• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০১৯, ০৯:৫০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ১৯, ২০১৯, ১০:০৩ পিএম

বন্যা পরিস্থিতি

বিভিন্ন জেলায় নদী ভাঙন, শঙ্কায় পানিবন্দি মানুষ

বিভিন্ন জেলায় নদী ভাঙন, শঙ্কায় পানিবন্দি মানুষ
ফরিদপুরে নদী ভাঙন -ছবি : জাগরণ

দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে কোথাও কোথাও সামান্য অবনতি হলেও, সেটা নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই বলে জানিয়েছে প্রশাসন। তারা আশা করছেন অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হলে বন্যা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে কোথাও কোথাও পানি নামতে শুরু করায় নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বহু মানুষের বসতঘর, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এই বর্ষায় ভাঙনের তীব্রতা বাড়ার শঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয়রা। ভাঙন আতঙ্কে নদীপাড়ের মানুষদের কাটছে নিদ্রাহীন রাত। নদী ছাড়াও কোথাও কোথাও শহর রক্ষা বাঁধ হুমকি মুখে রয়েছে। ভাঙন রোধে প্রশাসন দিন-রাত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও ত্রাণ পাচ্ছেন না দুর্গতরা। প্রশাসন বলছে, প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ অপ্রতুল। পানিবাহিত রোগের প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে।

দৈনিক জাগরণ এর সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর—

ফরিদপুর সংবাদদাতা জানান, সদরপুর উপজেলার চরমানাইর ইউনিয়নে আড়িয়াল খাঁ নদের ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নদী পাড়ের মানুষ।

স্থানীয়দের শঙ্কা, দ্রুত নদী শাসনে স্থায়ী পদক্ষেপ না নেয়া হলে ইউনিয়নের অনেক গ্রাম এ বর্ষায়ই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

চরমানাইর ইউনিয়নের জাজিরাকান্দি ভাঙন কবলিত গ্রামের গৃহবধু কুলসুম বিবি(৬০) পৈত্রিক ভিটা নদী গর্ভে হারিয়েছেন এর আগেও। নতুন করে গড়া ভিটেতেও গত বর্ষা মৌসুমে ভাঙন শুরু হয়। এ বছর নদীতে নিয়ে যাচ্ছে সব। ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে বাড়ি ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন তিনি। চাষাবাদের জমিসহ ভিটে মাটি হারিয়ে অন্যের জমিতে কোনও রকম পরিবার-পরিজনসহ আশ্রয় নিয়েছেন কুলসুম বিবির মতো আরও অনেকেই।

এ বছর চরমানাইর ইউনিয়নের আমির খাঁর কান্দি, জাজিরাকান্দি, চরবন্দরখোলা ফাজিল মাদ্রাসা, কাজী কান্দি, আদেল উদ্দিন মোল্যার কান্দি গ্রামে ভাঙন শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত নদের ভাঙনে প্রায় দুই হাজার বিঘা ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। 

চরমানাইর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী জানান, এ বছর বর্ষার শুরুতেই নদীর পানি বৃদ্ধি হওয়ার কারণে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধের জন্য কিছু এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ ও চরবন্দরখোলা মাদ্রাসা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, নদীতে তীব্র স্রোত ও মৌসুমের শুরুতেই ঝড়ো হাওয়ার কারণে নদীতে বড় বড় ঢেউ এর সৃষ্টি হচ্ছে, আর সেই ঢেউ পাড়ে আছরে পরেই ভাঙনের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবু এহসান মিয়া জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পূরবী গোলদার জানান, নদী ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্রাথমিক ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে, ভাঙন প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্তদের স্থায়ী সহায়তা প্রদানের চেষ্টা চলছে।

জামালপুর সংবাদদাতা জানান যমুনার পানি কমতে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘন্টায় যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৮ সে.মি. কমে বিপৎসীমার ১৫৭ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও বেড়েছে বন্যা কবলিত মানুষের দুর্ভোগ। চারপাশে অথৈ পানি থাকায় ঘর থেকে বের হতে পারছে না। ঘরের মজুদ খাবারও পানিতে ভেসে গেছে। হাতে কাজ নেই, ঘরে নেই খাবার। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এবং হাটবাজার ডুবে যাওয়ায় নিত্যবেলার খাবার সংগ্রহ করতে পারছেন না। ত্রাণও কপালে জুটছে না।

বানবাসীদের ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগে জনপ্রতিনিধিরা বলছেন ইউনিয়নের সকল মানুষ পানিবন্দি। বরাদ্দ যা পাচ্ছি ২৫ ভাগ বন্যা কবলিতর মাঝে দেয়াও সম্ভব নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণেও দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ পৌঁছানো  যাচ্ছে না। 

সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা জানান,  শহররক্ষা বাঁধের হার্ডপয়েন্ট এলাকায় ফাঁটল দেখা দেয়ার শহরবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যে কোন মুহূর্তে বাঁধ ভেঙ্গে শহর ও শহরতলীর গ্রামগুলো বন্যা প্লাবিত হয়ে পড়তে পারে। নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে ভাঙনের আশঙ্কাও রয়েছে। তবে এসব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে শহরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) গভীর রাতে যমুনা নদীর শহর রক্ষা বাঁধের হেড টি পয়েন্ট এলাকায় কিছুটে দেবে গিয়ে দুটি ব্লকের মাঝখানে ফাটল দেখা দেয়। নদীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকায় সবসময় তীব্র স্রোত থাকে। সৃষ্ট ফাটলের পরিধি বেড়ে যে কোন মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে যাবার আতঙ্কে রয়েছে স্থানীয়রা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধটি কেপিআইভুক্ত এলাকা। এ বাঁধটি রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের রুটিন ওয়ার্ক। হার্ডপয়েন্ট এলাকায় যমুনার প্রবল স্রোত থাকায় বাঁধের লাঞ্চিং অ্যাপ্রোচে গিয়ে আঘাত করে। এতে দুটি ব্লকের মাঝখানে একটি গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে সকাল থেকেই সেখানে সিসি ব্লক ডাম্পিং করা হচ্ছে। তবে এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই।

শুক্রবার (১৮ জুলাই) দুপুরের দিকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী (ডিজাইন) মোতাহার হোসেন ঘাটাইল সেনানিবাসের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহম্মেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

পানি সম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সকল সরঞ্জামাদি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বাঁধের কোনও সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক সংস্কার কাজ শুরু করা হবে। 

গাইবান্ধা সংবাদদাতা জানান, বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কমতে শুরু করেছে ঘাঘটসহ যমুনা নদীর পানি। পানিও ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান জানান, দুই দিন আগেও ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

শুক্রবার (১৯ জুলাই) তা নেমে এসেছে ৮৫ সেন্টিমিটারে। দুই দিনে প্রায় ৯ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার অতিক্রম করলেও এখন ১৪১ সেন্টিমিটারে নেমে এসেছে। ভারি বর্ষণ না হলে এই পানি দ্রত কমে যেতে পারে।

পানি ধীরে কমলেও দুর্ভোগ কমেনি গাইবান্ধার সদর এলাকার বাসিন্দাদের। বন্যার পানিতে ডুবে থাকার কারণে নোংরা ও বিষাক্ত আবর্জনায় ভরে গেছে চারিদিক।পানি খুব বেশি না কমার কারণে স্বাভাবিকভাবে কেউ চলাফেরা করতে পারছেন না।

পানি কমতে শুরু করলেও পানি বাহিত রোগ বালাই বাড়ছে। গ্রামের অনেক লোকের পায়ে ঘাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

গাইবান্ধার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ হানিফ বলেন, এখন পর্যন্ত ১০৯টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে গাইবান্ধা জেলার জন্য। প্রতিটি টিম বন্যা দুর্গতদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এবং তাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষধ দেয়া হচ্ছে।

গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায় বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এখনও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। আশা করছি বৃষ্টি না হলে বন্যা পরিস্থিতি খুব দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

টাঙ্গাইল সংবাদদাতা জানান, বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) রাতে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর-তারাকান্দী সড়কের টেপিবাড়ী নামকস্থানে ভেঙে গেছে। এতে ভূঞাপুরসহ পার্শ্ববর্তী গোপালপুর ও ঘাটাইল উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। যোগাযোগ বিছিন্ন রয়েছে তারাকান্দিস্থ যমুনা সার কারখানার সাথে উত্তরাঞ্চলের।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপুর্ণ এই সড়ক রক্ষায় কোনও উদ্যোগ না নেয়ায় গ্রামবাসী চেষ্টা করেও রাস্তাটি রক্ষা করতে পারেনি। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এক যোগে কাজ করছে।

শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়কের ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায়, ভূঞাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হালিম , গোপলপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠাণ্ডু, ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দসহ আর‌ও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

পানি সম্পদ সচিব জানান, ভূঞাপুর তারাকান্দী রাস্তা যমুনা সার কারখানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিধায় জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন অংশে জিও ব্যাগ ফেলে গাড়ি চলাচলের উপযোগী করা হবে। যমুনার পশ্চিমাংশে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে, পূর্বাংশে প্রাথমিক ভাবে কাজ চলছে, জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ থেকে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ পর্যন্ত ভাঙন রোধে সার্ভে করে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত হাতিয়া, জাবরাজান ও মীর হামজানীর তিনটি বাঁধ ধ্বসে কমপক্ষে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভাওয়ালে এলজিইডি কর্তৃক নির্মিত একটি ব্রীজ যে কোনও সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত দেবনাথ।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মগড়া ইউনিয়নের বড়বাশালিয়া ব্রীজের অ্যাপ্রোচ ভেঙ্গে কয়েকটি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যে কোনও সময় ব্রীজটি ভেঙ্গে পড়তে পারে। দেলদুয়ারের গড়াসিন ব্রীজের অ্যাপ্রোচও ধসে গেছে। 

টাঙ্গাইলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, উপজেলার বিভিন্ন অংশে ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলানোর কাজ অব্যাহত রয়েছে।

টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোশারফ হোসেন খান বলেন, নদী তীরবর্তী ৬টি উপজেলায় আংশিক ২৬ ইউনিয়নের প্রায় ১০৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি বন্দি হয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬৮০ জন মানুষ। 

এসএমএম

আরও পড়ুন