• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুলাই ২১, ২০১৯, ০৯:২০ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২১, ২০১৯, ১০:০৬ এএম

‘শাড়ি’র ফেরিওয়ালা প্রিয়া সাহার প্রহসন!

‘শাড়ি’র ফেরিওয়ালা প্রিয়া সাহার প্রহসন!

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতকালে বাংলাদেশি নাগরিক ও ‘শাড়ি’ নামক একটি বেসরকারি সেবামূলক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার প্রিয়া সাহা উরফে প্রিয়বালা বিশ্বাসের রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারের বিষয়টি। গত বুধবার (১৬ জুলাই) হোয়াইট হাউজের এক বিশেষ আয়োজনে উপস্থিত এই নারী বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে প্রসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লাখ) হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এরইমধ্যে উধাও হয়ে গেছে। পাশাপাশি তিনি এখনো বাংলাদেশে বসবসকারী অবশিষ্ট ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্রাম্পের সহায়তাও চান। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন ওঠে, কে এই প্রিয়া সাহা, কোথায় পেলেন তিনি এই তথ্য, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তার এই দেশ বিরোধী অপপ্রচারের প্রধান উদ্দেশ্য কি ইত্যাদি।

অপর দিকে জানা যায় একাধিক বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রিয়া। যার মধ্যে তার নিজেরও ‘শাড়ি (SHAREE)’ নামক একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) রয়েছে। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রিয়া সাহার এমন রাষ্ট্র বিরোধী অপপ্রচারের নেপথ্য খুঁজে বের করতে ও ‘শাড়ি’ নামক তার যে সংস্থাটি রয়েছে তার ব্যাপারে তথ্য অনুসন্ধান শুরু করে দৈনিক জাগরণ। আর তাতে প্রিয়া সাহা ও ‘শাড়ি’ সংস্থাটির ব্যাপারে যে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে তা রীতিমত বিস্ময়কর।

II প্রিয়া সাহা ও ‘শাড়ি’র অবিশ্বাস্য দুর্নীতি প্রহসণের কড়চা

প্রিয়া সাহার রাষ্ট্র বিরোধী মিথ্যাচারের নেপথ্য অনুসন্ধানে খোজ নেয়া হয় তার নিজের সংস্থাটির। সংস্থার কার্যক্রম ও আনুষাঙ্গিক বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধানে এর ওয়েবসাইটে খোঁজ শুরু হয়। আর প্রথম থেকেই সামনে আসতে শুরু করে একের পর এক অপ্রত্যাশিত জালিয়াতি আর দুর্নীতির তথ্য। যার ভিত্তিতে প্রশ্ন ওঠে, একটি অবৈধ সংস্থার প্রধান কর্তাব্যক্তি কী করে হোয়াইট হাউজের মত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমন্ত্রণের যোগ্য বলে বিবেচিত হলেন?

একেবারেই শুরুতেই দেখা যায় প্রিয়া সাহার প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির নিবন্ধিত কোনো স্বীকৃতি তো দূরের কথা বৈধ অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই তাহলে কে বা কারা এমন একজন ব্যক্তিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিনিধিত্ব করবার জন্য নির্বাচন করলো, আর কেনইবা এটা করা হলো?

পর্যায়ক্রমে এই অনুসন্ধানটিতে যে সকল বিষয় প্রকাশ্যে আসে তার প্রেক্ষিতে বলা যায়- মানবাধিকার, নারী ও শিশু কল্যান এবং বঞ্চিত মানুষের অধিকার অর্জনের নামে যে মিথ্যাচার আর প্রহসনের পসরা সাজিয়েছে প্রিয়া সাহার সংস্থাটি তা সেবামূলক এনজিওগুলোর ইতিহাসে একটি অমোচনীয় কলঙ্কের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে চিরকাল।

এক নজরে দেখে নেয়া যাক ‘শাড়ি’ নামক সংস্থাটির সাংগঠনিক অবকাঠামো ও কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে অপ্রত্যাশিত প্রহসনের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক-

‘শাড়ি’ সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এর ইংরেজি নামের বানান লেখা রয়েছে ‘SHAREE’। গুগল সার্চ ইঞ্জিনে বাংলাদেশের নিবন্ধিত এনজিওগুলোর নামের তালিকা অনুসন্ধানে ‘শাড়ি’ নামক দুটি সংস্থার সন্ধান পাওয়া যায়। যাদের ক্রমিক নম্বর ও নাম যথাক্রমে- ২০৫৯ Share (ঢাকাভিত্তিক) এবং ২০৬০ Share Bangladesh (খুলনাভিত্তিক)। অর্থাৎ SHAREE নামক সংস্থাটির কোনো নিবন্ধিত অস্তিত্ব সেক্ষেত্রে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

সংস্থার ওয়েবসাইটে যে উইকিপিডিয়া লিংকটি সন্নিবেশিত রয়েছে তাতে প্রবেশ করলে সংস্থাটির নামসর্বশ একটি অপ্রস্তুত ফান্ডামেন্টাল উইকিপিডিয়া পেজ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ নামমাত্র এই এনজিও সংস্থাটি সংগঠিত একটি প্রতারক চক্রের জালিয়াতির সাইনবোর্ড মাত্র। ধারনা করা হচ্ছে যে, সেবামূলক সংস্থার তকমা সেঁটে বিদেশি অনুদানের অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি একটি বিশেষ মহলের রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তের নেটওয়ার্কে সম্পৃক্ত রয়েছে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে বলাবাহুল্য, জাতিসংঘ ও তার সহযোগি সংস্থাগুলোসহ সেবামূলক সংস্থাসমূহের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের অত্যন্ত ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি বা চক্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত এই শাড়ি সংস্থাটি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

