। ইতোমধ্যে পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ অর্ধশত পুলিশ সদস্যেও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এসকল পুলিশ সদস্যদের সিংহভাগ চাকরি থেকে বরখাস্ত অনত্র বদলিসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এমনকি ঘুষ কেলেঙ্কারীতে টাকাসহ ধরা পড়া একাধিক পুলিশ সদস্যেও বিরুদ্ধে ফৌজদারী আইনে নিয়মিত মামলাও করা হয়েছে। এ সংশ্লিষ্টতায় পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আটক রয়েছেন।    

এদিকে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল কুড়িগ্রামে নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তাৎক্ষণিকভাবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন কুমার মোদককে খাগড়াছড়ি, এস আই আবু তালেবকে বরিশাল রেঞ্জে বদলি করা হয়। বরখাস্ত করা হয়েছে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে হিসাব রক্ষক আব্দুল মান্নান ও উচ্চমান সহকারী ছকমল এবং রংপুর ডিএসবি’র এএসআই রুহুলকে। এছাড়া ডিআইজি অফিসে ক্লোজ করা হয়েছে স্প্রিড বোর্ড চালক  সাইদুর রহমান সায়েম ও রেশন স্টোরের ওজনদার আনিছুর রহমানকে। একই সঙ্গে প্রায় ২৩ লাখ ঘুষের টাকা উদ্ধার করে ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেছে পুলিশ।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান বিপিএম বলেন, পুলিশের কোন সদস্য নিয়োগের আর্থিক লেনদেনে জড়িত থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারিও দেন। তা সত্ত্বেও একটি চক্র পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার যোগ সাজসে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অবৈধ অর্থ লেনদেন করেন। গোয়েন্দা নজরদারীর মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে তাদেরকে শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রমাণের ভিত্তিতে এ এসপি হেডকোয়াটার (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) রিপন কুমার মোদককে খাগড়াছড়ি, আর ও এর দায়িত্বপ্রাপ্ত এস আই আবু তালেবকে বরিশাল রেঞ্জে বদলি করা হয়। ঘুষের টাকা ২৩ লাখ উদ্ধার করে বরখাস্ত করা হয়েছে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে হিসাব রক্ষক আব্দুল মান্নান ও উচ্চমান সহকারী ছকমলকে। এছাড়া ডিআইজি অফিসে ক্লোজ করা হয়েছে স্প্রিড বোর্ড ড্রাইভার সাইদুর রহমান ও রেশন স্টোরের ওজনদার আনিছুর রহমানকে। এছাড়া রংপুর ডিএসবি শাখার এএসআই রুহুলকে ১০ লাখ টাকাসহ কুড়িগ্রামে আটক করা হয়। পরে রংপুর এসপি’র হাতে তাকে হস্তান্তর করা হয়। তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

অপরদিকে জানা গেছে, মাদারীপুরে পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগে প্রায় কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে জেলা পুলিশের একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে প্রতারণার অভিযোগে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারের দেহরক্ষীসহ ২ কনস্টেবলকে আটকের পর নেয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। এছাড়া একই অভিযোগে আরও দুই কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক জেলা থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। 

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, মাদারীপুরে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে ঘুষ গ্রহণ ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় ২৪ জুন পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অপরাধীদের ধরার জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সব্র্ত কুমার হালদারের দেহরক্ষী পুলিশ সদস্য নুরুজ্জামান সুমনকে ঘুষের টাকাসহ আটক করে। এছাড়াও পুলিশ সদস্য ও পুলিশ লাইন্সের ম্যাস ম্যানেজার জাহিদ হোসেন, টিএসআই গোলাম রহমান এবং পুলিশ হাসপাতালের স্বাস্থ্য সহকারী পিয়াস বালার কাছ থেকেও ঘুষের টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে নুরুজ্জামান সুমন ও জাহিদ হোসেনকে পুলিশ সদর দপ্তরে নজরদারিতে রাখা হয়। টিএসআই গোলাম রহমান এবং পুলিশ হাসপাতালের স্বাস্থ্য সহকারী পিয়াস বালাকে মাদারীপুর জেলা থেকে অন্যত্র শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। ঘটনাটি গত সোমবার রাতে হলেও বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। কয়েক দফায় মাদারীপুর জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে এ বিষয় কথা বলতে রাজি হয়নি তারা। পরে বিষয়টি জানতে গত বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া এন্ড পিআর) সোহেল রানাকে অবগত করলে তিনি আটকের বিষয়টি স্বীকার করেন। এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার রাতে তড়িঘড়ি করে মাদারীপুর পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদার জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিষয়টি অবগত করেন।

পুলিশ আটকের বিষষয়ে মাদারীপুর সদর থানার ওসি সওগাতুল আলম জানান, পুলিশ নিয়োগের ব্যাপারে কাউকে আটক, গ্রেফতার বা অন্য কোন বিষয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে পারবো না।

ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতার। চাকরি থেকে বরখাস্ত ও জেল জরিমানার পরও থেমে নেই পুলিশ নিয়োগে ঘুষ লেন-দেন। এক শ্রেণির দালালচক্র নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে তদবির ও লাখ লাখ টাকা ঘুস লেন দেন করছে। গ্রেফতার, জেল জরিমানায়ও ঠেকানো যাচ্ছে না ঘুষ লেন দেনের। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বন্দর নগরী চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা সেজে পুলিশে চাকরি দেয়ার নামে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে দুই দালালকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন- হাটহাজারী উপজেলার ভবানীপর এলাকার সুকেন্দ বিকাশ দাশের ছেলে চিরঞ্জীব দাশ প্রকাশ রঞ্জীব (৫৬) ও কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া থানা এলাকার আলতাফ হোসেনের ছেলে দুলাল আহম্মেদ ওরফে শাহ আলম (৫৫)।

টাঙ্গাইলে পুলিশে চাকরি দেয়ার কথা বলে টাকা লেনদেনের সময় হাতেনাতে পুলিশের এক এসআইসহ দুইজনকে গ্রেফতার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। শুক্রবার রাত ৮টার দিকে টাঙ্গাইল পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে থেকে তাদের  গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন, জামালপুর সদর আদালতে কর্মরত এসআই মোহাম্মদ আলী ও জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার মো. খায়রুল বাশারের স্ত্রী শাহানাতুল আরেফিন সুমি (৩৫)। এসআই মোহাম্মদ আলী টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চৌবাড়িয়া গ্রামের মৃত ইনছান আলীর ছেলে।

গত শনিবার বিকেলে পুলিশ সুপারের সম্মেলন কক্ষে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায় জানান, শেরপুর সদর থানার তারাগড় নামাপাড়া গ্রামের ওয়াজেদ আলী তার ভাতিজা কবির হোসেনকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেবে বলে চুক্তি করে। সেই ১০ লাখ টাকা নিয়ে দুই আসামি ও ওয়াজেদ আলী গাড়িতে করে জামালপুর থেকে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হয়। গাড়িতে বসেই তারা টাকা লেনদেন করে।

জানা গেছে, টাঙ্গাইল পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে প্রাইভেটকারে ওয়াজেদ আলীকে রেখে টাকার ব্যাগ নিয়ে সুমি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যায়। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে সুমি ব্যাগ থেকে টাকা তার স্বামী কথিত সাংবাদিক খায়রুল বাশারকে দেয়। টাকা নিয়ে খায়রুল বাশার চলে যায়। বিষয়টি ওয়াজেদ আলী দেখে ফেলায় তার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। ওয়াজেদ আলী পুলিশ সুপারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে সুমি তাকে জানায়, এসপির গেস্ট এসেছে। তিনি এখন দেখা করতে পারবেন না। এরপর সুমির সঙ্গে ওয়াজেদ আলীর বাকবিতণ্ডা হয়। তখন তাদের আটক করে সুমির ব্যাগ থেকে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা, সুমির স্বামীর নামে সাংবাদিক আইডি কার্ড জব্দ করেন। সুমিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বাকি ৮  লাখ ৫ হাজার টাকা তার স্বামী খায়রুল বাশারের কাছে আছে বলে জানান। গত শনিবার ওই তিনজনের নামে প্রচলিত আইনে মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠান।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায় বলেন, পহেলা জুলাই টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনে কনস্টেবল পদে লোক নেয়া হয়েছে। সেখানে সরকারি নির্ধারিত ফি ১০০ টাকা ও ফরমের ৩ টাকার বিনিময়ে চাকরি দেয়া হবে। এ বিষয়ে অবৈধ টাকা লেনদেন করলে তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। এই ধারাবাহিকতায় অভিযুক্ত তিন জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এখানে পুলিশের এসআই মোহাম্মদ আলীকেও ছাড় দেয়া হয়নি।

অপরদিকে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে গত শুক্রবার দুপুরে দুই ভুয়া পুলিশের অবস্থান নিশ্চিত করে গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ টিম। চকবাজার গোলজার টাওয়ারের সামনে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। দুজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তারা পুলিশে চাকরি দেয়ার নাম করে ঘুষ বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। 

পুলিশ জানায়, পুলিশে চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা করে আসছিল সংঘবদ্ধ একটি প্রতারকচক্র। তাদের পাতানো ফাঁদে পড়ে ইতোমধ্যে অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। প্রতারণার খবর পেয়ে গোয়েন্দা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে।

এইচ এম/টিএফ