সংস্থাটির নাম, নীতিমালা, দর্শন, কার্যনীতি, উদ্দেশ্য বা পরিচিতি প্রসঙ্গে যে সকল তথ্য দেয়া রয়েছে সেগুলো পরস্পর সাংঘর্ষিক এবং অসংশ্লিষ্ট। যেমন:

সংস্থটির নামকরণের বিশদ রূপটি একটি ত্রুটিপূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে, Self-Help Associaion for Rural people through Education and Entepreneurship (SHAREE)।

নামকরণে সংস্থার কার্যনীতি হিসেবে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের মানুষকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার বিষয়টি প্রতীয়মান হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রামীন ব্যাংকের কথা। যাদের কার্যক্রমগুলো এই আওতাধীন ছিলো। অথচ নিজেদের পরিচয় পর্বের প্রথম বাক্যটিতেই তারা বলছে, এটি ‘নারী উন্নয়নমূলক’ একটি এনজিও সংস্থা!

‘শাড়ি’ সংস্থাটির কর্মী ও রিসার্চ স্টাফ হিসেবে শুধুমাত্র নারীদের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ থাকলেও ওয়েবসাইটে সন্নিবেশিত সংস্থার নিজেস্ব প্রজেক্ট রিসার্চ ও প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় এর অধিকাংশই লিখেছেন পুরুষরা। আর এই লেখকদের কারো সম্পর্কে কোনো প্রকার তথ্যও সংযুক্ত হয়নি, যা বিধি বহির্ভূত।

সংস্থার নিবন্ধন সম্পর্কিত তথ্যাদিও অনেকাংশে ভুয়া ও বানোয়াট তথ্য নির্ভর।

‘শাড়ি’ সংস্থাটি তাদের নামকরণে নিজেদের গ্রামাঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে নিবেদিত সংস্থার নীতিধারক এবং পরিচিতি পর্বে নারী উন্নয়ন মূলক সংস্থার পরিচয় প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় প্রদানের ক্ষেত্রে যেমন অস্পষ্টতা সৃষ্টি করেছে তেমনি কার্যক্রমের বর্ণনায় আবার তুলে এনেছে বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রাপ্তির কথা। অর্থাৎ একেবারেই অগোছালো এবং অসংলগ্ন তথ্য প্রদানের মাধ্যমে প্রহসন সৃষ্টির বিষয়টি পরিষ্কার।

ওয়েব সাইটটিতে ২০১৩-২০১৫ সালের মাঝে একেবারে গড়পড়তা কয়েকটি কার্যক্রমের তথ্য পাওয়া যায়। যার অর্থ হচ্ছে বিগত কয়েক বছর যাবত আক্ষরিক অর্থে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে সংস্থাটি। আর যে কয়েকটি কার্যক্রমের তথ্য পাওয়া যায় তা যে প্রিয়া সাহাকে হোয়াইট হাউসের দরজায় দাড়ানোর মত যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে নির্ধারন করে না তা যে কেউ বুঝে নিতে পারবে।

সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রিয় বালা বিশ্বাস নামের একজন নারীর নাম উল্লেখ করা রয়েছে। আর হোয়াইট হাউসে প্রতিনিধি হিসেবে সেই একই নারী নামধারণ করেন প্রিয়া সাহা। আসলে তার নাম কোনটি আর কেনই বা এই নাম বদলের অপচেষ্টা এক্ষেত্রে এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

সংস্থাটির অনুদান সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে পে-পাল একাউন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে আশ্চর্যজনক বিষয়টি হলো, সেই একাউন্টি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের অনুদান সংগ্রাহক একাউন্ট হিসেবে নয় বরং কোন এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত পে-পাল একাউন্ট anup04sust@gmail.com নামে সংযুক্ত!

II সংস্থার অজ্ঞাতে হোয়াইট হাউজে প্রিয়া সাহা, নেপথ্যে কারা?

এদিকে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের শীর্ষ নেতা কাজল দেবনাথ জানান, প্রিয় সাহা কিভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গেছেন তা তিনি বা তার সংগঠন জানে না। যদিও সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা কিন্তু সে অনুষ্ঠানে তাকে প্রতিনিধি নির্ধারন করেনি সাম্প্রদায়িক ঐক্য পরিষদের কর্তৃপক্ষ।

কাজল আরো বলেন, ‘ট্রাম্পের ওই অনুষ্ঠানের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে তিনটি নাম চাওয়া হলে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান এই তিন সম্প্রদায় থেকে তিন জনের নাম দেয়া হয়। তারা হলেন নির্মল রোজারিও, নির্মল চ্যাটার্জি এবং সুজিত বড়ুয়া। এখন প্রিয়া সাহা কি করে গেলেন সেটা আমরা জানি না। সে আমাদের সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক, তবে আমাদের মনোনীত প্রতিনিধি ছিলেন না।’

তিনি জানান, ‘সেখানে ১৩৪টি দেশের প্রতিনিধি ছিলেন। ৪০ জন ফরেন মিনিস্টার ছিলেন। আমাদের ফরেন মিনিস্টারও ছিলেন। তিনি আমাদের দলনেতা। তাদের সঙ্গে না থেকে প্রিয়া সাহা কিভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ২৭ জনের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন সেখানে ঢুকলেন এটা বড় প্রশ্ন।’

আরও পড়ুন